Thursday, December 31, 2020

১-লাইনের কবিতা সংখ্যা≈ ফাহাদ হোসেন ফাহিম

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||     

ফাহাদ হোসেন ফাহিম 

কবির তুমি এক

কত কবিতা আর, লিখলে হবে তুমি আমার! 


 কবির উন্মলন

পারাবার কিংবা আকাশ, কিছুই না, শুধু তোমাতেই খুঁজি প্রকাশ। 


 সংসর্গ

কিংকর্তব্যবিমূঢ় কবিতারা; সংসর্গ, তোমার সংসর্গ ছাড়া। 


আহ্বান

নবীন এসো, এ মন নম, এসো, এ নবীন। 


তুমিময়

তুমিই জীবনের আলপনা, নিউরনের সমস্ত কল্পনা। 


 অসুখ পাখি

কাঁদে হিয়া, কিন্তু ভেজে না দু'চোখ, মনটাতে সংক্রমিত তীব্র অসুখ। 


নিঃসঙ্গতা

থাকি কিথা? নবকণ্ঠকবন, নিঃসঙ্গতায় কাঁটে জীবন।


 আশ্রয়

সেদিনের তুমি, বেঁচে থাকার ভূমি, এই বৃক্ষ তরে। 


রাজকন্যা ও কান্না

গল্পে তুমি রাজকন্যা অথচ কবিতায় আমার চোখের বন্যা। 


 নিঃসঙ্গ নগ্ন রাত

নিঃসঙ্গ নগ্ন রাত, তবুও খুঁজি তোমায়, তোমাতেই অজুহাত। 

 

Thursday, December 24, 2020

তাস কবিতা-র ফর্ম :: অনিন্দ্য রায়

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||

আজকের তাস কবিতা-র ফর্ম নিয়ে আবার এই বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করছি সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন থেকে, কারণ এই সংখ্যায় প্রকাশিত ফর্ম নিয়ে আগামী জানুয়ারি (২০২১) মাসে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করবো।তাই সকলে পড়তে থাকুন, আর লিখতে থাকুন।

তাসকবিতা অনিন্দ্য রায়

তিনটি তাসের খেলা, তিনতাস, তিনপাত্তি

 

মুখোমুখি দুজন, বেটে নেওয়ার পর প্রত্যেকের হাতে তিনটি করে তাস

প্রথমজন একটি তাস ফেলে, উত্তরে বিপক্ষ একটি

আবার প্রথমজন একটি, বিপক্ষ একটি

আবার প্রথমজন একটি, বিপক্ষ শেষেরটি

দুজনের তাসের মান অনুসারে ফলাফল

 

এই তো খেলা

 

আর এভাবেই তাসের কবিতা, তিনপাত্তি

কবি একটি পঙ্ক্তি লেখেন

পরের পঙ্ক্তি লেখেন প্রথমটির বিপরীত ভাবনায়।

দুটি পঙ্ক্তি মিলে একটি স্তবক

প্রথম পঙ্ক্তি হতে পারে কোনও প্রশ্ন, দ্বিতীয়টি তার উত্তর

আবার প্রথমটিতে কোনও প্রস্তাব, দ্বিতীয়টিতে তার প্রতিক্রিয়া এইভাবে থিসিস-অ্যান্টিথিসিস, ভাবনা-প্রতিভাবনা, দৃশ্য-বিম্ব এইরকম বৈপরীত্যে লিখিত হবে পঙ্ক্তিদুটি।

একই নিয়মে আরও দুটি স্তবক।

 

তিনপাত্তি:

মোট ৬ লাইনের, ৩ স্তবকের কবিতা

লাইনগুলির শব্দসংখ্যা তেরো বা তেরোর কম হবে 

অন্ত্যমিল থাকতে পারে, না থাকতেও পারে। 

শিরোনাম থাকবে, যা হবে ভাবনাদুটির সিনথেসিস।

Tuesday, December 22, 2020

| অনুবাদ সংখ্যা | মলয় রায়চৌধুরীর |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||

আরনেস্তো কারদেনাল সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। তাঁর কবিতা জীবনের প্রথম অংশে জীবন ও প্রেম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। পরবর্তী অংশে তাঁর কবিতায় ভীষণভাবে বিজ্ঞান ও বিবর্তনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়

আজ আরনেস্তো কারদেনাল-এর কবিতা কবিতার অনুবাদ, নিয়ে কবি মলয় রায়চৌধুরী, সঙ্গে সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন


মেরিলিন মনরোর জন্য প্রার্থনা

প্রভু :

পৃথিবীতে মারিলিন মনরো নামে পরিচিত এই বালিকাটিকে গ্রহণ করুন

যদিও তা ওর প্রকৃত নাম নয়

( কিন্তু আপনি মেয়েটির প্রকৃত নাম জানেন : অনাথ মেয়ে ৯ বছর বয়সে ধর্ষিত 

দোকানের কর্মচারী মেয়ে যে ১৬ বছর বয়সে নিজের জীবন শেষ করে দিতে চেয়েছিল )

যে এখন আপনার সামনে নিজেকে তুলে ধরছে কোনো সাজগোজ না করে

কোনো কাগজের দালাল সঙ্গে নেই

কোনো ফোটোগ্রাফার নেই অটোগ্রাফ সইয়ের ব্যাপার নেই,

নভোচরের মতন একা রাত্রির মুখোমুখি যার নাম মহাকাশ ।

বালিকা হিসাবে, মেয়েটি গির্জায় নগ্ন থাকার স্বপ্ন দেখেছিল (  টাইম ম্যাগাজিন যেমন বলে )

সাষ্টাঙ্গ জনগণের সামনে, মেঝেতে মাথা পেতে,

আর ওকে পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে হাঁটতে হচ্ছিল যাতে তাদের মাথায় না পা রাখতে হয়।

মনোবিদদের চেয়ে ভালো আপনি এই স্বপ্নগুলো সম্পর্কে ভালো জানেন ।

গির্জা, বাসা, গুহা হলো মায়ের বুকের মতন সুরক্ষিত

কিন্তু তার চেয়েও বেশি…

মাথাগুলো মেয়েটির ভক্ত, তা পরিষ্কার

( আলোর এক স্রোতের তলায় অন্ধকারে মাথার জমঘট )।

কিন্তু মন্দিরটা তো টোয়ান্টিয়েথ সেঞ্চুরি-ফক্স স্টুডিও নয় ।

মন্দির -- শ্বেতপাথর আর সোনায় -- মেয়েটির দেহের মন্দির

যেখানে মানবপুত্র, চাবুক হাতে,

টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি-ফক্স ব্যাবসাদারদের তাড়ায় ।

যারা আপনার প্রার্থনার বাড়িকে চোরেদের গুহায় বদলে দিয়েছে।


প্রভু :

এই জগত কি পাপ আর বিকিরণে দূষিত,

আপনি দোকানের কর্মচারী মেয়েটিকে কেবল দোষ দিতে পারেন না

যে, আর সমস্ত দোকানের কর্মচারী মেয়েদের মতন, তারকা হবার স্বপ্ন দেখেছিল।

আর ওর স্বপ্ন ছিল বাস্তব ( কিন্তু যেমন টেকনিকালারও বাস্তব )।

মেয়েটি কেবল আমাদের দেয়া স্ক্রিপ্ট অভিনয় করেছিল,

যা আমাদের নিজেদের জীবন, এক অদ্ভুত স্ক্রিপ্ট ।

মেয়েটিকে ক্ষমা করুন, প্রভু, আর আমাদের ক্ষমা করুন

আমাদের বিশ শতকের জন্য

বিশাল অতি-উৎপাদনের জন্য যাতে আমরা সবাই খেটেছি।

মেয়েটি ভালোবাসা পেতে চেয়েছিল আর আমরা দিয়েছি ঘুমের ওষুধ।

যে দুঃখের জন্য আমরা কেউই পবিত্র নই

মেয়েটিকে মনোবিদ দেখাবার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল।

মনে করুন প্রভু ক্যামেরা সম্পর্কে মেয়েটির বৃদ্ধিপ্রাপ্ত আতঙ্ক

সাজগোজকে ঘৃণা, প্রতিটি দৃশ্যের জন্য তাকে নতুন করে তোলার জন্য দাবি

আর কেমন করে আতঙ্ক বেড়ে যেতে লাগলো

আর স্টুডিওতে অনেক দেরিতে পৌঁছোনো ।

দোকানের কর্মচারী মেয়েদেরর মতন

মেয়েটি তারকা হবার স্বপ্ন দেখেছিল ।

আর মেয়েতির জীবন ছিল অবাস্তব, স্বপ্ন যা মনোবিদ ব্যাখ্যা করে আর নথি করে রাখে।

মেয়েটির রোমান্স ছিল দুই চোখ বন্ধ করে চুমু খাওয়া

কিন্তু তারপর চোখ খুলে যায়

আর আবিষ্কার করে প্রচুর আলো ওর দিকে মুখ করা

তারপর আলোগুলো অন্ধকার হয়ে যায় !

আর লোকেরা ঘরের দুটো দেয়াল ভেঙে ফ্যালে ( তা ছিল ফিল্মের সেট )

পরিচালক নিজের নোটবই নিয়ে চলে যান

কেননা দৃশ্যটা তোলা হয়ে গেছে ।

কিংবা প্রমোদভ্রমণের পোতে, সিঙ্গাপুরে একটা চুমু, রিওতে নাচ

উইন্ডসর প্রাসাদে ডিউক ও ডাচেসের অভ্যর্থনা

এক মর্মন্তুদ ফ্ল্যাটের ছোটো বৈঠকখানায় দেখা ।

শেষ চুমু ছাড়াই ফিল্মটি শেষ হয় ।

ওরা মেয়েটিকে তার বিচানায় মৃত পেলো, হাতে ফোন ।

আর গোয়েন্দারা জানতে পারেনি কাকে মেয়েটি ডাকছিল ।

তা ছিল

সেইরকম যে বন্ধু কন্ঠস্বরকে চেনে তাকে ফোন করতে চাইছিল

কেবল রেকর্ড করা কন্ঠস্বর শোনার জন্য যা বলবে : রং নাম্বার

কিংবা কারোর মতন, যে, ডাকাতদের দ্বারা ঘায়েল

তার ছেঁড়া ফোনের দিকে হাত বাড়ায় ।

প্রভু :

কাকে ডাকার চেষ্টা মেয়েটি করেছিল তাতে কিছুই আসে-যায় না

কিন্তু পারেনি ( আর হবতো তা কেউ ছিল না

কিংবা কেউ যার নাম্বার লস অ্যাঞ্জেলেস ফোনের বইতে নেই ।


আপনিই ফোনের জবাব দিন !









রাফায়েল হেলিওদোরো ভালে-র জন্য

দক্ষিণের সমুদ্র


তেইশে মার্চ আমি আকাপুলকো বন্দর থেকে যাত্রা করেছিলুম

আর শনিবার পর্যন্ত যাত্রাপথ নিয়ত রেখেছিলুম, চৌঠা এপ্রিল, যখন

ভোর হবার আধ ঘণ্টা আগে, আমরা চাঁদের আলোব দেখলুম

পাশাপাশি একটা জাহাজ এসেছে

যার পাল আর সামনে দিক রুপোর তৈরি ।

আমাদের কাণ্ডারী ওদের দিকে চেঁচিয়ে বলল দূরে থাকতে

কিন্তু কেউই উত্তর দিল না, যেন ওরা সবাই ঘুমোচ্ছিল ।

আবার আমরা হাঁক পাড়লুম : “কোথা থেকে তোদের জাহাজ আসছে ?”

আর ওরা বলল : পেরু !

তারপর আমরা ভেরীধ্বনি শুনলুম, আর বন্দুক চালাবার শব্দ,

আর ওরা আমাকে নির্দেশ দিলো ওদের জাহাজে যেতে

যেখানে ওদের ক্যাপ্টেন ছিল সেখানে ।

আমি দেখলুম উনি ডেকে পায়চারি করছেন,

ওনার কাছে গিয়ে, হাতে চুমু খেলুম আর উনি জিগ্যেস করলেন:

“ওই জাহাজে কতো রুপো আর সোনা আছে ?”

আমি বললুম, “কিছুই নেই,

কিচুই নেই, স্যার, কেবল আমার ডিশগুলো আর পেয়ালাগুলো।”

তখন উনি জিগ্যেস করলেন আমি ভাইসরয়কে চিনি কিনা ।

আমি বললুম, চিনি । আর ক্যাপ্টেনকে জিগ্যেস করলুম,

“উনি কি ক্যাপ্টেন ড্রেক নিজেই অন্য কেউ নন তো ?”

ক্যাপ্টেন জবাবে বললেন

“উনিই ক্যাপ্টেন ড্রেক যার বিষয়ে আমি বলছি।”

আমার অনেকক্ষণ কথা বললুম, রাতের ভোজনের সময় পর্যন্ত,

আর উনি নির্দেশ দিলেন আমি যেন ওনার পাশে বসি।

ওনার থালাগুলো রুপোর আর তারা কিনারায় সোনা

তাতে ওনার চিহ্ণ ।

স্ফটিকের শিশিতে ওনার রয়েছে বহু গন্ধদ্রব্য আর সুগন্ধী জল

যা, উনি বললেন, রানি ওনাকে দিয়েছেন ।

উনি সন্ধ্যা আর রাত্রির ভোজন সর্বদা বেহালার সঙ্গীতের সাথে সম্পন্ন করেন

আর নিজের সঙ্গে সর্বত্র চিত্রকরদের  নিয়ে যান যাঁরা আঁকতে থাকেন

তাঁর জন্য সমুদ্রতীরগুলো ।

উনি চব্বিশ বছর বয়সী, ছোটোখাটো, লাল দাড়ি ।

উনি হুয়ান অ্যাকুইনা, বিখ্যাত জলদস্যুর ভাগ্নে ।

আর উনি সমুদ্রের ওপরে যতো খ্যাতনামা নাবিক আছেন তার অন্যতম ।

পরের দিন, যা ছিল রবিবার, উনি অসাধারণ পোশাকে নিজেকে সুসজ্জিত করলেন 

আর ওদের দিয়ে পতাকা উত্তোলন করালেন

মাস্তুলের মাথায় ডুবুরি রঙের ছোটো পতাকা উড়িয়ে,

পেতলের আংটি, আর শেকল আর রেলিঙ আর

আলকাজারের আলো সোনার মতন জ্বলজ্বল করছিল ।

ওনার জাহাজ ছিল যেন শুশুকদের মাঝে সোনার ড্র্যাগন ।

আর উনি চলে এলেন, ওনার কাগজ নিয়ে, আমার অর্থ-ভাঁড়ার দেখতে ।

রাত্রির আগে পর্যন্ত সারা দিন আমার কি আছে তা দেখলেন
আমার থেকে যা নিলেন তা বিশেষ কিছু নয়,

আমার নিজের কিছু ছোটোখাটো জিনিস,

আর আমাকে দিলেন একটা ছোরা আর ওদের জন্য একটা রুপোর হাতল

আমায় অনুরোধ করলেন ওনাকে ক্ষমা করে দিতে

কেননা ওগুলো উনি ওনার মহিলার জন্য নিয়েছিলেন :

উনি আমাকে যেতে দেবেন, উনি বললেন, পরের দিন সকালে, বাতাস আরম্ভ হতেই ;

তার জন্য আমি ওনাকে ধন্যবাদ জানালুম, আর ওনার হাতে চুমু খেলুম।

উনি নিয়ে যাচ্ছেন, ওনার জাহাজে, তিন হাজার রুপোর বাট

তিনটে ভাঁড়ার সোনায় ভরা

বারোটা ভাঁড়ার আটটা করে ভাগ করা :

আর উনি বললেন উনি চীনের উদ্দেশে যাত্রা করছেন

সামুদ্রিক মানচিত্র অনুসরণ করে একজন চীনা চালকের পরিচালনায় যাকে উনি বন্দী করেছেন…


নীল উড়োজাহাজের জানালা দিয়ে দেখা দৃশ্য


            এক গোল ছোটো জানালায়, সবই নীল,

জমি নীলাভ, নীল-সবুজ, নীল

                               ( আর আকাশ )

              সবই নীল

নীল ঝিল আর জলাশয়

                    নীল আগ্নেয়গিরি

            অনেক দূরের জমিগুলো আরও নীল দেখায়

         নীল দ্বীপ নীল ঝিলের মাঝে ।

এটা মুক্ত করা দেশের মুখ।

আর যেখানে সব জনগণ যুদ্ধ করেছিল, আমার মনে হয় :

                                           ভালোবাসার জন্য !

শোষণের ঘৃণা ছাড়া

                             বাঁচবার জন্য ।

এক সুন্দর দেশে একে আরেককে ভালোবাসার জন্য

এতো সুন্দর, কেবল নিজেই নয়

                        কিন্তু তার অধিবাসীদের জন্য,

সবার ওপরে তার অধিবাসীদের জন্য ।

ঈশ্বর সেই জন্যে এই সুন্দর দেশ আমাদের দিয়েছেন

তার অন্তর্গত সমাজের জন্য ।

আর যে নীল জায়গাগুলোয় তারা লড়েছিল, যন্ত্রণা ভোগ করেছিল

                  এক ভালোবাসার সমাজের জন্য

                          এখানে এই দেশে ।


একটা নীল টুকরো অনেক বেশি গাঢ় দেখায়…

আর আমি ভাবলুম আমি সেখানে সব কয়টা লড়াইয়ের জায়গা দেখতে পাচ্ছি,

আর সমস্ত মৃত্যুর,

ওই ছোটো গোল জানালার কাচের পেছনে

                                      নীল

                              যতো রকমের নীল হয় ।



Monday, December 21, 2020

| নভেলেট | ডারউইনের চিঠি |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||     
| নভেলেট | 
ডারউইনের চিঠি ( পর্ব- ১ )

অরিজিৎ চক্রবর্তী

এই এক সমস্যা সম্মোহের। যেকোন কিছুর সঙ্গে এতকিছু রিলেট করে ফেলে! তলিয়ে ভাবতে গিয়ে কখনো কখনো তলানিতে গিয়ে ঠেকে সবকিছু। তখন ক্লান্তি অনুভব হয়। মাথা টনটন করে। সিগারেটের পরিমাণটা বেড়ে যায়। ছবি আঁকতেও ইচ্ছে করে না। পুরনো কাজের দিকে তাকিয়ে মনে হয় কিছুই হয়নি। রঙ তুলির মৌতাত গড়ে ওঠেনি এখনো। কলকাতা ছেড়ে এই গভীর জঙ্গলে চলে আসার সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে যায় মাঝে মধ্যে। আবার ভাবে এটাই হয়তো তার জীবনের ভবিতব্য! অরুণদা বুঝিয়েছিল চেনা লোকজন চেনা মহল্লা ছেড়ে একেবারে শিকড় উপড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক একবার ভেবে দেখতে। সম্মোহ ভাবেনি। জীবনের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে খুব একটা ভাবেনি কখনো। বরং ভাবনাকে ভাসিয়ে দিয়েছে আপন খেয়ালে। বিয়ে না করে নিজের মতো বাউন্ডুলে জীবন কাটিয়ে আজ কতটা সুখী সে? নাকি এই সুখের ভেতরে অসুখ বাসা বেঁধেছে।
মাঝে মাঝে কিছুই আর ভালো লাগে না। বড় একা লাগে। ট্যুরিস্ট বেড়াতে আসে। কখনো পূর্ব পরিচিত। কখনো একেবারেই অচেনা। তাদের সঙ্গে আলাপ হয়। আড্ডা হয়। ভালো লাগে। আবার নিজের থেকে কম বয়সী কাপেল দেখলে চোরা ঈর্ষা তৈরি হয় মনের ভেতর। যৌনতা বায়না করে। ডাক দেয়। সম্মোহ আড় চোখে তাকিয়ে দেখে তাদের উষ্ণতা! শিৎকার! চুম্বন! ভাবে কদিনের জন্য কোথায় ঘুরে আসবে। তারপর একদিন লালুকাকাকে দায়িত্ব দিয়ে চলে আসে কলকাতায়।

সেই চেনা শহর। চেনা জীবন। বাল্যকাল। ক্যালকাটা বয়েজ। কলেজস্ট্রিট।গ্লোব সিনেমা। গড়ের মাঠ। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে মোলাকাত। তর্ক। ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান।সব যেন একসঙ্গে ঘিরে ধরে সম্মোহকে। কিন্তু এই ভালোলাগা আবার মন্দ লাগার দিকে এগিয়ে যায়। মনে হয় কবে বাঁকুড়ায় ফিরবে আবার!

বিচিত্র এই জীবন। জীবনের মায়া। কলকাতা কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির নিজস্বতা। মূল্যবোধ। টাকা! আরো টাকা! আরো স্বপ্ন! শপিং মল! মাল্টিপ্লেক্স! পপকর্ণ! স্পা!

আর সম্মোহ এসবের থেকে আলাদা! জেনারেশন গ্যাপ? মোটেও না। সম্মোহ যথেস্ট আপডেট। এবয়সেও বান্ধবী আছে। যৌনতা আছে। আছে সিগ্ধ জীবনবোধ!

আজ সুখেন গড়াইয়ের শ্রাদ্ধের নেমতন্ন। যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও যেতে হচ্ছে। কোতলপুরের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। অমায়িক ব্যবহার। জোর হাত ছাড়া কথা বলেন না। মুখে বিশুদ্ধ হাসি। দুটো রাইসমিলের মালিক। বিঘে বিঘে জমি। দুটো মদের দোকান। একটা পেট্রোল পাম্প। সেই সুখেন গরাইয়ের শ্রাদ্ধে আজ যেতে হচ্ছে। ওঁর স্ত্রী ও ছেলেরা অনেক করে বলেছে।সম্মোহ এড়াতে পারেনি। সুখেনদার সঙ্গে সম্পর্ক টা দীর্ঘ দিনের না হলেও বছর পাঁচেক হবে। ভায়ের মতো স্নেহ করতেন। খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন। এই শৌখিন শব্দটা মনে পড়তেই সম্মোহ বিডন স্ট্রিট থেকে নিউমার্কেটের দিকে গাড়িটা ঘোরালো। সুভদ্রা নার্সারি। প্রায় সত্তর আশি বছরের দোকান। চমৎকার বোকে বানায় এরা।সুখেনদার জন্য একটা ভালো বোকে আর মালা কিনতে হবে। সঙ্গে একটু মিষ্টি।

নিউমার্কেটে গাড়িটা পার্ক করিয়ে সম্মোহ সুভদ্রা নার্সারির দিকে এগিয়ে গেল।

---" কেমন আছিস রে?" ভীড়ের মধ্যে কেউ বলে উঠলো।

সম্মোহ প্রথমটায় ঠিক বুঝতে পারলো না, কে কার উদ্দেশ্যে এই কথা বলল।

--" কিরে? কানে কম শুনছিস আজকাল!"

সম্মোহ অন্যমনস্কতা কাটিয়ে তাকিয়ে দেখে বিকাশ!

---" তুই!"

---" বোকাচোদা তুই!"

---"শালা। একই ধাঁচের রয়ে গেলি!"

--- " হঠাৎ কি গাঁড়মারাতে?"

---" চুপ শালা! বুড়ো বয়সেও শুধরালি না!"

---" চল, চা খাই।"

---" চল।"

----"তিন বছর ধরে বানানোর পরে অবশেষে ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি ইউরোপীয় জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হল নতুন বাজারের দরজা। কিন্তু বাজার তো হল। এর নাম কী রাখা হবে? কলকাতা কর্পোরেশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান স্টুয়ার্ট হগের নামে বাজারের নামকরণ করা হল, ‘স্টুয়ার্ট হগ মার্কেট’। কারণ নতুন বাজার তৈরির পিছনে তাঁর উদ্যোগ ছিল সবথেকে বেশি।"

---" আবার! আবার শুরু করলি! সেই পুরনো অভ্যেস!"

বিকাশ হোহো করে হেসে ওঠে।সম্মোহ চা দোকানিকে দুটো বড় ভাঁড়ের চা দিতে বলে।গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে চলে আসে অতীতের কথা। ছেলেবেলার বন্ধুত্ব এমনই হয়! ভালোলাগা আর ভালোবাসার উষ্ণতা থাকে। হঠাৎ সম্মোহের খেয়াল হয় সুখের গরাইয়ের শ্রাদ্ধের নেমতন্নর কথা। মালা,বোকে আর মিষ্টি নেবার কথা।

---" শোন, আজ তাড়া আছে। তোর মোবাইল নং টা দে। রাতে কথা হবে।"

---" কেন রে এত তাড়াহুড়ো কিসের? প্রায় দশ বছর পর দেখা হলো। চল, আমার বাড়িতে চল। আজ আমার কাছেই থেকে যাবি।"

---" আজ হবে না। রাগ করিস না। একটা শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে যেতেই হবে। অনেক করে বলেছে। না গেলে ভালো দেখাবে না।"

---" কার শ্রাদ্ধ রে?"

---" তুই চিনবি না। আমাদের বাঁকুড়ায় থাকেন ভদ্রলোক। সম্প্রতি গত হয়েছেন।"

----" আমাদের বাঁকুড়া! মানে?"

----" সে অনেক কথা। তোকে রাতে বলবো।"

সম্মোহ বিকাশের উৎসাহে ভাটা টেনে সুভদ্রা নার্সারির দিকে এগিয়ে গেল। পাশে বিকাশ পা মেলাল।

---" শোন তোকে রাতে ফোন করছি। কথা হবে। আর তোর বাড়ি অবশ্যই যাচ্ছি না। শেফালীর হাতে চিতল মাছের মুইঠা খাব।"

---" শেফালী নেই রে! গতবছর ক্যানসারে মারা গেছে!"

সম্মোহ চমকে উঠল। মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বিকাশের হাতটা চেপে ধরলো। বিকাশের হাতের মুঠোয় মনে হলো কোনো স্নায়ুকোষ নেই।শিরা উপশিরা নেই। কেবল হলদে রঙের অবুঝ শূন্যতা আছে।