অরিজিৎ চক্রবর্তী-র
ডারউইনের চিঠি পর্ব~১৯
যত রাতেই ঘুমোক পাঁচটা বাজলেই চোখ খুলে যায় সম্মোহের। তখন চুপচাপ বিছানায় গুটি মেরে শুয়ে থাকতেও ভালো লাগে না। মনে হয় প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার এটাই আসল সময়। তাই সম্মোহ মুখহাত ধুয়ে একটা ঢিলেঢালা পাজামা পরে বেরোনোর প্রস্তুতি নেয়। পাশের খাটে বিকাশ তখন ঘুমে অচেতন। ভাবে বিকাশকে ডেকে তুলবে! পরমুহূর্তেই মনে হয় , গতকাল অত রাত্রে ফিরে বিকাশ হয়তো বড্ড ক্লান্ত। ববং অন্যদিন বিকাশকে ভোর ভোর নিয়ে বেরোবে। এখানকার জঙ্গল দেখাবে। পাখি দেখাবে। আজ বরং থাক। এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সম্মোহ সদোরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে হাঁটা দেয়। জঙ্গলের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে রঘুর চায়ের দোকানের সামনে এসে বাঁশের প্রশস্ত বেঞ্চিতে বসে এক কাপ চা হাতে নিয়ে চা দোকানে জড়ো হওয়া গ্ৰামের লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে থাকে।
----" বাবু কবে ফিরলেন? "
----" গতকাল রাতে। "
----" এখন বেশি রাত করোনি। হাতির দল আইছে। "
---" তাই নাকি!"
----" হ , খুব লফরজফর করছে। ফকিরের ঘর ভেঙে দিয়েছে। ধান খেয়ে দিয়েছ। "
এই চায়ের দোকানে চা খেতে আসার এইটাই সবচেয়ে বড় সুবিধে , গ্ৰামের সমস্ত খবর একনিমেষে পাওয়া যায়!
চা খাওয়া শেষ করে সম্মোহ হাঁটতে হাঁটতে পিচ রাস্তার দিকে এগিয়ে চলে। সকালে এই রাস্তাটায় বরাবরই হাঁটতে পছন্দ করে সম্মোহ। কত ধরনের পাখির ডাক! জঙ্গলের ঠান্ডা বুনো বাতাস। সম্মোহ মনে মনে ভাবে যদি লখা মাছ নিয়ে বসে তাহলে একটু মাছ কিনে বাড়ি ফিরবে। আর সকালের জলখাবারে বুলির মাকে লুচি করতে বলা আছে।
সম্মোহ যখন বাড়ি ফিরলো তখন ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁই ছুঁই। বুলির মাকে মাছের থলেটা দিয়ে বলল, টাকটা মুরলা মাছ পেলাম, জমিয়ে রান্না করো।
বুলির মা মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে। এখন চা করবো? লুচির আলুভাজা করা হয়ে গেছে। ময়দা মেখে রেখেছি।"
---" ঠিক আছে। দাঁড়াও দেখি সে ঘুম থেকে উঠলো কিনা!"
সম্মোহ ঘরে ঢুকে দেখল, বিকাশ তখনও ঘুমোচ্ছে। এই ওঠ, ওঠ রে! এতো ঘুম ভালো নয়!
সম্মোহের ডাকে বিকাশের ঘুম ভাঙ্গলো। হুঁ, উঠছি। আমার বেডটি চাই।
সম্মোহ বুলির মাকে চেঁচিয়ে দু-কাপ লিকার চা করতে বললো। তারপর বিকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, " কিরে আরেকটু ঘুমোতি!"
--- " আরে না না! ভালো ঘুম হয়েছে। এবার চা খেয়ে পটি করে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে নেব। তারপর তোর সঙ্গে জায়গাটা ঘুরতে বেরোব। রাতের অন্ধকারে গভীর জঙ্গল ছাড়া কিছুই বুঝলাম না!"
---" জঙ্গল ছাড়া এখানে কিছু নেই বন্ধু। "
----" কে বলেছে কিছু নেই! মায়া আছে! যে মায়ায় তুই কলকাতা ছাড়লি!"
সম্মোহ বিকাশের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল, জঙ্গলে থাকি সামান্য বালক!"
---" কেয়া বাত! তা বালকের বাল কি পক্ক! "
---- " শালা কি দিচ্ছিস রে সকাল সকাল!"
লালুকাকা চা নিয়ে ঢুকল। সম্মোহ ইশারায় বিকাশের খাটের পাশে টেবিলে চায়ের ট্রে-টা রাখতে বলল।
---- "বিকাশ এই হলো লালুকাকা, আমার ম্যানেজার।"
---" ও আচ্ছা। লালুকাকা তোমার কথা সম্মোহের মুখে অনেকবার শুনেছি..."
লালুকাকা মিটিমিটি হাসে। তারপর রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।
--- " চায়ের ব্যাপারে তোর ফ্যাসিনেশনটা রয়েই গেল! নিশ্চয়ই কলকাতা থেকে নিয়ে আসিস!"
----" হ্যাঁ, কলেজস্ট্রিটের দিকে গেলে সুবোধ ব্রাদার্স থেকে নিয়ে আসি। বিওপি। বার্ডস অরেঞ্জ পিকো। আমার পছন্দের চা।"
---" নে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। ব্রেকফাস্ট সেরে ফুলঝোরের দিকে যাব।"
---" সেটা আবার কোথায়?"
----- " সুতানের কাছের একটা গ্ৰাম। বাইকে যাব। জঙ্গলের রাস্তায় যেতে তোর ভালোই লাগবে।"
বুলির মা'র বানানো গরম গরম লুচি আলুভাজা খেয়ে সম্মোহ বিকাশকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
---- " হেব্বি চালাস তো! তুই একদম পালটে গেছিস। তোকে এভাবে দেখে বড় আনন্দ হচ্ছে রে।"
----" তোর ওরকম মনে হচ্ছে। একই রকম আছি রে। চারপাশের চেনা পরিবেশটা পাল্টেছে। তাই আমাকে তোর অন্যরকম লাগছে!"
----" হয়তো তাই! তবে নিজের চেনা শহুরে গন্ডীর বাইরে এসে বেশ লাগছে রে! থ্যাঙ্কস!"
---- " আবার থ্যাঙ্কস! বোকাচোদা। চল তোকে আজ মহুয়া খাওয়াবো। "
সম্মোহ ক্যানেলের পাড় ধরে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাড়ি ছোটাতে থাকল।
বিকাশ মাঝে মধ্যেই সম্মোহের সঙ্গে কথপোকথন চালাচ্ছিল। মিনিট পনেরো বাদে সম্মোহ গাড়ি থামল ভাঙা অ্যাসভেসটারে ছাওয়া জীর্ণ একটা চা দোকানের সামনে। চা দোকানের পাশেই একটা কামারশাল। হাপরের মুখ দিয়ে গলগল করে হাওয়া বেরুচ্ছিল। কাঠ কয়লার মধ্যে ফোঁস ফোঁসানি শব্দ। খানিকটা কয়লা টকটকে লাল রঙ ধরেছে। তারমধ্যে কয়েকটা লোহার রড। কোনটা মোটা কোনটা সরু।আগুনে ঢোকানো দিকটা আর আগুনের রঙ থেকে আলাদা করা যায় না। প্রতিবার হাপর থেকে বেরুনো হাওয়া সাদা ছাই উড়িয়ে দিচ্ছে আগুনের মধ্য থেকে। ধলু বাঁ হাতে একটা বড় সাঁড়াশি দিয়ে একটা লোহার রড টেনে বের করলো।পোড়া দিকটা বড় একটা লোহার পিন্ডের উপর চেপে ধরে অন্য হাতে হাতুড়ি উঁচিয়ে জোরে আঘাত করল।টং। মুখোমুখি নিশিকান্ত একটা কাঠের উঁচু পিঁড়ির উপর বসে দুদিকে পা ছড়িয়ে দিয়ে দু'হাতে একটা ভারী হাতুড়ি উঁচিয়ে দড়াম করে মারল---টাং। টং টাং।হাতুড়ির ঘায়ে দেখতে দেখতে জ্বলন্ত পিন্ডটা সারস পাখির লম্বা ঠোঁটের মতো বাঁকা আকার নেয়।
--- ধলু, এটা কি বানাচ্ছো গো?"
------" বাবু গাঁইতি হবে! তা অনেকদিন পরে এলেন এদিকে ! তা একটু চা গান বাবু!"
----" চা খাবনা। মহুয়া চাই। আমার বন্ধু কলকাতা থেকে এসেছে। ওকে বুনো মহুয়া খাওয়াবো ভাবছি! ব্যাবস্থা হবে?"
----" তা আবার হবেনি! কি যে বলেন!"