Sunday, January 23, 2022

কবিতার ডালপালা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||  অরিজিৎ চক্রবর্তী  
 কবিতার ডালপালা ( তৃতীয় পর্ব )  



Kill a man and you are an assassin. Kill millions of men, and you are a conqueror. Kill everyone, and you are a god.”

 – Jean Rostand

কাব্যের আত্মার কাছ থেকে, প্রেরণাধন্য কবির কাছ থেকে কোন ধরনের সত্য আমরা দাবি করতে পারি? যখন অহমাত্মক বিনয়ের এক জীবন্ত চর্ষায় কবি লিখে চলেন একের পর এক স্বরভঙ্গিমা ! তখন কি কোনো প্রত্যয় কাজ করে তাঁর মধ্যে? নাকি ভাবের পরিখায় নিজেই ঝাঁপ দিয়ে খুঁজে নেন আত্মহননের আকুতি।

      আসলে মানুষ কখনো এমন কোনো কিছুর অন্বেষণে নিজেকে প্রবৃত্ত করে না, যাকে আয়ত্ত করার কোনো সম্ভাবনাই নেই। অমৃত আমাদের ক্ষণে-ক্ষণে স্পর্শ করে যায় বলেই আমরা অমৃতের অভিলাষী। ওটা অধরা, কিন্তু অচেনা নয়। কী বলেছিলেন যাজ্ঞবল্ক্য? তিনি একটা উপমা দেন। নুনের একটা ডেলা জলে ফেলে দেওয়া হলো। সেটা গলে জলে মিশে গেল। এবার সেই দ্রবণের যেখান থেকেই পান করি না কেন, নোনতা স্বাদই পাব। অথচ আলাদা করে নুন বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব আর রইল না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হেমন্তবালা দেবীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, " এই জীবনেই কতবার মরেচি ভেবে দেখ। শিশুকালে আমার দাইকে অসম্ভব ভালোবাসতুম। তখনকার যে জীবন সেটা তাকেই কেন্দ্র করে ছিল। এক ঘন্টার মতো তার তিরোধানের কথা সেদিন বিনা অশ্রুপাতে প্রসন্নমনে চিন্তা করতে পারতুম না। কিন্তু সে আজ ছায়া হয়ে গেল, কোনো ব্যথার দাগ নেই। তার পরে অন্য কেন্দ্র নিয়ে যে জীবন সৃষ্ট হয়েছে সেটার দাম সমস্ত সুখ দুঃখ নিয়ে অনেক বেশি। কিন্তু অবশেষে এ সমস্ত গিয়েও জীবনান্তরে আর একটা সত্তা যখন জমে উঠবে তখন তাকে নিয়েই এত ব্যাপৃত হব যে গতস্য শোচনা বলে পদার্থই থাকবে না।" ( চিঠিপত্র, ১৩৩৮/ ১৯৩১ )

    এই বিশেষ অর্থে মৃত্যু মানে শারীরিক মৃত্যু নয়, মৃত্যু মানে সম্পর্কের মৃত্যু। উৎকর্ষতায় মৃত্যু। অভিযোজনের মৃত্যু। এরকম বহু মৃত্যু অথবা হত্যার সম্মুখীন আমরা প্রত্যেকেই কম বেশি হয়ে থাকি। কিন্তু একজন চিন্তাশীল মানুষ যখন একজন চিন্তাশীল মানুষকে সচেতন ভাবে হত্যা করে; একজন কবি যখন একজন কবিকে সচেতন ভাবে হত্যা করে! তখন ভাবতে কষ্ট হয় এই ঋকবেদেই কবিদের ঋষি বলা হয়েছে। ঋষিমনা য ঋষিকৃৎ পদবীঃ কবীনাম্ ।

    কিন্তু তার পরেও আমরা শেষ হয়ে যাই না, কোনো না কোনো ভাবে সার্থকতা খুঁজে নেবার চেষ্টা করি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সে চেষ্টা আমরা করতে পারি এই জন্যই যে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে মৈত্রেয়ী আছেন, যিনি কেবলই মৃত্যুর হাত থেকে আমাদের বাঁচিয়ে চলেন।যিনি কেবলই বলেন, যাহার লাগি চক্ষু বুজে বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর, তাহারে বাদ দিয়েও দেখি বিশ্বভূবন মস্ত ডাগর।

    নান্দনিক সৃষ্টি সম্বন্ধে মার্ক্স " আত্মিক উৎপাদন"( Spiritual production ) কথাটা ব্যবহার করেছিলেন। Paradise Lost লিখে মিল্টন নাকি পাঁচ পাউন্ড পারিশ্রমিক পেয়ে ছিলেন, তাই মুনাফা এবং বাজারসর্বস্বতার মানদন্ডে, মার্ক্স বলেছেন, মিল্টনের ওই বিপুল শ্রম " অনুৎপাদন " । আর ঠিক সেই কারণেই তা তাঁকে অমর করেছে। কেননা ওটা তাঁর আত্মার আত্মীকরণ, ওটা দমনাতীত একটা প্রক্রিয়া। এমনই একটা কিছু যেটা না করলে উৎপাদকের রেহাই নেই। যেটা সে নিছক বাইরের তাগিদে করছে না, করছে নিজের অন্তরের গভীরতম তাগিদকে প্রকাশ করবার জন্য। 

     অথচ তাগিদ গুলো যখন তদবিরের পাণিগ্ৰহণ করে! তখন গ্ৰহণ আর বর্জনের গোলকধাঁধায় স্রষ্টা বিষ্ঠা ত্যাগ করেন। আমরা যারা কবিতা লিখি কিংবা কবিতা লিখতে চাই এই বিষয়টি খুব দক্ষতার সঙ্গে এড়িয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু পারি কই? পারিনা বলেই চারপাশ হয়ে ওঠে অসত্য, অসুন্দর এবং বিজ্ঞাপিত। ঘটনাক্রমে কত কিছু উঁকি দিয়ে চলে যায়। আবার কত কিছু দগদগে ক্ষত হয়ে থেকে যায়। 

 

কবি রঞ্জিত সিংহের " ব্যাগভর্তি সন্ধ্যাতারা" কাব্যগ্ৰন্থটির পাতা ওল্টাই। 

( প্রকাশকাল- আগষ্ট ২০০৯, প্রকাশক- অস্ট্রিক ) 

 কবিতার চলনে অতীত বর্তমান মিশে এক অদ্ভুত আত্মনিরীক্ষা। ভাষা ও চিত্রকল্পের অবয়বে যেন যাবতীয় নির্বাণ ও নৈকট্য। অনুভূমিক কান্ডের মতো নানা চিত্ররূপ থেকে একটার পর একটা অনুযোগ গড়ে তোলে যে জাদুবাস্তবতা তা অনির্ণেয় অথচ আকাঙ্খিত। তেমনই একটি কবিতার দিকে চোখ রাখলাম----

 "বস্তু থেকে বাস্তব। আমি কি পঞ্চভূত বর্জিত হব?

তখন কি আমি অবাস্তব?

দেওয়ালে টাঙানো হয়তো একটা ছবি অথবা তাও নয়।

 

একদিন রাত্রে যাঁকে দেখেছিলাম, স্বপ্নে না জাগরণে মনে নেই,

তিনি কে? বাস্তব না অবাস্তব কেউ?

মনের ভিতর ঝড়। পঞ্চজ্যোতি চোখে তাঁকে আমি যা দেখেছি,

তাকে অস্বীকার করি কি ক'রে।

শাদা লুঙ্গি, শাদা আলখাল্লা, মাথায় শাদা ফেট্টি,

গাড়ি থেকে নামলেন, চতুর্দিকে তাঁর মণ্ডলাকার দৃষ্টি

ছড়িয়ে আশীর্বাদ করে দ্রুত পদক্ষেপে গাছপালাময়,

যেন একটা ফার্ম হাউস, মুহূর্তে অদৃশ্য।

 

উনি কে? কেউ উত্তর দিল না, শুধু কথাহারা শীতল বাতাসি হাসি।

লোকজন আছে, দেখতে পাচ্ছি, কোথাও তবুও কোনো শব্দ নেই।

 

আমিই-বা এই স্থানের সন্ধান পেলাম কোথা থেকে?

 

টুকরো টুকরো ছড়ানোছিটানো অথচ সুরচিত সরল স্থাপত্য।

লম্বাটে,চৌকো,গোল করুগেটের আচ্ছাদন, মাথার দু-দিকের

ঢাল ছেয়ে গাছপালা, সবুজে সবুজ। বেগুনি, হলুদ, গোলাপি

হরেকরকম ফুল, হরেক রঙের প্রজাপতি।

 

হঠাৎ চোখে পড়ল, মহারাষ্ট্রীয় ভাষায় লিখিত:

'বাবার থান'।

বাবা কে? তারও উত্তর নেই।

প্রধান প্রবেশদ্বারের বাইরে আমাকে কে যেন জোর করে বসিয়ে দিল।

 

আজও বসে আছি। ফটক তো খুলল না।

এ-দিকে যে দিন গড়িয়ে সন্ধ্যার গায়ে।"

 ( বাবা কে?  তারও উত্তর নেই )

    কবিতাটি একাধিকবার শান্ত হয়ে পাঠ করতে করতে অনুভব করলাম প্রতিটি শব্দ যেন যথার্থ, সঠিক অর্থবোধক এবং স্বচ্ছ চেতনাজাত। কবি কী লিখছেন বা লিখবেন এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকলেই কেবল এ কাজ স্বার্থক হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে ‘Album of old verses’ বইতে ভালেরি শব্দের যে পূর্ণ শক্তির কথা উল্লেখ করেছেন, "I feel the full strength of every word for having waited for it"  অর্থাৎ "সেটাই হচ্ছে কবিতার আসল কথা" এই প্রতিভাবনার ক্রমমুক্তি অনায়াসেই ঘটে রজ্ঞিত সিংহের কবিতায়।

   চৈতন্য তীব্র যন্ত্রণাপ্রদ এক অস্তিত্বের নাম। তা সত্ত্বেও চৈতন্য কবির জন্য অপরিহার্য। আর এই চৈতন্যের যতাযথ প্রয়োগের ফলেই অদৃশ্য কিছুও দৃশ্য হয়ে ওঠে। রঞ্জিত সিংহের কবিতায় এই অপরিহার্যতা স্বাভাবিক ও স্বত্যোৎসারিত। 

   আবার চৈতন্য প্রজ্ঞাপ্রদ। কিন্তু সেই প্রজ্ঞা কবিকে জীবনভর যন্ত্রণায় দগ্ধ করে। তাই কবি বলেন, " বস্তু থেকে বাস্তব। আমি কি পঞ্চভূত বর্জিত হব?"

   ভারতীয় দর্শনে পঞ্চভূতের সমষ্টিই এ জগৎ। সে অর্থে মানুষও পঞ্চভূত। ১৩০৩ সালে প্রকাশিত " পঞ্চভূত" প্রবন্ধ গ্ৰন্থে  রবীন্দ্রনাথ এই পাঁচটি উপাদানকে নাম দিয়েছেন ক্ষিতি, স্রোতস্বিনী, দীপ্তি, সমীর ও ব্যোম। এই পাঁচ পাত্রপাত্রী মিলে একটি তর্কসভা গড়ে তুলেছে, যার কেন্দ্রে আছে ভূতনাথ। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। এদের পারস্পরিক তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে বরীন্দ্রনাথ অত্যন্ত সুকৌশলে তার নিজস্ব সহিত্যাদেশ প্রকাশ করেছেন। কবি রঞ্জিত সিংহ আলোচ্য কবিতাটিতে যেন তেমনই এক বার্তাবহ অভিসন্ধির প্রজ্ঞা ফুটিয়ে তুলেছেন।

তারপর একদম অন্তিমে ঘটিয়ে দিয়েছেন ঘটমানের তক্ষণশিল্প।

 "হঠাৎ চোখে পড়ল, মহারাষ্ট্রীয় ভাষায় লিখিত:

'বাবার থান'।

বাবা কে? তারও উত্তর নেই।

প্রধান প্রবেশদ্বারের বাইরে আমাকে কে যেন জোর করে বসিয়ে দিল।

 

আজও বসে আছি। ফটক তো খুলল না।

এ-দিকে যে দিন গড়িয়ে সন্ধ্যার গায়ে।"

   আমি শুধু একাগ্ৰ মনোযোগে এই কবিতার দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু উত্তর পাচ্ছি না। আসলে উত্তর যে প্রত্ত্যুতর হয়ে প্রধান প্রবেশদ্বারের বাইরে আমাকে বসিয়ে রেখেছে। পাঠককে বসিয়ে রেখেছে। তাই

রবীন্দ্রনাথের কথাতেই বলতে ইচ্ছে করছে ‘গড়ের মাঠে এক ছটাক শস্য জন্মে না, তবু অতোটা জমি অনাবশ্যক নহে। আমাদের পাঞ্চ ভৌতিক সভাও আমাদের পাঁচজনের গড়ের মাঠ, এখানে সত্যের শস্য লাভ করিতে আসি না, সত্যের আনন্দ লাভ করিতে মিলি।’ (পঞ্চভূত / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )


1 comment:

Debjani Basu said...

দার্শনিক চিন্তাধারার ধার কবিতাটিকে উজ্জল করেছে।