কবিতার ডালপালা
দ্বিতীয় পর্ব
সংকেতের কথা বলতে গেলেই আমার মাথায় সংকেত প্রক্রিয়াজাতকরণ (ইংরেজি: Signal processing) - এর ভাবনা আসে। তখন বিষয়টি শুধু কবিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এখানে “সংকেত” বলতে বাস্তব বিশ্বের কোন ঘটনার আচরণ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ (যেমন শব্দ, চিত্র,আলো ইত্যাদি) সম্পর্কে তথ্যাদিকে প্রতিনিধিত্বকারী গাণিতিক ফাংশনকে বোঝানো হয়। কিন্তু প্রক্রিয়াজাতকরণ কৌশলগুলি ব্যবহার করে সম্প্রচারিত সংকেতের নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধি, সংকেত সঞ্চয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি, এবং ব্যক্তিমনে সংকেতের মান উন্নয়ন করার প্রচেষ্টায় আমি আবার কবিতার কাছে ছুটে যাই। এই ছুটে যাওয়ার মধ্যেও একটা বিজ্ঞান আছে।কবিতা হলো সেই বিজ্ঞানের অবচেতন। স্পর্ধিত উন্মেষ বীজের নিহিত শক্তির অনিবার্য বিকাশ। এই অনিবার্যতা অবশ্যই মেধার কর্ষিত ভূমির আনুকূল্য চায়। জন্ম নেয় এক সংকেতদ্রষ্টা কবির কাব্যগ্ৰন্থ " জীবনের পাজামা ও গিঁট"।কবির নাম বিল্বমঙ্গল গোস্বামী। বইটির প্রকাশকাল ১ ডিসেম্বর ২০০৮ (প্রকাশক- সমাকৃতি)। নিবাস বিষ্ণুপুর। বছর কয়েক আগে গত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর কবিতার বইটি আমার পড়ার টেবিলে জ্বলজ্বল করছে। যেন এক আশ্চর্য মানস পর্যটন। পরিযায়ী বিহঙ্গের স্বার্থপর বিভ্রমণের থেকে সুদূর সেই পর্যটন। কারণ, সে তো সত্তার যাপিত অযুত জন্মের অতীত থেকে অস্তিত্বের চলমান বর্তমানে, বর্তমানের দুঃসহ অসম্পূর্ণতা থেকে আলোছায়াময় আশ্রয়দাত্রী অতীতে কিংবা স্বপ্নসম্ভব ভবিষ্যতে প্রয়াণ।
"সারাজীবন ধরে একটি মাত্র কবিতাই লিখে এসেছেন আপনি--- আটা দেড় কিলো, চাল দুকেজি, আলু পাঁচশো গ্ৰাম...। রোজ রোজ সকালে লেখা চিরকূট কবিতা আপনার প্রতিদিন সজীব করেছে প্রাণ, সবুজ করেছে দেহ। এইসব জীবন কবিতা লিখে, এইসব জীবনমুখী কবিতা লিখে লিখে আপনি স্বয়ং আজ কবিতা হয়ে গেছেন। এখন আপনার সামনে জীবন্ত দাঁড়ালে মনে হয় হিমালয়ের নীচে আমি এক ছোট্ট দেবদারু। তাই আপনাকে নিয়ে কিছুই লেখা হল না, আমি অক্ষম। আসলে কবিতা নিয়ে কবিতা লেখা অসম্ভব, কবিতার হিমালয় আঁকা যায় না।" ( বাবাকে নিয়ে লেখা )
হয়তো এই কবিতা পাঠ করে পাঠক একটা চিরচেনা ছবির ভিতর নিজেকেও খুঁজে পাবেন। কিন্তু কবি সেই চিরচেনা চিত্রকল্পের ভিতর নিজস্ব স্বরভঙ্গিমার আবহে একটা প্রাণশক্তিকে যেন জারিত করলেন।কাব্যের সেই চরম অনির্বচনীয় রহস্যের প্রতি নয়, বরং কাব্যপ্রবাহের ভাব-সমুন্নতি ও গভীরতার প্রতি। পিতা ও পুত্রের মধ্যে মহাজাগতিক " কবিতা" শব্দটির প্রয়োগ এবং প্রয়োগের বিস্তার আমাকে বারংবার ভাবিয়ে চলেছে। আসলে বিল্লমঙ্গল গোস্বামী কবিতা লেখার জন্য কবিতা লেখেননি। তিনি সব সময় ঘূর্ণনে দাঁড়িয়ে আছেন, অথচ চারপাশ স্থির নিমগ্ন। তাঁর নিমগ্নতার মধ্যেই সম্পর্কের অক্ষমতা মিলেমিশে একাকার। আর এই দুই অক্ষম-মেরুর সংযোগকারী সেতুটি হলো "কবিতা"!
কবিতাটি পড়তে গিয়ে যেমন ভালো লাগছে, তেমন মনখারাপ ঘিরে ধরছে। কেন যে এরকম হচ্ছে আমি নিজেও বুঝে উঠতে পারছি না। যদিও মনখারাপের কারণ খুঁজতে গিয়ে আমি দেখে ফেলছি, কিভাবে কবিরা কবিকে হত্যা করে ! আজ তেমনই এক হত্যা কাহিনীর বিবরণ তুলে ধরবো এই লেখাটিতে। তবে তার আগে আরও একটি কবিতার দিকে চোখ রাখব।
" শোনো, তোমার সঙ্গে কয়েকটা জরুরী কথা আছে।
আমাকে যখন মেঝেতে শুইয়ে রাখবে তখন সাদা কাপড় চাপা দেবে না। আমি সরলভাবে শুয়ে থাকবো মাথা উঁচু করে। প্রয়োজনে দুটো বালিশ দিয়ো। পাশবালিশ দিতে ভুলো না।মাথার পাশে ধূপ জ্বালিও না, খবরদার খেয়াল রেখো, কেউ যেন ভুল করেও ফুল না নিয়ে আসে।যারা আমায় দেখতে আসবে তাদের চোখে যেন বিস্ময় ছাড়া অন্য কিছু না থাকে। একবিন্দু জল গড়িয়ে পড়লে আমার আফশোস হবে। তুমি জানো, একটি মেয়ের একফোঁটা প্রকৃত জলের জন্য আমাকে কত ঘুরে মরতে হয়েছে? চন্দনের ফোঁটা দেবে না। আলতা একদম নয়। আর হ্যাঁ, নাকে যেন তুলো না দেওয়া থাকে; বড্ড বিশ্রী লাগে। সেন্ট দিতে পারো কিন্তু অবশ্যই ফরাসি। আমি বীরের মতো ঘুমবো। সেই সময় ফোন এলে আমাকে ডিসটার্ব করবে না। আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এনজয় করবো-- কার মুখ কতটা ফ্যাকাশে হলো। শোনো, ওরা যেন হরিবোল না বলে। অঞ্জন কিংবা সুমনের গান চালিয়ে দেবে। ওদেরকে বলে দিয়ো ওরা যেন আমায় ন্যাংটো না করে। সারাজীবন এতো বার উলঙ্গ হতে হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। ওই দিনটা অন্তত টিপটপ ফিটফাট থাকতে দিয়ো। হাউমাউ করে কেঁদো না। দরজার পর্দা ধরে চুপি চুপি কাঁদবে সুচিত্রা সেনের মতো। বাঙালি কান্নার মধ্যে একটা শিল্প থাকে। আর একটা কথা, সেই পাগলি মেয়েটি যদি আসে, একমাত্র তাকেই আমার হাত ছুঁতে দেবে। আমার ঠান্ডা হাত এক ঝটকায় উষ্ণ হয়ে যাবে, আর আমি ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে পৌঁছে যাব সঠিক ঠিকানায়... ( ইচ্ছাপত্র )
কবিতার বিবরণখানি অতিক্রম করে অতঃপর আমরা পূর্বাপর পরিকল্পিত অনুমানের তামাশা দেখতে পাই। কবি নিজের জীবন ও জগতের মধ্যে গুঁজে দেন কিছু কৌতুকপ্রদ মর্মরধ্বনি। প্রশ্নাতীতভাবেই এই স্বেচ্ছাচারিতা ক্রমাগত আঁকড়ে ধরে বোধের অর্জন। নিজের সর্বৈব বিনাশটিই যেন প্রেমময় হন্তারকের করতলে তুলে দেন কবি। এই নশ্বর জীবনও যে এক চির-অফুরন্ত নিরন্তরতার সোপান--- এমনই নিবিড় অনুভবে এবং ইচ্ছাপত্রের কৃতাঞ্জলিপুটে কবি আমাদের পৌঁছে দেন সেই সঠিক অনন্যূমেয় ঠিকানায়। বিল্বমঙ্গল যেন এরকম একেরপর এক শব্দদ্যোতনায় লিখে চলেন ইচ্ছামৃত্যুর চিরকূট।
" কতো স্বপ্ন আঁকা হয়
কতো স্বপ্ন মরে যায় উপযুক্ত খাদ্যের অভাবে..." ( ছেঁড়া ভাবনা, টুকরো অনুভূতি )
দীর্ঘ পরিক্রমন শেষে প্রজ্জ্বলন্ত জীবনের উষ্ণতা হারিয়ে কবি দেখে ফেলেন খাদ্য ও খাদকের আত্মভেদী সংকট। আর এই খাদ্য খাদকের জটিল বাস্তুতন্ত্রে ভেসে ওঠে কবি ও কবিতার প্রবৃষ্ট ছায়াযুদ্ধ। তুচ্ছতার বেদনা ছাপিয়ে আত্মহননের অমোঘ নিয়তি।
" একটা মাঝবয়সী বউ, একটি লিকলিকে বাচ্চা
চলে যেতে যেতে কোনোরকমে টিকে যাওয়া একটা চাকরি
একটা ভাঙা গিটার,আর একটা ঢলঢলে পুরোনো পাতলুন
এই আমার কবি জীবন।
সেই পাজামায় মিনিমাম ছত্রিশটা গিঁট। সাঁইত্রিশ
বছর ধরে আমি গিঁট খুলে চলেছি। একটা খুলছি তো
আর একটা লেগে যাচ্ছে। এরকমই এক একটি গিঁটের মাঝে
ছোটো বিজ্ঞাপন, এর মধ্যেই কখনো চুপ করছি কখনও কথা বলছি,
কখনো রাত্রির দুরভাষে বোকামেয়ের সঙ্গে
স্মার্ট কিংবা ন্যাতন্যাতে পঁয়ত্রিশ মিনিট বকমবকম।
এসবের সঙ্গেই একটা দিগন্তখোলা জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে
স্বপ্ন-রোদ-হাওয়া আর বৃষ্টির রিমঝিম অলৌকিক শব্দ।
এই আমার কবিতা লেখা, মরে মরে বেঁচে থাকার অপূর্ব যন্ত্রণা।"
( প্রবেশক কবিতা )
এই কবিতার দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকি। চিন্তাগত অভিব্যক্তির মধ্যে জীবন স্পন্দিত হয়। তীব্রতার সাক্ষাৎ সেখানেই পাই যেখানে অন্য অনেক কিছু রয়েছে। অথচ সবই এমন এক সাক্ষাৎদর্শনের তরঙ্গ-ভঙ্গে সবলে বাহিত হয়ে চলেছে, তাকে মরে মরে বেঁচে থাকার অপূর্ব যন্ত্রণার অপরিহার্য অনুষঙ্গে বেঁধে দিয়েছেন স্বয়ং কবি নিজেই। এলিয়ট বলেছিলেন-- 'Poetry is not a turning loose of emotion...' বিল্বমমঙ্গলের কবিতায় আপাত দৃষ্টিতে আবেগের স্বর বেশি মনে হলেও, সেই আবেগের আবেদন অনায়াস ও কাঙ্ক্ষিত। কবিতার আলো ও আনন্দ প্রকাশের জন্যে কবির যে সর্বোচ্চ সামর্থ্য--- তাকে ছুঁয়ে দেখার বিশ্বাসই যেন এই কবিতার আত্মবিলীন চেতনার রঙে রাঙানো জগৎ। অথচ এই জগতের আড়ালে আবডালে হত্যা লুকিয়ে আছে। আমি সেই হত্যাকে চিনতে পেরেছি। আমার কবিতা লেখা জীবনেও যে এরকম হত্যার অনায়াস যাতায়াত।
কিন্তু কিভাবে তুলে ধরবো সেই কবি বন্ধুর নাম। কষ্ট হচ্ছে। কারণ, বন্ধু কি কখনো হত্যাকারী হয়? বিষয়টা ভাবাচ্ছে! তখন ঘটনাটা লুকিয়ে রাখা মানেই মুখহীন মুখোশের অভিপ্রায়। তাই আমাকে বলতেই হবে।
1 comment:
খুব ভালো পাঠ প্রতিক্রিয়া।
Post a Comment