কবিতার ডালপালা
(প্রথম~পর্ব)
মনে করা যাক, ছোট ছোট ক্ষুদ্রতামুক্ত কোনো এক মানবসমাজের অস্তিত্ব, প্রতিটি মানুষ যখন সাধারণ অপরাধপ্রবণতাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। যেখানে প্রাত্যহিক জীবন-স্তর এমনই যে বস্তুসামগ্রীর জন্য অন্যজনকে বঞ্চিত করতে হয় না, অন্যের অস্বস্তি সম্পর্কে প্রত্যেকেরই একটি স্বাভাবিক বোধ জন্মেছে এবং তাই কৃতকর্মের জন্য অন্য কারো কাছে জবাবদিহিরও দায় নেই। এ অবস্থায় কত বেশি মুক্তির আস্বাদ পাওয়া যেতে পারে যদি স্ববিরোধ-সচেতনতার হাত থেকে নিজেকে আলগা করে নেওয়া যায়! এই আমি পাহাড় চাই, খানিক পরেই চাই না, চাই সমুদ্র, পরক্ষণেই চাই বনানী, পরক্ষণেই লোকালয়– অথবা আমি পাহাড় চাই আবার চাইও না, আমি ভালোবাসার জনের কাছে চলেছি,একটু দ্বিধাও কিন্তু বয়ে নিয়ে যাচ্ছি সঙ্গে করে। কবিতাও যেন তেমনই এক দ্বিধাদ্বন্দ্বের আঁতুড়ঘর। সেখানে নির্দিষ্ট কোন পথরেখা নেই। সময় ও পরিসর ভাবনার বিচিত্র অভিব্যক্তির মধ্যে কোনো একক কবি কিভাবে নিজস্ব নির্মিত - নৈপুণ্যকে প্রতিষ্ঠিত করছেন, কিভাবেই বা নতুন সময়বোধ ও নান্দনিক চেতনাকে আপন সৃষ্টির উৎস করে তুলছেন আর কিভাবে মেলাচ্ছেন সামাজিক বীক্ষণকে — এইটাই তাঁর সার্থকতার কষ্টিপাথর। আর সেই সঙ্গে রয়েছে জাগতিক তথ্য থেকে কবিতার সত্যে এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে নৈর্ব্যক্তিক উপলব্ধিতে পৌঁছনোর জরুরি পরীক্ষা সমাপনের দায়ও। তত্ত্বগত দৃষ্টিকোণ মুহুর্মুহুঃ পালটে যাচ্ছে! যদিও, এলিয়টের একটি পুরনো ও পরিচিত মন্তব্য আজও সমান প্রাসঙ্গিক; "The progress of an artist is a continual self-sacrifice, a continual extinction of personality"। বস্তুত নিজের ফেলে-আসা পথরেখাকে নিজেই যদি মুছে নেওয়া না যায়, বর্জনীয়েরা শৃঙ্খলিত করবে গতিকে, ঝাপসা হয়ে আসবে গন্তব্য। তাই অভিজ্ঞতার পোড়া মাটি দিয়ে নিজের গভীর ভাস্কর্য গড়ে তোলার প্রাক্শর্ত হলো, নিরবচ্ছিন্ন ভাবে নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে এগোনো।
“…একটি পৃথিবীর অন্ধকার ও স্তব্ধতায় একটি মোমের মতন যেন জ্বলে ওঠে হৃদয়, এবং ধীরে ধীরে কবিতা-জননের প্রতিভা ও আস্বাদ পাওয়া যায় ।” (কবিতার কথা, জীবনানন্দ দাশ) কিন্তু নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির প্রবর্তনায় “ to judge of poets is only the faculty of poets” – বেন জনসনের এই বহুল উচ্চারিত উক্তিটি ভাবতেই হয় । আর ভাবছি বলেই আবিষ্কার করছি সত্তরের এক সত্যি, কবি স্বপন চক্রবর্তী’র কবিতাগুলিকে ।
যে বইটা আমার চোখের সামনে খোলা, ওখানে জীবন নেই ।
ওটা ধর্ম কিংবা মিথ্যার অভিধান ।
যে বইটা অশোকস্তম্ভ দিয়ে শুরু, ওখানে সত্যি নেই ।
ওটা ভারতবর্ষের পবিত্র সংবিধান । (অশোকস্তম্ভ)
নিজস্ব ঘৃণার বাইরে বেরিয়ে এসে শ্রমজীবী মানুষের যে শ্রেণীঘৃণা, তার যে ব্যাপক সংহত রূপ তার সাথে এক পবিত্র বোবা সংবিধানের উপলব্ধি আমাদের অবাক করল । আসলে স্বপন চক্রবর্তীর কবিতা হতাশ করে না, সাহসভরে ঋজু দাঁড়িয়ে থাকে লোকানো বিস্ফোরকের মতো ।
ঠিকঠাক তাপে রুটি সেঁকো
অতি তাপ রুটিকে পোড়ায়
কম তাপে রুটি ফোলে নাকো (রুটি)
এই অপ্রত্যাশিত স্পষ্টভাষণ ও ক্রোধ যেন আমাদের আত্মহুতির মধ্যেই জীবনকে বুঝিয়ে দেয় যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করার দর্শন । কবি হয়তো বলতে চান “রুটি” শব্দটির ক্ষুধা, আর্তনাদ, আগুনে সামঞ্জস্য প্রবাহনের নিয়মধর্মী প্রতিভাস । তাই কবি জানিয়ে দেন,
“নির্গত শ্বাসে কেবলি সন্দেহ । / গলির এমুখ ঘুমালে ওমুখ জাগে ।
এপাড়া কাঁথা মুড়ি দিলে। / তাকে ঘিরে নাচে বিনিদ্র ভৈরব । ত্রাস ।
চিরুনি তল্লাশ । / তবু চোখের পাতায় কী গভীর উৎসাহ (মিড়)
সত্তর দশক রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্ঠুরতার পিষ্ট হয়ে মানুষের আদিম গোঙানি হয়ে উঠেছিল । ফুলে ফেঁপে উঠেছিল ক্রোধ । কিন্তু এই ক্রোধ ছিল সম্পূর্ণভাবে নিম্ন মধ্যবিত্তের একান্ত । তাই হয়তো কবি স্বপন চক্রবর্তী উচ্চারণ করলেন :
“শুনেছি শঙ্খচুড়ও দহনের দাউ নেভাতে পাথরে ঢেলে দিয়ে আসে বিষ
কিন্তু আমার জ্বলে পুড়ে যাওয়ার তরল আমি কোন পাথরে ঢালব ?” (দাউ)
সৃষ্টি-মুহূর্তের দহন ও উদ্ভাসন তাঁর সুপরিজ্ঞাত, তিনি ‘অজর, অক্ষর, অধ্যাপক’ এর উপলব্ধি বহির্ভূত সেই দহনের যন্ত্রণাময় প্রস্তুতিতে নিজেও দীর্ণ হয়েছেন । এই নিষ্ঠুর অত্যাচারও যে কোনো-একজন কবি নিজের উপরে করতে পারলেন, তার জন্য কবিকে দোষ দেবো, না সেই আন্দোলনকে, না আন্দোলনের জনক রাজনৈতিক সময়কে, সে বিষয়ে মনস্থির করা শক্ত ।
যেকোনো শিল্প মাধ্যমেই নির্মাণের ভিন্নতা, মূলতঃ চেতনারই পরিবর্তন । চেতনা বদলেই পালটে যায়, দেখার জগৎ ও প্রকাশভঙ্গী । তাবৎ বিশ্বে সব কিছুই কবিতার বিষয় বস্তু হতে পারে । এই দৃষ্টিভঙ্গিকে কেন্দ্র করে বাস্তব ও অবাস্তবতার Tradinational Definition পালটে যাচ্ছে । অনুসন্ধান করছেন তাঁরা । ঘটনার চেয়ে ঘটার সম্ভাবনার মধ্যেই
বাস্তবতার দেখতে চাইছেন । ফলে ভাষাবদলের কবিতা নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা বাড়ছে ।
আসুন কবি ইন্দ্রজিৎ দত্ত-এর লেখা “রূপসী বাংলা বাই লেন” কাব্যগ্রন্থটির একটি কবিতা নিবিড় পাঠ করি ।
আদৃতা
হে বাস
হে ২৩৮ নং বাস, আবার যদি
আমার মতো
আয়না বেচতে আসা কেউ
শহরতলির বাইলেনে হারিয়ে
ফিরে আসার দিকে তাকিয়ে থাকে অহেতুক
তাকে আমার কথা বোলো
তাকে দিয়ো
আমার অসুখ মাখা চিঠি
নেমে যাওয়ার যন্ত্রণা
“আশাবাদের মতো অকাব্যিক আর কিছুই নয়” – লেসলি স্টিফেনের এই বচন সর্বতোভাবে প্রযোজ্য তো বটেই, উপরন্তু সংক্রামক । পূর্ববর্তী প্রধান কবিরা হঠাৎ রাতারাতি নাহলে “সেই অন্ধকার চাই” কিংবা “যে আঁধার আলোর অধিক” ইত্যাকার মন্ত্ররচনার অত ব্যস্তসমস্ত হয়ে উঠতেন না । কিন্তু ইন্দ্রজিৎ-এর বেলায় যে তাঁর চিন্তাগ্রস্ত অস্তিত্বের মূলেই নিরাশা বা অন্ধকারের একটি ন্যায্য ভিতরভূমিকা ছিল, একথা অস্বীকার করা যাবে না ।
আলোচ্য কবিতাটিতে প্রতিদিনের গতির ব্যবহারিক বাস আর নেমে যাওয়ার যে যন্ত্রণা নিছক নান্দনিকেই তার শেকড়বাকড় গচ্ছিত রাখেনা, একটা নতুন ভাবনার উপমাশৃঙ্খল তুলে ধরে তা স্পষ্ট ! আসলে ভাবনার কোনো মানে বই নেই । দৃশ্যের কোনো ব্যাকরণ হয় না । ইন্দ্রজিৎ আয়না বেচতে আসা একটি দৃশ্যের আয়না । যেখানে আমরা নিজেদেরও দেখে ফেলি । তবু কোথাও যেন মনে হয়, ইন্দ্রজিতের কবিতা ক্ষত সৃষ্টি করে না,সেটা তার কাজ নয়, ক্ষতকে আনন্দময় ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলাই তার প্রথম উজ্জীবন । শব্দ ও ভাবনার অন্তর্বর্তী সংকেত ।
2 comments:
সুন্দর ও যথাযথ আলোচনা।
ভালো লাগলো।
- রাজদীপ ভট্টাচার্য
Post a Comment