Wednesday, December 25, 2019

ঝুরোগল্প-সোনালি বেগম















যোগীর সারেঙ্গি বাজছে         সোনালি বেগম

পূর্ব উত্তর প্রদেশের গোরখপুর।মাটির দাওয়ায়  বসে মুসলিমযোগী  আলি রাজ সারেঙ্গি  বাজাচ্ছে।রামায়ণের  গল্পগাথা সুর করে গেয়ে চলেছে। যোগী জহুর এবং কারিমুদ্দিনও  এসেছে। এদের পরণে  কমলারঙের টিলেঢালা  পোশাক, মাথায় কমলা কিংবা লাল রং-এর  পাগড়ি।

কিছুক্ষণ  পর পথের ধুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ওরা হেঁটে যাবে পৃথিবীর পথে। এরা ইসলামধর্মে বিশ্বাস করে আবার গোরখনাথকেও অনুসরণ  করে। এই সুফি মুসলিমযোগীর সংখ্যা বর্তমানে বেশ কমে আসছে। গোরখপুর, দেওরিয়া, কুশিনগর, বলরামপুর, আজমগঢ়-এ  বেশিকিছু  মুসলিমযোগী-পরিবারের বসবাস। 
আলিরাজ দু-সপ্তাহ  পর ঘর  ফিরছে আজ। ওর বউ মুন্নি  জায়নামাজের পাটি অর্থাৎ নামাজের মাদুর গুছিয়ে ঘরের কোণে রেখে দেয়। ওরা সারাদিনে পাঁচবার নামাজ পড়ে।আবার বাবা গোরখনাথকেও  পুজো করে।
‘হিন্দু ওমুসলিম  বা অন্য যে কোনো  ধর্মের মধ্যে  কোনো  পার্থক্য  নেই।কারণ সকলেরই দাতা অর্থাৎ ভগবান  একজনই  হয়’, মুন্নি বলে, ‘জন্ম আর মৃত্যু আমাদের সবারই  একইভাবে  হয়ে  থাকে।’
মুন্নি কখনও  স্কুলে  যায়নি। সে নিজেও মুসলিমযোগী  পরিবারে জন্মেছে। বাবা  এবং স্বামীর গেয়ে যাওয়া সমস্ত গানের মধ্যে সে স্বচ্ছ  জীবনদর্শন খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এইসব সুফি যোগীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ভেতরে  এবং বাইরে  নানানভাবে  চাপের সম্মুখীন  হচ্ছে তারা।
‘মুসলিমরা আমাদের গ্রহণ করতে চায়না। আবার হিন্দুরাও  আমাদের পছন্দ করছে না’ মুন্নির চোখে মুখে আতঙ্ক।
‘আগে মানুষজন আমাদের গান শুনে উপহার, খাবার-দাবার দিত’ যোগী কারিমুদ্দিন-এর আক্ষেপ।
‘আমরা নিজস্ব  সম্পত্তি  রাখায়  বিশ্বাস  রাখি না, হে গোরখনাথ’ মুন্নির  জোড়াতালি  সালোয়ার-কামিজ  স্পষ্ট দারিদ্র্যের জানান দেয়।
মাটির ভাঁড়ে  সকলকে চা-পরিবেশন  করছে  মুন্নি। সঙ্গে মুড়ি পেঁয়াজ  কাঁচালঙ্কা।
‘ছেলেবেলায় কত গান গাইতাম। সুফি-গান, নাচ আর সঙ্গে সারেঙ্গি  বাজাতাম। আমার বাপ জহুর  একজন পুরোদস্ত্তর যোগী। আর আমি এখন দিনমজুরের  কাজ করি।  ভাবো  তো, কেমন দিনকাল বদলে যাচ্ছে চাচি!’
মাটির দাওযায়  সন্ধ্যা নেমে আসছে। সূর্যর শেষ আলোয়  তখন কমলা রং-এর  ছটা  আরও বেশি তীব্র  আরও  বেশি মমতাময় মানবিকতায় ছড়িয়ে যাচ্ছে।


চিঠি- হিয়া













হিয়া
১.
রুরু,
তোর আমার শহর থেকে দূরে গোলাপি রুমাল রেখে এসেছি আকাশে।গোটা দিন চালসা - নাগরাকাটাতে ঘুরে বেড়িয়েছি পাতালপ্রবেশের রূপান্তর ইচ্ছে নিয়ে।ভোরের বাসে যখন শিলিগুড়িতে এলাম , তখন তিস্তা জেগে গেছে।শিলিগুড়ি জংশনে নামার পর রাস্তার ওপার থেকে সেবক মোড়ের অটোতে মিত্তাল বাসস্ট্যান্ড।বাসস্ট্যান্ডে আলিপুর অথবা বীরপাড়া যাওয়ার বাসে উঠে অবশেষে চালসা।চোখে ঘুম লেগে থাকলেও ,সেবক কালীমন্দির , তিস্তাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিলাম চালসার দিকে।চোখে তখন পাহাড়ের ঘোর , মনে তোর।রুরু,আমি তোর থেকে যত দূরে যাই ,তত কাছে থাকি তোর।আচমকা কানে ভেসে এল ড্রাইভার দাদা কাউকে বলছে -" ইন্দুর আসে (আছে), ইন্দুর ! হুই তাকের ভিতর।প্যাকেটটার অনেকটা খায়ে লিসে।বাকীটা বান্দররে দিয়া দাও।" তারপর কিছুক্ষণ ইঁদুর-বাদর নিয়ে গবেষণা চলল বাসের অনেকের।আমি খেয়াল করলাম রাস্তার ধারে বসে থাকা পাল পাল লেজওয়ালা প্রাণীগুলো ছুঁড়ে দেওয়া বিস্কুটগুলো কী অসামান্য দক্ষতায় লুফে নিচ্ছে!বাস থেকে নামার পর ইচ্ছে থাকলেও হাতে ধরে রাখা মোবাইলটা হারাবার ভয়ে ওদের দিকে যাইনি বা ওদের ছবি তুলিনি।রুরু, তুই যখন রেগে থাকিস তোকে ঠিক ওদের মতোই দেখতে লাগে।ওদের মতোই আমার থেকে কেড়ে চিলিফিশ খাস।যাইহোক ,তিস্তানদী - মূর্তিনদী , চালসা ভিউ পয়েণ্ট , কুঠির দিকের রাস্তা , রেলস্টেশন , স্কুল- ফেরত মেয়েটির একলা ঘরে ফেরা ,নাগরাকাটার পথ , বুনো ফুল - একে একে সব নিজের ভেতর ভরতে ভরতে যখন রাতের ডিনারের ডিমের ঝোলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম , হোয়াটস অ্যাপে তোর কবিতাটা এল।নির্মোহ না হলেও ,পথিক তো বটেই আমি ! পথিকপ্রাণ মানুষ পথে পথেই রচনা করে তার পথের পাঁচালী , পথের প্রেম তবু তার জন্য নয়।ঘর পথ পথ ঘর - এ কেমন দোটানা আমার ! একটা মোহ আমার এ জন্মে ঘুচবে না , তোর কাছে ঘুমোবার মোহ।এ মোহ ঘুচে গেলে আমার মৃত্যু হোক।আর তা এই তিস্তার জলেই।আর এ আজন্মের মোহ নিয়ে আমি দূরেই থাকতে চাই।আর যে যাই বলুক , এটুকু জেনে রাখ ,আমিই তোর একমাত্র প্রেমিকা যার তোকে ভালোবাসতে তোকেই লাগবে না; নদী - পাহাড় - পর্বত কিছু একটা পেলেই হল , কাজ চালিয়ে নেব।ভালো থাকিস , ভালো রাখিস , নইলে হারিয়ে যাব।
                                                            ইতি
                                                 তোর প্রেমিকা

২.
রুরু ,
এই যে তোকে ভালোবাসি , এও এক ভ্রম।আমার একলষেঁড়ে আমিটা নানান বাহানায় তোকে খুঁজি।রাতের তোর্সার মিঠে হাওয়া যখন আমাকে অন্যরকম ভুজুং দিচ্ছিল মনে , আমি ভেতরে ভেতরে তোকে ছেড়ে যেতে চাইছিলাম।মাথাভাঙ্গার বাসে চড়ে বসলাম।তুইও তখন বাসে।তবে কোলকাতা থেকে নিজের কাজের শহরের দিকে যাচ্ছিস তখন।আমি মাথাভাঙ্গার দিকে ।কী অদ্ভুত প্যারালাল জার্নি! আমার গোটা জীবনে একটাও ভালোবাসার মানুষ ছিল না বলে তোকে ভালোবাসি , কিন্তু তোর যত্ন - আমার প্রতি দায়িত্ব এসব থেকে পালাতে চাই।আমরা কখনো প্রেম করব না , বন্ধু হয়ে থাকব আজীবন।এই পালানোর স্বভাবটাকে মজ্জাগত করেই আমার উত্তরবঙ্গ সফরের সূত্রপাত।আমার অশ্বমেধের ঘোড়া শহর- গঞ্জ পেছনে ফেলে সুটুঙ্গা নদীকে সঙ্গে করে পরের দিন ভোরে পৌছে গেল মানসাই নদীর ধারে তিনকুনিয়া পার্কে।ওখানে বালিতে পা ডুবিয়ে ফোন করলাম তোকে।জানিসতো আমি আজকাল সব বড়ো ভুলে যাই।এই যেমন এখন মনে পড়ছিল না তোকে ফোন করেছিলাম তখন।পিঠে রোদ এসে লাগছিল।বালির ওপর সাধনায় বসতে ইচ্ছে করছিল ধ্যানযোগে।নিজেকে মেরে ফেলার চাইতে অনেক বেটার সমাধিস্থ হয়ে যাওয়া।পথ চলতে চলতে পায়ে কাঁটা বিঁধেছিল - চোরাকাঁটা।ঠিক তোর মতো।এখন আমার জ্বর।বাসে একা ফিরছি কোলকাতা।এ আমার স্বভাবদোষ - তাই তোকে কখনো আমার শূন্যতা দেখাব না , বরং উদাসীনতার ঘেরাটোপে ফুলের চেয়েও তীব্র ভাত-গন্ধকে বেছে নেব।
এরপর আমি কবিতা হয়ে গদ্যের সভায় গিয়ে বসবো, তুই আমার পায়ে চোরাকাঁটা হয়েই বিঁধে থাক।জ্বর বাড়লে তুই আমার জ্বরের ঘোর হয়ে সঙ্গে থাকিস, প্যারাসিটামল হোস না কখনো।
                                                              ইতি
                                                    তোর প্রেমিকা  
৩.
রুরু ,
আমার ছন্নছাড়া জীবনের নড়াচড়াগুলো তোকে কিছুই বোঝাতে চাইছি না।এই যে খুঁতভরাটমার্কা জীবন , কিছুই বোঝাতে চাইছি না।ওসব মোহ আসে না বলেই মোহ নিয়ে খেলি।আজীবন সমর্পণের নামে তোর হাতে তুলে দিয়েছি নিখুঁত অপেক্ষার হদিশ।এ অপেক্ষায় আস্তানা দুজনেরই।আমি বড্ড স্পষ্ট।আর এই স্পষ্টতা নিয়েই আমার সব চলাচল।আমি বিশ্বাস করি সততা আর সহমর্মিতায়।তুইও তাই বলেই জানি।আপাতত চলেছি পুরুলিয়াতে।ভোররাতে ট্রেনের কামরা বদলালাম আদরাতে।এই কামরাবদলের ফেজটায় নিজেকে কেমন যেন অশরীরী বলে মনে হয়।এক খোপ থেকে আরেক।তা সে যাই হোক , ধেনোমাঠ - ঘাসজমি যাই থাক পাশে আমি তোর রুক্ষতার পাশে মারাত্মকভাবে মানানসই।তুই আমাকে না ছাড়তে চাইলেও আমি তোকে ছেড়ে যাবই।খলিশবাতি জ্বেলে রোজ রাতে কাঁদে যে মেয়ে তাকে আশ্রয় মানায় না।এ বন্ধুত্ব আজীবনের ,হয়তোবা হাজার বছর পার করব আরো। পিয়ানোতে বাজুক রিদম ডিভাইন।
                                                        ইতি
                                               তোর প্রেমিকা
৪.
রুরু,
বিশরী গ্রাম , কুমারী নদী , লোকগান , নতুন বন্ধু , পুরোনো খুশি , সৃজন উৎসব নিয়ে স্থানীয় কিছু মানুষের অবরোধ , কুর্মীদের প্রত্যাখ্যান এসবই স্মৃতি আমার।সত্যি কথা বলতে তুই জানিস আমার ফেরার কোন ঘর নেই।যে ঘর আছে তা ছাড়বার উপায় নেই ,আর সে ঘরে আশ্রয় নেই।এই ক্রমশ আশ্রয়হীনতায় জেদী মেয়েটা লড়তে লড়তেও কখনো কখনো হার মানে।আজ কিছু বলব না।বলতে চাইছিই না আর।অভিমান ভর করলে যে জেদ চেপে বসে তাতে আর যাই হোক কাউকেই সাড়া দিতে ইচ্ছে করে না।হাঁসের ডিম নিয়ে দিশি জুয়া দেখে এসেছি।আমিও এবার দান দিলাম , তবে তা শূন্য।দেখি কতদূর যাওয়া যায়।খুঁজিস না।আমার চোখে কান্না নয় আগুন দেখেছে যারা , তাদের কাছে নিজের হেরে যাওয়া দেখাতে আসব না কখনোই।নিজের যত্ন নিস।কোলেস্টেরলটা নিয়ন্ত্রণে রাখিস।আপাতত আমার হয় শূন্য, নয় ছক্কা।
                                                                 ইতি
                                                    তোর প্রেমিকা
৫.
রুরু,
ঠিক কোথা থেকে শুরু করব জানি না,আসলে আমাদের জার্নিটা ঠিক কোথায় কবে শুরু হয়েছিল তা মনে থাকলেও , এটা ঠিক মনে নেই কবে তা গাঢ়তর বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছিল।এই যেমন মনে নেই , আমি ঠিক কবে একা একা পথে পথে ঘুরতে শুরু করেছিলাম।গোটা সফরটায় অনেকেই প্রশ্ন করেছিল ,' তুমি একা !' হুঁ আমি একা।আসলে দোকার মতো যাদের দেখায় , তারাও একা।এতশত সম্পর্কের জটিলতা দেখেছি যে বিতৃষ্ণা জন্মে গেছে ঐ 'সম্পর্ক' নামক শব্দটার ওপর।একে অপরের সাথে থেকেও কত নানান সম্পর্কে জড়িয়ে যেতে দেখছি।ফাঁক আর ফাঁকি রাশি রাশি।কোথাও সমর্পণ নেই , অপেক্ষা নেই।সেই জ্বলজ্বলে আলো নেই।সব কেমন যেন টুনি বাল্ব।তাই বলে এতটুকু পড়ে, টুনির মা গানটা গাস না যেন।যদিও আমি সব শুনি , সব দেখি , সব পড়ি , তবু ভালো মন্দ বলে একটা বিষয় তো আছে নাকি! ভালোটা কেন ভালো তা বুঝতে গেলে আগে মন্দটুকু চিনতে হয়।আমাদের জীবনে তাই ভালোর আগে অনেক কিছু খারাপ ঘটতেই থাকে।এসবের মাঝে আমি নিজেকে তোর প্রেমিকা বলে ঘোষণা করেছি , যদিও আমরা বন্ধুত্বে বিশ্বাসী।আসলে ভালোবাসা ঈশ্বরের মতো।একজন কাউকে সেই আসনটায় বসাতেই হয়।যার জন্য গোটা জীবন একা থাকতে হয় ।তুই কখনো কোনদিন চাইলেও তোর সাথে ঘর করব না , অন্য কারোর সাথেও না।গতকালও এক বন্ধুর চুমুকে প্রত্যাখ্যান করেছি।ঠিক ঐ মুহূর্তে মনে পড়ে গেল ,তুই বলেছিলি...থাক সেকথা।জানি মনে আছে তোরও।এই মেয়েটা তোরই।আর কেউ কখনো সত্যি ছুঁতে পারবে না।এই অপেক্ষার মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী কান্না লেপ্টে থাকে এক প্রগাঢ় আনন্দকে ছুঁয়ে।আমি কোলকাতা থেকে দুর্গাপুর হয়ে উত্তরবঙ্গ , পুরুলিয়া হয়ে ফের ঘরে ফিরেছি।বুঝদার বাবা আর অবুঝ মায়ের ঘর আমার।অনেক কাজ জমে আছে , লেখাও।ধীরে ধীরে সবেতেই ফিরছি।কিন্তু এও বুঝতে পারছি , উত্তরের কোন এক মনাস্ট্রিতে আমার মন আটকে গেছে।সেখানে অবশ্য আমার যাওয়া হয়নি।তথাগতদা গিয়েছিল।ওখান থেকে কল করেছিল।আমি সেখানে পৌছতে চাইছি অন্যান্য কবিদের একাকীত্ব- নির্জনতা- বিষণ্ণতা সঙ্গে করে।অথচ আমাকেই গ্রাস করছে ডিপ্রেশন।অন্ধকার ঘরে আটকে ফেলছি নিজেকে।গতকালের বন্ধু আমার ঘরকে ' স্বপ্নের বাসা ' বলেছে।সেই ঘরেই আমি আলো নেভাচ্ছি , ফের জ্বালছিও।পিঠে অনেক কাজের বোঝা , তাই আলো জ্বালছি।অথচ রুরু, আমি তোর বুকের ওপর মাথা রেখে সেই ভোররাতের ঘুমটা গোটা জীবন ঘুমোতে চাইছি।আমার কিছু হয়ে গেলে তুই নাকি আমাকে ছেড়ে কথা বলবি না ! কিন্তু আমি তো আরো আরো শান্ত হয়ে যাচ্ছি।চুপ আরো চুপ।নিঃসারে পথ চলব শুধু।আর বাকীটা সময় মেরুদণ্ডের সেই আলোটা খাব।ওতেই আমার কবিতা আসে ,কবিতাই অর্গাজম আমার।আমি আসলে কোন সুইসাইড নয় ,সেই দীর্ঘ সমাধিতে যেতে চাইছি ,তার আগে পর্যন্ত কাজ আর পথ চলা।আমি হয়তো আর কখনো ফোন করব না।তাই বলে গত পরশুর মতো পথে পথে ঘুরে অন্য কারোর ফোন কেঁড়ে ফোন করিস না।তুই ফোন করলে ধরব ,তবে আমি করব না।এই অপেক্ষাটুকু থাকুক একান্ত আমার হয়ে।আমি মনে মনে চাইলে তোকে আমার কাছে আসতেই হবে।তার জন্য আমাকে মুখে বলতে হবে না।আমার গলার স্বর শুনে যে সব বুঝে যায়, সে নাহয় এটুকুও পারুক। রুরু, তোর জন্য শেষ অব্দি আমি রইলাম।
                                                               ইতি,
                                                   তোর প্রেমিকা

মনের কথা-আফজল আলি














জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্টের বিরোধিতা আমার  মনবলকে কতটা দুর্বল বা এগিয়ে দিয়েছে
আফজল আলি 

বিষয়টা হচ্ছে জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্টের বিরোধিতা আমার মনোবলে কতটা দুর্বল করেছে বা এগিয়ে দিয়েছে ।। এটা ব্ল্যাকহোলের সম্পাদক অভিজিৎ দাসকর্মকারের বেঁধে দেওয়া টপিক। কাজেই আমাকে এটা নিয়েই বলতে হবে । 
এর আগে অভিজিৎ এর আহ্বানে - জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্ট লেখার তাগিদ - এই বিষয়টি নিয়ে ধারাবাহিক লিখেছিলাম । ওখানে অনেক কথা বলা আছে । কিন্তু কনসেপ্টের বিরোধিতার বিষয়টা লিখতে হবে ভাবিনি । প্রায় তিন বছর আগে যখন জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্টের ধারণাটি আমার মধ্যে অস্বচ্ছ ভাবে তৈরি হচ্ছিল তখন নিজেও ভাবিনি এরকম একটা অজানা বিষয়ের উপর বই লিখতে পারব। জিরো বাউন্ডারির বিষয়টি আমার কাছে ছোট্ট একটা ধারণা বা দুটি শব্দবন্ধ হিসেবে এসেছিল। পরবর্তীতে সেটা নিয়ে গভীরে ভাবতে ভাবতে আরো স্পষ্ট এবং স্বচ্ছ আকার নিয়েছিল। এগুলো আগেই বলেছি । যখন আমি কনসেপ্টটি লিখছিলাম , প্রাথমিকভাবে 20-25 পাতার দুটো পর্ব লিখে বাংলাদেশের ছোটকবিতার website থেকে প্রকাশ পেয়েছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম কেই বা পড়বে , দু দশজন পড়লে বা জানলেই আমার হবে। এর বেশি চাহিদা বা আশা ছিল না । কিন্তু প্রকাশের পর দেখলাম 50-60 জন থেকে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ল যা আমার ভাবনার অতীত। তখন বিরোধিতার ব্যাপারটা আমি ভাবতেই পারিনি । একটা WhatsApp group খোলা হয়েছিল । সেই WhatsApp group সূত্রেই অনেক তরুণ কবি এসেছিল । তখন তারা জিরো বাউন্ডারিকে সমর্থন করেছিল । তার মধ্যে ছিল রূপম শাল্যদানী , জোতির্ময় মুখার্জি , রাহুল গাঙ্গুলি সহ একাধিক । অনেকে গদ্য লিখেছিল জিরো বাউন্ডারি নিয়ে , কেউ কেউ আলোচনা করেছিল ফেসবুকে । বেশ রমরম করে চলছিল । কিছু দিন পর দেখলাম আমার স্নেহভাজন দু একজন জিরো বাউন্ডারি WhatsApp group e থাকা বা না থাকা নিয়ে হঠাত্ ই কনসেপ্ট তথা আমার বিরোধিতা শুরু করল । হয়তো আমার ও ব্যক্তিগত কিছু ত্রুটি ছিল , আমি তাদেরকে বোঝাতে পারিনি। ক্রমে ক্রমে বুঝতে পারলাম খেলাটার কেন্দ্রবিন্দুটি ছিল অন্য কোথাও । যখন পুরোপুরি জানলাম তখন খুব আঘাত পেয়েছিলাম । পরে ভাবলাম আমিও সেই সিনিয়র কবি তথা আমার কবিতা জীবনের অন্যতম গুরু এবং অভিভাবকসম মানুষটিকে হয়তো আঘাত দিয়েছি হয়তো , হয়তো বা আমার অজান্তেই। কিন্তু আঘাত বলতে নতুন একটা কনসেপ্ট লেখা । আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি বোঝাতে কিন্তু পারিনি। ঠান্ডা মাথায় ভাবলাম আসলে জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্ট লেখাটাই মূল কারণ এই বিরোধিতার । কিন্তু মজার বিষয় এই সব বিরোধীতার মধ্যেও আমি তথা জিরো বাউন্ডারি গ্রুপ নতুন নতুন তরুণদের কাছে পেয়ে যাচ্ছিল জিরো বাউন্ডারি WhatsApp group টির মাধ্যমে । একটা প্রেরণা এবং শক্তির জায়গা তৈরি হয়ে যাচ্ছিল । সঙ্গে পেয়েছিলাম রুমা ঢ্যাং অধিকারীকে যে সম্পূর্ণ একা web magazine টি প্রকাশ করছিল। সঙ্গে পেয়ে গেলাম সুকান্ত ঘোষাল রণজিৎ পান্ডে অনুপ বৈরাগী এবং আরো অনেক । পরে এলো অভিজিৎ দাসকর্মকার সংযুক্তা পাল অনুরূপা এবং তীব্র গতিতে চলতে লাগল জিরো বাউন্ডারির কাজকর্ম । যদিও তা খুব আহামরি কিছু নয় । আমাদের সামর্থ্যের মধ্যে যতটুকু হয় । আহামরি নয় , তবে ব্যতিক্রমী । ক্রমে ক্রমে দেখলাম কীভাবে জিরো বাউন্ডারি একটা কাঠামোর রূপ নিয়েছে। আমার আত্মজন এবং স্নেহের মানুষদের সেই বিরোধীতার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম । আমি কষ্ট পেয়েছি , কিন্তু সেই সঙ্গে নতুন নতুন এত তরুণ কবিদের সমর্থন পেয়েছি যে আমার কষ্ট বড়ো আকার ধারণ করতে পারেনি। WhatsApp group এ প্রতিদিন নতুন নতুন কবিতা পড়া, সেগুলো সম্পর্কে মতামত দেওয়া , নিজের কবিতা লেখা , কবিতা বিষয়ক গদ্য লেখা এবং জিরো বাউন্ডারি সম্পর্কে গদ্য লেখা , web magazine করা এ সব কাজ করতে করতে কীভাবে সময় চলে গেছে বুঝতে পারিনি । জিরো বাউন্ডারি গ্রুপ থেকে উঠে এসে অনেকে সরে গেছে , অনেকে শত্রুর মতো আচরণ করেছে , অনেকে আবার নতুন করে আপন হয়েছে। আঘাত পেলে দুরকম প্রতিক্রিয়া হয় । কেউ শেষ হয়ে যায় , আবার কেউ নতুন উদ্যোম পায় । আমার ক্ষেত্রে এ সব কিছুই হয়নি । আমি আমার দৈনন্দিন এবং সময়ের সাপেক্ষে কবিতা সংক্রান্ত কাজগুলো করি । এর ফলে যতটুকু যা হবার হয়েছে । এখন তো print magazine ও বেরুচ্ছে । তবে আমার নিজের উপর বিশ্বাস ভরসা ছিল বা আছে । আমি একা পথ চলি না । সবাইকে নিয়ে চলি । তাই সুখ দুঃখ share হয়ে যায় । ভেবেছিলাম 5-10 জনের কাছে পৌঁছাতে পারলে অনেক , এখন তো ফেসবুক তথা আমাদের কাজের মাধ্যমে ( ছোট হলেও ) 10000 মানুষের কাছে পৌঁছে গেছি । প্রতিষ্ঠা পেয়েছে জিরো বাউন্ডারি । এটা নিশ্চয় নেগেটিভ নয় । আমি বুঝতে পেরেছিলাম জিরো বাউন্ডারির বিরোধিতা করছে মানে এর সারবত্তা আছে । যার ভিতরে সারবত্তা থাকে না তার বিরোধিতা হয় না । মানুষের মধ্যে কাজ করলে , সেটা সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করলে তবেই বিরোধিতা আসে । তবে আমি তো চিন্তা চেতনার প্রসারতা নিয়ে কাজ করেছি , মানুষের উপর অত্যাচার করার মতো কিছু করিনি যে মানুষ অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বিরোধিতা করছে । যারা বিরোধিতা করছে , তাদের ভিতরে এমনটা কাজ কীভাবে আফজল আলি একটা কনসেপ্ট লিখল , কেন আমি বা আমরা পারলাম না । কনসেপ্টের ভালো মন্দ সমালোচনা সব সময়ই স্বাগত । এদের বিরোধিতা ভিন্ন রকম । জিরো বাউন্ডারির গ্রুপকেই ভেঙে দেওয়া । তিন বছর হতে চলল ।


রাইমোহিনী-সংযুক্তা পাল













২৩শে এপ্রিল ২০১৯/৯ই বৈশাখ ১৪২৬              রাইমোহিনী

শশ্মানের চুল্লীর মত কৃষ্ণ গহ্বর।আত্মলীনতার জন্য ধ্যানে বসেছে মৃত্যু। পরাবাস্তব তার হুঁকে টাঙানো শুকনো ব‍্যাঙ দাঁত বের করে হেসে ওঠে কখনো কখনো ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শুনে। শীতার্ত অন্ধকারের নিস্পন্দ উপলব্ধি র আনুগত্যে সত্তারা নিজের প্রতি সপ্রশংস অথচ কি গভীর এবং বিপুল অনাস্থা। স্ববিরোধ মাথা চুলকে যায় সমাধান খুঁজবে বলে-আত্মমগ্নতার প্রশান্তি বৈ আর কিছু মেলে না। রক্তের স্রোতে ধাবমান বৈপরীত্য বৈচিত্র্যের ধারক বটে কিন্তু ঊর্ণনাভর মত নিজেকেই কুঁরে কুঁরে খাবার পথ প্রশস্ত করে। রাস্তা সাজানো থাকে, সাজানো থাকে মৃতদেহ; শুধু সাজেনা তারা,যারা সঙ্গে পথ হাঁটে আর যারা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঐ দিনটার আর্তনাদ শুনতে পায়;আর যারা বাঁশির সুরের উন্মাদনায় নিস্পলক তাকিয়ে থাকে অন্তের দিকে তাদের ভিতরে চলতে থাকে খননকার্য, যেখানে একটার পর একটা পুরোনো সভ্যতার অস্তিত্ব বেরিয়ে আসতে থাকে। নান্দনিক সমৃদ্ধিকে অতিবাহিত সময়ের সৌকুমার্য ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসীর ন‍্যায় বেহিসেবী রকমের দৃঢ় করে তোলে। মাথার ঘিলুতে রক্তের ফল্গুধারা আচমকাই ফাটিয়ে তুলতে চায় অনন্ত বোধির শিকড়। তারই বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে আবিস্কৃত হয়ে যায় এক অখন্ডতার সূত্র। কোথায় আছি আর কোথায় যাব—গভীর অন্তর্লীনতাই তার উত্তর। কোন কোন দুপুরে শশ্মানের ছাইয়ে রাইমোহিনী তাই ভোর খুঁজে বেড়ায়।

চিঠি-অনুরূপা পালচৌধুরী













৩য় দফার চিঠি___        অনুরূপা পালচৌধুরী  

জানি ভীষণ ভালো আছো। তাই কেমন থাকার জরুরী প্রশ্নে আর বিব্রত করবো না। কথা ছিলো তোমার হাতের লাল সিঁদুরগোলায় পাঁপড়িচাটের মেঠো গন্ধে পৌঁছে যাবো সেই হাজার বছরের পুরনো গাছতলাটায়। মহানায়কের নগরবন্দী ইতিহাস চুঁইয়ে পড়ছে আজো রাণীকুঠীর ফুটপাত বিছানো সন্ধ্যায়। তোমার শহরের সেই সন্ধ্যারা কি জড়ো হয় বিজয়গড়ের উল্লাসে? বড্ড বোকা তুমি। আড়াল করতে পারোনি নিজেকে চাবুকের গোপনসরায়। আজো যাদবপুর যাই। 8B অটোস্ট্যান্ডটায় দাঁড়াই।আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে।অসাড় পায়ে দালানকোঠা পেরিয়ে তোমার যাতায়াতের পথ আটকাই। সিগারেটের ধোঁয়ায় ব্যালকনি ভিজলে ছাপিয়ে ওঠে আমার ঠোঁট। আরো একটু পিঠে হাত বোলাই। আমার মতো কেউ কি এখন ঘুম পাড়ায়? এখন তোমায় আদর করে কে ? মনে পড়ে কি সেসব রাতের খামবন্দী জোনাকির কান্না!

আসলে মৃত ঠিকানায় চিঠি পৌঁছায় না কিন্তু চিঠিগন্ধের আমরণ কামড়ের দাগটা থেকে যায়। যেদিন স্বেচ্ছামৃত্যুর পরয়ানা জারি করলে আমি মৃত্যুকে কৌটবন্দী করলাম নিশাচর ঘরের ডিভানে। অমরত্বের দাবী রাখলাম তোমার নো ম্যানস ল্যান্ডের ক্যাফেইন ট্যাবলেটে। ১টা উর্বর চাঁদের আধাআধি আলো খুনে ধীরেধীরে উদ্ধত হলে তুমি। খুন হলাম যাবতীয় আমি এবং আমার আকন্ঠ অস্তিত্ব পানে তুমি অমরত্ব পেলে। আমি মৃত্যুরূপে দাঁড়িয়ে বারংবার আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছি গড়ানো দুপুরগুলির মুখে কিন্তু মৃত্যু হতে পারিনি। বিপরীতে জন্ম নিচ্ছে বিধ্বংসী আলোর উল্কামুখী আগুনের পালস্।  আস্ত জলোচ্ছ্বাসের গলায় বেঁচে থাকার স্বাদটা এখন নিত্য বাড়ে। দেখতে চাই তোমার অভিশপ্ত মাটির শিকড়হীন ফুসফুসে দীর্ঘজীবী তুমিটাকে। অভিশাপ কখনো দিই না বরং ঈশ্বরকে বলি, দীর্ঘবছর আয়ুর দরে তোমার হলুদ চৈত্রের পাঞ্জাবীরা মরসুমি মুখ লিখুক কলকাতার অলিগলি।

অবশেষে বলি, ১টা সূর্যখনির শীতঘুম তোমার আঙুলে পুষছি, শুধু চির বরফের আগুনদারি পেরোবার গর্ত বেড়িয়ে গুনছি মটি অবধি।


                                       ইতি
                          আপাত অপার অত্যন্ত