Monday, December 21, 2020

| নভেলেট | ডারউইনের চিঠি |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||     
| নভেলেট | 
ডারউইনের চিঠি ( পর্ব- ১ )

অরিজিৎ চক্রবর্তী

এই এক সমস্যা সম্মোহের। যেকোন কিছুর সঙ্গে এতকিছু রিলেট করে ফেলে! তলিয়ে ভাবতে গিয়ে কখনো কখনো তলানিতে গিয়ে ঠেকে সবকিছু। তখন ক্লান্তি অনুভব হয়। মাথা টনটন করে। সিগারেটের পরিমাণটা বেড়ে যায়। ছবি আঁকতেও ইচ্ছে করে না। পুরনো কাজের দিকে তাকিয়ে মনে হয় কিছুই হয়নি। রঙ তুলির মৌতাত গড়ে ওঠেনি এখনো। কলকাতা ছেড়ে এই গভীর জঙ্গলে চলে আসার সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে যায় মাঝে মধ্যে। আবার ভাবে এটাই হয়তো তার জীবনের ভবিতব্য! অরুণদা বুঝিয়েছিল চেনা লোকজন চেনা মহল্লা ছেড়ে একেবারে শিকড় উপড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক একবার ভেবে দেখতে। সম্মোহ ভাবেনি। জীবনের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে খুব একটা ভাবেনি কখনো। বরং ভাবনাকে ভাসিয়ে দিয়েছে আপন খেয়ালে। বিয়ে না করে নিজের মতো বাউন্ডুলে জীবন কাটিয়ে আজ কতটা সুখী সে? নাকি এই সুখের ভেতরে অসুখ বাসা বেঁধেছে।
মাঝে মাঝে কিছুই আর ভালো লাগে না। বড় একা লাগে। ট্যুরিস্ট বেড়াতে আসে। কখনো পূর্ব পরিচিত। কখনো একেবারেই অচেনা। তাদের সঙ্গে আলাপ হয়। আড্ডা হয়। ভালো লাগে। আবার নিজের থেকে কম বয়সী কাপেল দেখলে চোরা ঈর্ষা তৈরি হয় মনের ভেতর। যৌনতা বায়না করে। ডাক দেয়। সম্মোহ আড় চোখে তাকিয়ে দেখে তাদের উষ্ণতা! শিৎকার! চুম্বন! ভাবে কদিনের জন্য কোথায় ঘুরে আসবে। তারপর একদিন লালুকাকাকে দায়িত্ব দিয়ে চলে আসে কলকাতায়।

সেই চেনা শহর। চেনা জীবন। বাল্যকাল। ক্যালকাটা বয়েজ। কলেজস্ট্রিট।গ্লোব সিনেমা। গড়ের মাঠ। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে মোলাকাত। তর্ক। ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান।সব যেন একসঙ্গে ঘিরে ধরে সম্মোহকে। কিন্তু এই ভালোলাগা আবার মন্দ লাগার দিকে এগিয়ে যায়। মনে হয় কবে বাঁকুড়ায় ফিরবে আবার!

বিচিত্র এই জীবন। জীবনের মায়া। কলকাতা কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির নিজস্বতা। মূল্যবোধ। টাকা! আরো টাকা! আরো স্বপ্ন! শপিং মল! মাল্টিপ্লেক্স! পপকর্ণ! স্পা!

আর সম্মোহ এসবের থেকে আলাদা! জেনারেশন গ্যাপ? মোটেও না। সম্মোহ যথেস্ট আপডেট। এবয়সেও বান্ধবী আছে। যৌনতা আছে। আছে সিগ্ধ জীবনবোধ!

আজ সুখেন গড়াইয়ের শ্রাদ্ধের নেমতন্ন। যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও যেতে হচ্ছে। কোতলপুরের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। অমায়িক ব্যবহার। জোর হাত ছাড়া কথা বলেন না। মুখে বিশুদ্ধ হাসি। দুটো রাইসমিলের মালিক। বিঘে বিঘে জমি। দুটো মদের দোকান। একটা পেট্রোল পাম্প। সেই সুখেন গরাইয়ের শ্রাদ্ধে আজ যেতে হচ্ছে। ওঁর স্ত্রী ও ছেলেরা অনেক করে বলেছে।সম্মোহ এড়াতে পারেনি। সুখেনদার সঙ্গে সম্পর্ক টা দীর্ঘ দিনের না হলেও বছর পাঁচেক হবে। ভায়ের মতো স্নেহ করতেন। খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন। এই শৌখিন শব্দটা মনে পড়তেই সম্মোহ বিডন স্ট্রিট থেকে নিউমার্কেটের দিকে গাড়িটা ঘোরালো। সুভদ্রা নার্সারি। প্রায় সত্তর আশি বছরের দোকান। চমৎকার বোকে বানায় এরা।সুখেনদার জন্য একটা ভালো বোকে আর মালা কিনতে হবে। সঙ্গে একটু মিষ্টি।

নিউমার্কেটে গাড়িটা পার্ক করিয়ে সম্মোহ সুভদ্রা নার্সারির দিকে এগিয়ে গেল।

---" কেমন আছিস রে?" ভীড়ের মধ্যে কেউ বলে উঠলো।

সম্মোহ প্রথমটায় ঠিক বুঝতে পারলো না, কে কার উদ্দেশ্যে এই কথা বলল।

--" কিরে? কানে কম শুনছিস আজকাল!"

সম্মোহ অন্যমনস্কতা কাটিয়ে তাকিয়ে দেখে বিকাশ!

---" তুই!"

---" বোকাচোদা তুই!"

---"শালা। একই ধাঁচের রয়ে গেলি!"

--- " হঠাৎ কি গাঁড়মারাতে?"

---" চুপ শালা! বুড়ো বয়সেও শুধরালি না!"

---" চল, চা খাই।"

---" চল।"

----"তিন বছর ধরে বানানোর পরে অবশেষে ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি ইউরোপীয় জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হল নতুন বাজারের দরজা। কিন্তু বাজার তো হল। এর নাম কী রাখা হবে? কলকাতা কর্পোরেশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান স্টুয়ার্ট হগের নামে বাজারের নামকরণ করা হল, ‘স্টুয়ার্ট হগ মার্কেট’। কারণ নতুন বাজার তৈরির পিছনে তাঁর উদ্যোগ ছিল সবথেকে বেশি।"

---" আবার! আবার শুরু করলি! সেই পুরনো অভ্যেস!"

বিকাশ হোহো করে হেসে ওঠে।সম্মোহ চা দোকানিকে দুটো বড় ভাঁড়ের চা দিতে বলে।গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে চলে আসে অতীতের কথা। ছেলেবেলার বন্ধুত্ব এমনই হয়! ভালোলাগা আর ভালোবাসার উষ্ণতা থাকে। হঠাৎ সম্মোহের খেয়াল হয় সুখের গরাইয়ের শ্রাদ্ধের নেমতন্নর কথা। মালা,বোকে আর মিষ্টি নেবার কথা।

---" শোন, আজ তাড়া আছে। তোর মোবাইল নং টা দে। রাতে কথা হবে।"

---" কেন রে এত তাড়াহুড়ো কিসের? প্রায় দশ বছর পর দেখা হলো। চল, আমার বাড়িতে চল। আজ আমার কাছেই থেকে যাবি।"

---" আজ হবে না। রাগ করিস না। একটা শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে যেতেই হবে। অনেক করে বলেছে। না গেলে ভালো দেখাবে না।"

---" কার শ্রাদ্ধ রে?"

---" তুই চিনবি না। আমাদের বাঁকুড়ায় থাকেন ভদ্রলোক। সম্প্রতি গত হয়েছেন।"

----" আমাদের বাঁকুড়া! মানে?"

----" সে অনেক কথা। তোকে রাতে বলবো।"

সম্মোহ বিকাশের উৎসাহে ভাটা টেনে সুভদ্রা নার্সারির দিকে এগিয়ে গেল। পাশে বিকাশ পা মেলাল।

---" শোন তোকে রাতে ফোন করছি। কথা হবে। আর তোর বাড়ি অবশ্যই যাচ্ছি না। শেফালীর হাতে চিতল মাছের মুইঠা খাব।"

---" শেফালী নেই রে! গতবছর ক্যানসারে মারা গেছে!"

সম্মোহ চমকে উঠল। মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বিকাশের হাতটা চেপে ধরলো। বিকাশের হাতের মুঠোয় মনে হলো কোনো স্নায়ুকোষ নেই।শিরা উপশিরা নেই। কেবল হলদে রঙের অবুঝ শূন্যতা আছে।



Wednesday, December 16, 2020

||বিশেষ ক্রোড়পত্র সংখ্যা ≈ প্রদীপ চক্রবর্তী ||

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||  

প্রদীপ চক্রবর্তীর সিরিজ কবিতা 

বৌদ্ধলিপিতে যা পড়েছি 

এক 

অহেতুক দংশন রক্তকে পীড়ন করে ••• 

বন্ধ দরজা আসলে বন্ধ নয় 
ইশারার গুপ্ত সংকেত 
গেরস্থালি আর বনের মাঝখানে বৌদ্ধসংঘারাম 

দাঁত দিয়ে ধারালো প্রতিটি বস্তুকেই 
বাঁকিয়ে দেওয়া যায় 
মেঘের নিজস্ব পোড়োবাড়িটাই 
ঘুড়ি ওড়ানোর ছাদ ভেবেছিলাম 

কার্নিশ ধরে হেঁটে যাচ্ছে 
একটি গেরস্থালি হাড়ি ও আকাশ 
তিনদিকে মহাশূন্য 
মেঘ নিজেই গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে মিলিয়ে গেলো 
বাড়িটিকে বিষয়ীর হাতে রেখে 

দুই •

অন্ধের কাছে সংক্রমিত হয়ে যায় গাছ 
আসবাবপত্রের পাঠ নেবে বলে 

এই রঙ পিঁপড়ের পায়ে আহত হচ্ছে 
পাটভাঙা শাড়ি থেকে 
চিবুকের মধ্যে তিল একা ফুটলো 

বেনেবউ শব্দের পাখিটা খুব গভীর থেকে 
উঠে আসা ঢেউয়ের বিপরীতে 
ছায়ার তাড়াহুড়োয় এইমাত্র বাসায় ফিরছে 

তুমি তো আজ তোমারই ছায়া 
আলোরা কার্নিশে কুয়াশা 
সে অথবা আমি , যে - কেউ একজন 
ছায়া ভেঙে গড়িয়ে যেতে দেখেছিলাম 
হলুদ বাঘের অপেরা•••
 
বছর আড়াই তিন আগে , বিশিষ্ট কবি ও প্রাবন্ধিক চিত্তরঞ্জন হীরা একটি পত্রাকারে কী পাঠ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন , প্রদীপ চক্রবর্তীর
 " অব্যবহৃত প্রজাপতিগুলো " কবিতার  বইটি পড়ে ?______


" এই মৃগয়াপাড়ের কারুকাজ ••• "

প্রিয় অনুজ প্রদীপ , 

অব্যবহৃত প্রজাপতিগুলোর ডানা থেকে বহুবর্ণ দেশ ও বহুবর্ণ মধ্যাহ্নের রাগগুলো যখন টুকরো টুকরো হয়ে ঝরে পড়তে লাগলো , তখনই মনে হলো এ তার অনুগমন নয় , ঐতিহ্য মিশে থাকে রক্তকণিকায় বিস্তারের প্রবাহে সুন্দর আসে নদী হয়ে | কবি যত নিমগ্ন হবেন , ততই মনে হবে এতো বর্ণনাতীত | মুগ্ধ এবং বিস্ময় মিশে এ কবিতা হলো মগ্ন চৈতন্যের | চেতনা অনেকটা সমুদ্রের মতো | গভীরে গেলে তার আর কোনও উদ্দামতা থাকে না | গভীরে গভীর , 
খোলসভাঙা নিরাভরণ | এবার অলংকার পরাতে হবে | কথায় কথা জুড়বে রিনিঝিনি
 করে | 
    এখান থেকেই শুরু করা যেতে পারে 
লম্বাদৌড় | পৃথিবীর ভরকেন্দ্রে একটা পাখিরালয় , অথৈ নোনা জলের ধারণা নিয়ে জড়িয়ে ফেলছে সুদূরের সম্ভাবনা , তার নিচে পিরিচের উপর একটা হৃদপিন্ড রাখা | সেটি 
কার ! প্রথমত কবির | পড়া হয়ে গেলে পাঠকের আত্মা হয়ে ওঠে | 
    সহজ কবিতার খোঁজ হলো প্রজ্ঞা দিয়ে প্রতি মুহূর্তের জীবনকে সম্পৃক্ত করে তোলা , সেটাই বোধহয় সহজিয়া পাঠ --- 

" কত আড়কাঠি টপকে অনন্য জলাশয়ে 
লুকোনো গোড়ালি পর্যন্ত একটা অন্তহীন 
সন্ধের খোঁজে " 
( পৃষ্ঠা : ১০ ) 
হাপিত্যেশ করে বসে থাকা | তখনই টুকরো টুকরো জীবন শৈশব মাড়িয়ে মধ্যদিনের দিকে হেঁটে যায় | ছুটে নয় , দোদুল চলনে যায় | 
     তারপরই ভেসে ওঠে বিচিত্র সমাজের
কেরানিকুলের ইতিহাস | জাগ্রত স্বপ্ন থাকে মধ্যবিত্ত চিলেকোঠায় , থাকে , - 
" ছায়ার মতো অকিঞ্চিৎকর মাছ অনেক অচেনা বেড়ালের ভিড়ে " বেড়ালের ত্রিনয়ন | আহা ! ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে ইশারা | যার কোনও শেষ নেই | কিন্তু আবার এও সত্য - , চিরসত্য বইতো নয় - 
" রোজই তো শেষ দিন কারও না কারও " ۔۔۔
     বলা হচ্ছে " কুয়াশা নাকি এলো , ঘুণ - চেরাই হয়ে ", মনে গেঁথে বসলো দুটি দৃশ্য -- একটি বানিয়ে তোলা চরণের হসিত বয়ান , আরেকটি চিরসত্যের নির্মল স্তব্ধতা , পাশাপাশি বসে অমর হতে চায় | এখানেই একজন কবির পরম কাব্যকারিতা | এখানেই কবিতার মহাপ্রাণ ۔۔۔ | 
    আমরা জানি এক একজন কবির দেখা একেকরকম | দেখা আসে কখনও চারপাশের চলমান বিশ্ব থেকে , আবার  আন্তঃপ্রকৃতি
 থেকে | দুটি ক্ষেত্রেই মন যা ছেপে তুললো বা ছাপিয়ে তুললো তার একটা রূপ ফুটে উঠবে কলমে , একটা আরেকটার পরিপূরক - সৃষ্টি এবং নির্মাণ | কিন্তু তোমার দেখার তৃতীয় একটি চোখ রয়েছে , যাকে তুমি সবচেয়ে বেশি সক্রিয় রাখতে চাও , সেটি হলো নিরন্তরের পাঠ , পাঠ থেকে পাঠান্তরে যেতে যেতে পাঠবিনির্মাণ ঘটে , তাকেই তুমি চোখ থেকে মনে , মন থেকে কলমে নাও | আসলে তোমার নিজস্ব পাঠ থেকে পাঠককে আরেকটা নতুন পাঠ দিতে চাও | পাঠকের সামনে একই সঙ্গে দুটো পাঠবস্তু খোলা থাকে | একটির পাতা ঝাপসা করে আরেকটিকে তুমিই উজ্জ্বল করেছো - 
" সাবেকি চাঁদের ফেরিঘাট ধোয়া শীর্ণ মিজরাব থেকে 
উপচে উঠছে আভোগী কানাড়া ۔۔۔" 
( পৃষ্ঠা  ১২)
আরেকটা এরকমই ধরে নেওয়া যাক | যেখানে আমি আমার সামনে তুলে ধরা ছবিগুলোর মধ্যেই শুধু ডুবে যেতে পারি | ছবি - গান - নাটক - সবকিছুর ক্ষেত্রেই একথা বলা যায় | আর রয়েছে সুরহীন বাক্যের ধ্বনিব্যঞ্জনা | 
     এই যে বিনোদবিহারীর ছবি থেকে কমলারঙের ভেতর একটা নদীর দিকে চলেছি ,
আমাদের যাওয়াটা থেমে নেই কিন্তু নদীটা থমকে আছে | স্থির জলের ভেতর খেলছে অগাধ শূন্যতা | এখানে পাঠকের কোনও বিনোদবিহারী নেই , রয়েছে মায়া -- প্রয়োগের মায়া , কুসুমিত উপকণ্ঠে একাগ্র নৈঃশব্দ | যা শব্দের নিজস্ব ঢঙে অর্জন করা ছবি প্রায় অদৃশ্য আরেকটি অবয়ব , -- কখন যেন দিবারাত্রির কাব্য হয়ে ওঠে , 
" দুই পংক্তির নিবিড় ফাঁকে ফাঁকে অঝোর নেচে যায় ۔۔۔ আনখ শরীর নেচে ওঠে ۔۔۔" 
        ঐতিহ্য তার নিজস্ব সত্তা নিয়েই বিস্তারের দিকে পা বাড়ায় , তখন অনেক বিবর্তনের চিহ্ন ফুটে ওঠে | অনেক শব্দ আবার নতুন প্রাণ পায় |
এখানে মাঝে মাঝেই আমরা শুনতে পাচ্ছি পুরাতনী গান , আসরে জমে উঠছে ধ্রুপদ , ধামার , জমে উঠছে মৌন মুখরতাগুলোও |
         রন্ধন শিল্পটিও কম অর্জনের নয় | ছুটি ছুটি দিনের গন্ধে মিশে যাওয়া রান্নাঘর বলছে -- 
" লাউপাতা মুড়ে নারকেল কোরা অল্প চিনি নুন হলুদগুঁড়ো 
রাইসর্ষে ইলিশ যেন পোয়াতি পেটের সোহাগ মাখানো " ( পৃষ্ঠা ১৫ ) 
যখন পরিবেশন করা হলো চেটেপুটে খাওয়ার আগেই আবার বেজে উঠলো -- 
" শব্দে এটুকুই ধরতাই ••• এটুকুই শাশ্বত বাসনাকুসুম " 
যেন পাঠককে বলা হচ্ছে -- কুসুমটি কিন্তু পূর্ণবিকশিত নয় , আরও কিছু পাপড়ি খুলতে বাকি | কবিতার প্রতি নিবিষ্ট হওয়ার বেশ মজা করেই দেওয়া আছে , ক্যানভাসে স্তব্ধ হাওয়ার কথাও বলতে হয় | 
    এখানে বাঁকগুলো নানা পরতের | জীবন রচিত হচ্ছে ছায়া ছায়া আত্মচরিতবিহীনে | গহ্বরে ঢুকে যাওয়া বৃষ্টির মিশেলে অনেক রিনিঝিনি ,  ছলনা খেলছে , ধরা দেব কি দেব না করে শেষে খুলে যায় আরও একটি বন্ধ দুয়ার --
" হাতের বাঁধটুকু আলগা হয়ে পড়ে অসাড়ে •••
টের পাই আরেকবার , 
কায়া সাধো  কায়া সাধো মাদল বাজছে 
আর  রোববার হতে চাইছে না ••• " 
( পৃষ্ঠা ১৬ ) 
পড়তে পড়তে গোলাপীবালা উধাও হয়ে গেলো , রোববারের গ্রামোফোন আঁকা দরজাটাও মৃদু হাওয়ায় দুলছে | মাদল থেকে মুখর হচ্ছে শুধু একটি একতারার ধুন | যেন এই দেহতত্বে আর অন্য কোনও সাধন নেই | 
     একথার আরও একটা ধরতাই আমরা দিতে পারি - বৃষ্টি যখন সেই নিঃস্ব গাছ হয়ে ওঠে , চোখ ধারণ করে বিন্দু বিন্দু সাধনচিহ্নের নীল সনাতনী , ঢেউগুলো আর লহর থাকে না , হরণ করে নেয় স্তব্ধতাকে , নাটক হচ্ছে 
ডাকহরকরার | এখানে কোনও শ্রেণীচরিত্র নেই ,
" এলোমেলো " ' আমি ' র সত্তায় কাপালিকতা , আসলে নিসর্গীয় ভূগোলকে এ শুধু রং বদলের খেলা , রসকলি -- 
" শরীরের দিকে তার বসতবাটি •••
সে কি জীবাশ্ম হয়ে যাওয়া একটা দেহবোধ 
না সুরেন্দ্র বিনোদিনী ? " ( পৃষ্ঠা - ১৭)
এভাবে চিহ্নিত করে অনির্দিষ্ট যাত্রার অভিমুখ , লেখা হয় গন্তব্যহীন এক ফেরিওয়ালার ডাকভাঙা দুপুরের অফুর  কাহিনী | " সুরেন্দ্র বিনোদিনী " হয়তো অনেকের কাছেই অধরা থেকে যাবে , কিন্তু খোলসটি ছাড়ালে এ দেহ ভান্ডার অটুট অরণ্য হয়ে যায় , আর সমুদ্র হয় ধ্বনিহীন | 
        বনবীথিতলে পুতুল খেলছে দেহ ও মন , খেলছে জাগরণের ভোর | যেমন অমর ও নশ্বরতা -- খেলাটা জীবনাভিজ্ঞতা নিয়ে | মন যত গভীরে যায় , ততই পথ যেন সহজ হয়ে 
ওঠে | এই স্বস্তিটুকু সাম্প্রতিক কবিতায় রয়েছে |
বাসনাকুসুম পাপড়ি মেললে ভেতরে থাকে আধখানা চাঁদ -- এটাও একরকমের দেখা | আবার বাড়িটার নাম যদি হয় গোলাপীবালা , নীল প্যারাসুট খুলে নীচে নেমে যাওয়াটা তখন কিন্তু শুধু নৈসর্গিক নয় , এক আশ্চর্য বোধ , যা দৃশ্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে | তারপর ভাসতে থাকে | যেমন ভেসেছে ' সওদাগরের নৌকো ' দুখানি , ' দামিনী বিজুরি ত্বরিত জলে ••• ' ভেসে যাওয়াটা হলো ভাষার টান | হাজার বছর ধরে ভেসে চলেছে নদীমাতৃক দেশ - গ্রাম - মানবজমিন দুকূল ছাপিয়ে | বোবা পৃথিবীতে আমাদের পেছন ফিরে তাকাবার সময় বড্ডো কম | আমরা ছুটছি , ছুটল বাণকে কি যত্নে নিবারণ করা যায় ! 
     শব্দের ব্যবহার সবসময়েই নজরে পড়ে , গতির ভারসাম্য ও খুব নিমেষ ফেলে ফেলে | আমরা অতিক্রমকেও দেখছি , আঙুলের নিটোল পর্যন্ত সে পৌঁছে যেতে চায় , রয়েছে পরিধেয় কারুকার্যের স্বাদ নিয়েই | 
     পৃথিবীর শেষ বিপনীবীথিকে খুঁজতে গিয়ে প্রায় পথ হারিয়ে ফেলছিলাম , কিন্তু কাকতাড়ুয়াটা ঠিক চিনিয়ে দিলো , নিমিত্ত বিজনটুকু আরও কত যে সুদূর | এই যে ছয় রিপু ছয় ঋতু দিয়ে মোড়া বা রিপুগুলো ঋতুর নরম আগুন দিয়ে গড়া এরও কিছু টোকা 
থেকে , পুরোটাই ইশারা নির্মিত | পুরোটাই নির্ভর করে পাঠক কীভাবে নিচ্ছেন |
     ' বিভাজিকা ও বিনোদবিহারী ' সিরিজের মান্যতা আরও গভীর , যেন নিজের সঙ্গে অনেকটাই কথা বলে যাওয়া | ছবি থেকে ছবিয়াল , সেই দেহ , সেই অবয়ব , আকারে - নিরাকারে আরও একবার পড়ে নেওয়া গেলো --
' পরিত্যক্ত সিঁড়ির ধাপে বসে রয়েছে 
অস্ত আকাশ খেলা ' ( পৃষ্ঠা ২৬ ) 
হাওয়ার ঝিরি ঝিরি বইছে , দিনফিরতি বাসে তুলে দেওয়া চায়ের গ্লাস তার রঙ ধোয়া চৌকাঠের ওপারে বন্ধ কারখানার পাঁচিলে অপলক একলা খেলছে | খেলতে খেলতে ভেঙে  শুনশান কয়েকটুকরো | কত কত শব্দ প্রজাপতি হলো , কত মন রঙরসিয়া -- 
' সমস্ত রাত জ্যোৎস্নার মাঠ পার হয়ে 
কেউ লাফ মেরে উঠে আসে বারান্দায় | ' 
( পৃষ্ঠা ২৭ ) 
এরপর শব্দরা কথা বলতে শুরু করে নিজেদের সঙ্গে | প্রতিটি শব্দ স্বমহিমায় নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠে | কী চমৎকার তোতা - নকশা | গোলকধাঁধা আজও অলীক ও নরম , ঝড়ের রেশম ছিঁড়ে দেখতে চায় , দেখার শেষটুকু | দেখা হয় না শিশির বিন্দুগুলো | দু পা ফেলে মন তখন তো ঘরের বাইরে | 
     যে কবি রক্তকরবীর উৎস শুষে নিয়ে কলমে তুলছেন গ্রন্থিত পৃথিবীর ভোর ,  তাঁর ব্যক্ত অনুরাগ , তাঁর ধ্যান গৃহস্থ হতে চায় | কিন্তু  নৈঃশব্দ্যের ঘুলঘুলি দিয়ে ঢুকে পড়ে ঘরহীন নিখিলের ব্যস্ত ওঠানামায় | তারপর অকূল
 ছেঁড়া , প্রণয় যশ , বিভঙ্গ , -- তালে পড়ছে জীবিত রাগ , -- ঘুঘুচরা -- 
' এখানে ' ঘুঘু ' শব্দটার সমুদ্র ছিল 
অশেষ অসঙ্গতির জড়রূপ ' ( পৃষ্ঠা ৩৩ )
আমাদের খুব নিবিড় হয়েই বাজিয়ে নিতে হবে অসঙ্গতিকে এবং কোথায় তার জড়ত্ব - সেটুকুও নিজের মতো করে দেখে নিতে নিতে ঢুকে পড়তে হবে দহন ভূখণ্ডে | খন্ড খন্ড তাপ ও চাপের ব্যাসার্ধে এই অহর্নিশ , শেকড়  বাকড় , 
চালচুলো , নিষেকের উজ্জীবন , ঝড় উঠলে  হড়পা বান , বন গাইবে সর্বগ্রাস ••• 
    নদীর ভেতরে স্তব্ধতা কতটুকু কালে তাকে খুঁজতে আরেকটা ডুব , তোমার অয়দিপাউস , তোমার মদনভস্ম পালা | সেই রাধারানী , সেই মাহেশের রথের মেলা | আমি না ঝড়ের সমগ্রে এক অপরূপ সন্ধ্যাকে সেই কৈশোর থেকেই দেখতে পাই | কিন্তু আমার বাগানে পলাশের মতো আর কোনও পলাশ হবে না | শুধু লাশ , শব্দের শব বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা | শববাহকেরা বোবা | কিন্তু বোকা নয় | মনে মনে রৌদ্রপলাশের গান রচনা করে চলেছে প্রত্যেকে এক কলি | আগুনে ঘৃতাহুতি নয় , এক অন্তত শব্দাহুতি দেবে | তারপর নাভিটি ভাসাবে অবিনাশ ছলাৎছলে |
    এসব কথা হয়তো পাঠকের নিজস্ব , কিন্তু কবির কলম বলছে -- 
••• ' কেউ কি চাঁদের দিকে তেড়ে গেল ? 
সেই নবনীত বিড়াল -- ছড়িয়ে ছিটিয়ে খাও , 
পরস্পর ••• আপাদমস্তক রোঁয়া ••• ' 
( পৃষ্ঠা ৩৬ ) 
 কটিবাস , গন্ধ , রেলিং , কার্নিশ -- এরপর শুধু অনুষঙ্গ মাত্র | আমরা ভেসে যাই জলের প্রতিমায় , শরীরের ভাঙ - এ ভাঙন চিহ্নগুলো দাগহীন | একটা ফুরসৎ , তারপর | তারপর তেষ্টা চুয়িয়ে পড়া | 
    সমস্তটাই নিজস্ব | প্রদীপ কথিত | এক রহস্য থেকে আরেক রহস্যের পথে যেতে যেতে ফিরে আসার টান আর থাকে না | তবে সমস্তটা ভেতরে নড়ে  চড়ে , রক্তপাত লুকিয়ে ফেলে | 
কিন্তু ক্ষরণটা চলছে | শব্দের খনন আর আত্মের ক্ষরণ মিলে এই জবাকুসুম , মন পিলসুজ জ্বলে , জ্বলতেই থাকে | আমাদেরও মনে হয় -- 
' শব্দটি একটু টাল খেলো এমনকি ইশারাও ! 
অসম্ভবের গাঢ় কড়িকাঠে কীভাবে যেন চিবুক ,
জড়িয়ে আছে বেশ ক' টি প্রকোষ্ঠে | ' 
( পৃষ্ঠা ৩৮ ) 
        এরপর অন্নদাশঙ্কর রায় যা জানাচ্ছেন তা নিশ্চুপ ভঙ্গিতে আরেকটি রক্তপ্রবাহ | আলপথটা পেরোতে হবে , কখনও বুকের আলপথ , কখনও চোখের | চোখ সইতে না সইতে নুপুর শব্দ | ধ্বনির মধ্যে দৃশ্য , দৃশ্যের মধ্যে  ঘ্রাণ , মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকানো | আশ্চর্য সিঁড়িখানা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে নেমে যাচ্ছে অন্তহীনের দিকে -- 
' দৃশ্যসীমা ক্রমশ নেমে আসে |
দীনতর  ক' রে বিক্ষত প্রতিরূপ ••• ' 
( পৃষ্ঠা ৪০ ) 
বইছে এক এক পরতের হাওয়া , তার সঙ্গে ফুটে ওঠা প্রহরগোনা ছায়া | টলতে টলতে ভেজাচুলের গন্ধে পাথর ও ঝর্ণা | পথ কি কখনো একা হতে পারে ! ওই যে একপশলা মানুষের দেশে কত কত অপেক্ষা জমেছে ! শিশির পড়লে হাসিও নামবে | নেমে নেমে আরও গড়িয়ে যাওয়া | 
     ' ঢাক ও মেয়েপুতুল ' কবিতায় চলনটা শুরু হয়েছিল একেবারে অন্য এক প্রদীপের ছাপ নিয়ে | যেখানে বলা হচ্ছে -- 
' ঢাক বলতে আল্টিমেটলি আমি বুঝলাম একটা কাঠের কুঁজো যার ওপর একটুকরো চামড়ার পলাতক লেগে থাকে ••• ! '
 ( পৃষ্ঠা ৪৫ ) 
' আল্টিমেটলি ' এবং ' পলাতক ' শব্দদুটি একেবারে অন্যমাত্রা থেকে ব্যবহৃত হয়েছে |
এর যা অনুরণন এবং যা মেজাজ সেটা শেষপর্যন্ত অন্য বোধে নিয়ে ফেললো | গোটা কবিতার মধ্যে পাঠকের  শ্বাস নেওয়ার কোনও জায়গা নেই | অথচ ' পলাতক ' শব্দটি কী যে বাজছে ! আহা ! 
    অবশ্য একজন কবিয়াল পৃথিবীর নিসর্গে ঘুরে ঘুরে , হারানো চোখ , হারানো স্থপতি থেকে অমূল্য তুলে তুলে আমাদের যা দেন তা মহার্ঘ , 
তা পরমান্ন | তাঁরই রচনা ' চিরহরিতের টোল ' | 
এই টোলে আমাদের পাঠ দিচ্ছেন তিনি , চাঁদের পাঠ , জগৎকুয়াশার পাঠ , আরও আরও ঘন ঘোর | একবার ডুবে বসি , আবার ডুবে যাই | শুধু ' যাওয়া - আসা ',   খেয়া পারাপার -- 
' কারো জানলা থেকে যতদূর , ততদূর খেয়ার অবকাশ ••• ' ( পৃষ্ঠা ৫৩ ) ছোট্ট প্রাণ নড়েচড়ে , কিন্তু একজীবনে অবকাশ কি আর ফুরোয় ! কতটুকু আর দেখা যায় ! আবার জীবন তো সেই একটাই | কী যে করি -- 
' একটা গন্ধের বকুল যদি প্রবাসী হয় , 
প্রবাসী পাখিরা বিজনে ওড়ে 
রঙ রেখা জঙ্গলের ভোরে ••• ' ( পৃষ্ঠা ৫৪ ) 
         কবিয়ালের সব সুর ইশারাচিকন দু গালের টোল খুটে খুটে তুলছে | কিছু পাখি মাছরাঙা , কিছু পাখি  বেনেবউ | আর কাগজের পাখিরা ! 
তারাও তুলছে ইচ্ছে রঙের ডানায় দু ' একটা স্পর্শ  ছলাৎছল , স্রোতধারা ••• | 
        ছায়ার খেলা বুঝতে বুঝতে অনেকটা পথ পেরিয়ে এলাম , যেন অনেকটা জীবনও | বিন্দু বিন্দু ফেলে রাখছি মোহতাপ , অঝোরমোহিনী |
স্মৃতিময় ۔۔۔
' কুহেলিকা মোড় , পেরিয়ে ক্রসিং , ছায়াতে কুপার্সক্যাম্প 
দুধফোটার উপনিবেশ ••• ' ( পৃষ্ঠা ৫৯ ) 
একে ঠিক কত মাত্রা দেবে ! আরও নির্জনে নেমে যাওয়া অফুর নদীটি | কত কথা বলতে চায় ! নুড়ি ভাঙে চোখের ছেনিতে | না থেকে 
নয় , নয়ে নয়ে শূন্য আঁকা একটা রোবট , তার জন্ম , তার 'জন্মের ভ্রুণ ' একটা স্বপ্ন দেখে , একটা স্বপ্ন আড়মোড়া ভাঙা | 
        আরও একটু রাত্রি নিবিড় হলে আমাদের  আকালের সন্ধান নেমে পড়তে চায় পাতার উপসর্গে | পাতায় পাতায় ফিরছে পরিচর্যা | তার গাঙ্গেয় বঙ্গের গোলক - 
' কাঁটায় কাঁটায় চুলের ঈষৎ 
নুয়ে পড়া সন্ধে ' ( পৃষ্ঠা ৬৭ ) 
'তিমির ' এখানে ঘননীল বিশ্বের অন্য এক ছায়া ,
অন্য এক ছবি | কাটা কাটা ছায়াছবি | চলছে তো চলছে , বুকের বাঁশিতে মোহন বাজছে | ভোরের পাখি , দেহের পাখি আলাদা আলাদা দৃশ্য তুলছে | মনদরিয়ায় উড়ান দিচ্ছে 
সূক্ষ্মতারা |  ফাল  পাড়ছে এলোকেশে | মেঘবসনে গোলকধাঁধা | ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এক শূন্য থেকে আরেক শূন্যে ছুঁড়ে দিচ্ছে উন্মাদনা |

     বোধের গভীরতা এবং ভাবনার নিবিড় যেখানে এসে মেশে তার দেয়ানেয়াটুকুই মনদরিয়া | উথালপাথাল | কিন্তু বাইরে তার প্রকাশ কম | যেন বস্তুকণার সব রহস্যই অনামিকার খেয়াল | যেন -- 
' বিতানের জল কখনো জল হয়ে ওঠে না 
লম্বালম্বি চিরে গেছে বিতানের এই দৃশ্য ' •••
( পৃষ্ঠা ৭০ ) 
     বারীনদাকে উৎসর্গ করা হয়েছে ' ফিরে আসার গল্প ' দুটি পর্বে | এ কবিতায় যে অপসারণের শব্দ আছে তা কোনও সমীকরণেই মেলে না | তোমার পাঠ নীরব এক উঠোন , সেখানে যখন রোদ এসে পড়ছে তা মিহিসুতোয় বোনা | এই প্রবেশদ্বারটি যখন উন্মুক্ত হলো তখন বারবার মন বলছিলো অন্ধ আবেগ দিয়ে কোনও অনুসরণ হয় না , অতিক্রান্ত দিনের শেষে রক্তিম আভাটুকুই অশেষ রচনা -- 
' একটা দেশের দারুহরিদ্রায় সজনে গাছের বহর 
সমান মগডালে ডেকে ডেকে ক্লান্ত একফালি পাখির গ্রন্থিত সহচরী ,' ( পৃষ্ঠা ৭১ ) 
চলমান অন্ধকারের মধ্যেও এক একটি মুখ ভেসে ওঠে | সত্তা তাদের উজ্জ্বল করে রাখে |
সামান্য দিগন্তই তখন অসামান্য | সরল পসরা প্রদীপ সাজাতে পারে না বলেই সে ঠিক তার মতো | পুরোনো বন্ধুর পুরোনো একটা বাড়ি ছায়া দেয় আকাশ থেকে কখনও মাটিতে পড়ে না | আমাদের এই পাঠ নিজেদেরও কিছুটা শিক্ষিত করে তোলা | ' অব্যবহৃত প্রজাপতিগুলো ' আমাদেরই ঘিরে ডানা মেলছে রঙ ফেলছে | আরও একটি বাঁকের অপেক্ষায় দাঁড় করিয়ে রাখতে চাইছে | আসলে আমাদের যেন স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছে -- 
' যারা কবিতাকে ছুটির সঙ্গী বলে ভাবে , কবিতার প্রতি ছত্র পড়ে হৃদস্পন্ধন অনুভব করতে চায় তাদের কবিতা না  পড়াই উচিৎ | •••' 
( সুধীন্দ্রনাথ ) 
কবিতা রয়েছে তার সমগ্রের মধ্যে , বহু পরতে , নানা রঙের আলো নিয়ে রহস্য নিয়ে | আমরা হয়তো একটু খন্ডাকারে দেখে ফেলি | 

        যাহোক সন্ধান তো জারি থাকবেই | স্বকীয় এবং স্বনির্মিত ভাষায় পৌঁছতে একজন কবি নিরন্তর নিজেকে ভাঙবেন , আবার গড়তে থাকবেন | এখানেই সেই সত্য -- 
' দুরূহ  আঙুলগুলো  হাতে জড়িয়ে 
অঝোর অর্জিত 
এবং 
অন্তিম শ্বাস মেপে নৈর্ব্যক্তিক ব্যাভিচারী ' ••• 
( পৃষ্ঠা ৭০ ) 
এভাবেই নিগড় শব্দের সরগম শুনে চলেছি আমরা | চলতে থাকি | 

    ভালো থেকো , এই শুভ কামনা | 
ইতি , 
প্রিয়জন চিত্ত দা , ১০ / ৫ / ১৮ 

ছবি ঋণ≈ শ্রীমহাদেব (বাঁকুড়া)
তিন •

একটি গভীর কলগার্ল 
মিরিক থেকে ফিরে আসছে 
 চাঁদনিরাতে সীমান্তরক্ষী সৈন্যদের ঘোড়া 
হাসছে দুলছে রাম খাচ্ছে নাইটক্লাবের বারে 

এপার থেকে সোনা ওপারে যায় •••
মিনিয়েচার হাতিদের নিজস্ব পথ 
অন্নহীন রসহীন মাংসহীন ক্লেদহীন 
বিজন পৃথিবী 
আগুন জ্বলছে কাঠের আগুনে 


গ্রীষ্মে বিষুবরেখা টপকে দুজনেই বেরোবো শিকারে 
মেঘেদের ধানক্ষেতে একলা ময়ূর 
এক দূরাগত নদী আছে , নেমে যেতে হবে 

ক্ষুৎপিপাসার  নীলাজ  কিনার ঘেসে 
ফুটে উঠলো স্তবকে স্তবকে , 
ঝরে পড়তে থাকলো কয়েকটা ছায়াশরীরী রহস্যময় ছায়ার মধ্যে ডুবে 


যখন বাড়িটা আমার মধ্যে ঢুকে জানলা দরজা খোলে 
পৃথিবীকে ঢেকে দেয় ময়ূরের  কলাপ  
ছায়াহীন শরীরী নটী নিঃশব্দে আসে , আবার নিঃশব্দে চলে যায় 
শিখরের পর শিখরে আঘাত করে ভোরবেলা •••


চার • 

লতানো ঝরোখাখানি ছায়াচিত্র |
রক্তের দহে গিয়ে ঘুম ভেঙে দেখি 
বেহিসেবী স্বপ্নধ্বংসী একরোখা মানুষটার 
পাকদন্ডীতম বিন্দুর কাছে 
ঠান্ডা বরফকুচি দেওয়া দুধ এমনকি মাতৃদুধও 


তার চিরহরিৎ তেষ্টা মেটে না 
প্রিয় প্রেতকথা , মুজরা চটুল  ভানুমতী খেল 
পুতুল  ঠমকী দেহহীন সূক্ষ্ম তমসমা 


থেরীগাথার মধ্যে , বৈশালীর রাস্তায় উপাসিকারা 
অবৈধ টক কুল খেতে ইচ্ছে হয় , সল্টেড ইমলি 
টক টক গন্ধে শরীরের প্রাতরাশ তুলে দেয় 
ভারতীয় গোধূমখেতের মধ্যে বিবমিষা 
সাক্ষী : শরৎশশী 

টোল পড়ে ডিমের কুসুমে 
কিছু মদ্দা হুল্লোড়বাজ , 
মাস্টারবেট করতে করতে মহাকাশে 
নিমিত্তমাত্র হয়ে এ ওকে ছেদ করে যাচ্ছে 

ছোট ছোট কাষায় বস্ত্র পরে মস্তকমুন্ডিত মেয়েরা চলেছে 

উদাসী মনে জগৎ ভ্রমণ করছিলেন তথাগত 

শরীরে নৌকোর দুধ -  উথলে কাগজের সাম্পান চলে আসে 
পুব - দখিন দোর খোলা , 
এতো হিমেল ' তমিস্রা '  অথির তরঙ্গ , 
তার বিজাতীয় নৌকো চলেছে একা 

অন্ধকারের কোনো কোনো অংশ জ্বলে ওঠে 

ধ্বক ধ্বক করা রক্তমাংসেডোবা মন 
ডুবতে ডুবতে নৌকোটি সাপের পেটের রঙ নিয়ে চলেছে নিরুদ্দেশে •••

ছবি ঋণ≈ শ্রীমহাদেব (বাঁকুড়া)

                                             পাঁচ • 

শিবিকার ভেতরে বসে একজন মানবী শুধু 
মাধ্যাকর্ষণ শাসিত | 
রক্তের গন্ধের মধ্যে স্বল্পায়ু  লৌহকণা 
ফলত জলের অস্ত্রাগারে সাড়া প'ড়ে গেছে 

সর্বাঙ্গীন আমার শরীরে তার নিজস্বতা অর্জন ,
জলীয় নক্ষত্র  হাইরোগ্লিফিক 
দীর্ঘতমা  জলসরস্বতীর চুলে টক গন্ধ বাসি আলো , 
ছুরির ফলায় তৈরী হচ্ছে একটা লম্বা ফাটল 

স্বপ্নে চাঁদের আলো চেনা যায় না 

কোনদূর ছাপোষা পিলসুজ জ্বলছে নিভছে 
কাছাকাছি 

নদী পাড়ে পালযুগের পসরা নিয়ে মেলা বসেছে

বাতাসে মরা শ্রমণের পচনধরা  পেশী ,
ভয় ও খনন 
মুখগুলো সারারাত ব্যথায় নীল হয়ে ফিরে আসবে 
একটি ন্যূনতম সারমেয় একা একা লেজ নাড়ছে 
কতদিন পর ভুয়াং দুলিয়ে ফুল ফোটে 

মানবীর আলটপকা  বুকের নীচে কথিত চাঁদ 

ঈষৎ সন্ধিহানে  জষ্টিমাসের কালোজাম টুপটাপ খসে পড়ে •••








Tuesday, December 15, 2020

এবার আমরা শুনবো আপনার কথা আপনার কবিতা :: গৌরাঙ্গ মিত্র

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||
এবার আমরা শুনবো আপনার কথা আপনার কবিতা : এই পর্বের আজকের সংখ্যায় থাকছেন 
কবি গৌরাঙ্গ মিত্র-এর কথা 

নমস্কার গৌরাঙ্গ দা।
---আরে এসো এসো,ভাই অভিজিৎ। ভালো আছো?
---আমি ভালো আছি।

কেমন আছেন আপনি এবং আপনারা এই সংকটের কালে?

☞ করোনা নামক এক ভাইরস  পৃথিবীটাকে প্রবল ঝাকুনি দিয়েছে। তবু আমি বলব যে ' আমি ভালো আছি।'পৃথিবী নানা সময়ে, নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়েছে । সম্প্রতি আমরা করোনা সমস্যায় ভুগছি। অতীত এবং বর্তমানের প্রেক্ষিত মাথায় রেখে এ কথা বলতে পারি ভবিষ্যতেও অজানা কোনো সমস্যা এসে আমাদের নাজেহাল করতেই পারে। তবু আমরা সব কিছু কাটিয়ে উঠব। আমরা জয়ী হব। শেষ পর্যন্ত মানুষের জয় হয়।

---ঠিক বলেছেন দাদা।

দাদা আপনিতো  জানেন, সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন-এর প্রতি মাসে ১টি সাক্ষাৎকার পর্ব প্রকাশ করি " এবার আমরা শুনবো আপনার কথা আপনার কবিতা  "~ এই পর্বের আজকের সংখ্যায় আমি আপনার সাথে  কথা বলার জন্য এসেছি। আপনার ব্যস্ত সময় থেকে আমাদের এবং আমাদের সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন-কে ও আপনার কবিতার পাঠকদের জন্য আপনার কথাগুলো  যদি বলেন,আপ্লুত হই...

---নিশ্চয়ই অভিজিৎ। বলো কী জানতে ইচ্ছে করছে?


১) আপনি কবে থেকে কবিতা লিখছেন বা সাহিত্যের সাথে যুক্ত আছেন দাদা?

➤আমার প্রথম কবিতা লেখা ক্লাস নাইন- টেন বয়েসে, অবশ্য যদি সেই লেখাকে আদৌ কবিতা বলে গ্রাহ্য করো।  তাল পাতার পাখা , কাল বৈশাখী ঝড় এমন কিছু নিয়ে হয়তো শিখেছিলাম। তার পর থেমে গিয়েছি।
দ্বিতীয় পর্বের লেখা শুরু হয় ইলেভেন - টুয়েলভ পড়ার সময়। চলেছিল কলেজ পৌছনো পর্যন্ত। তারপর থেমে যাই।
তৃতীয় পর্বের চর্চাই গ্রহনযোগ্য বলে আমি মনে করি। এই পর্বের চর্চা তিন দশক ধরে চলছে এবং আমৃত্যু চলতে থাকবে বলে বিশ্বাস করি।

---- নিশ্চয়ই চলবে দাদা।

২) আপনি ক্যানো কবিতা লেখেন? কখনো যদি কবিতায় না আসতেন অবসর সময় কিভাবে কাটাতেন?

➤আমি একটা কথা বলে থাকি যে আমার মাতৃভাষা দুটো - বাংলাভাষা ও কবিতা। একবার বিভিন্ন বিষয়ের ক্লাস নিয়ে কবিতা লিখেছিলাম। ক্লাস সিরিজের সেই কবিতাগুলি যথেষ্ট আদৃত হয়েছে।কবিতা পাক্ষিক সম্পাদক মন্ডলী কবিতা পাক্ষিক পত্রিকার মাঝের পাতায় স্থান দিয়েছিলেন। একটু আগে যে বলেছি কবিতা আমার একটি মাতৃভাষা, বাস্তবিকই। কোনো নতুন বিষয় পড়লে , কোনো নতুন তথ্য জানার পর তা নিয়ে কবিতা লিখে ফেলি। আমার কবিতাগুলি খুঁটিয়ে পড়লে পাঠক বুঝতে পারবেন বিভিন্ন বিষয়ের সহাবস্থান ঘটেছে সেখানে।
কবিতা না লিখে অন্য কিছু --- ভাবতেই পারিনা। তবু যদি তর্কের খাতিরে মেনে নিই তাহলে বলব ' লাইব্রেরি পরিচালনা করতাম (করেওছি), রাজনীতি করতাম, ব্যাডমিন্টন খেলতাম। নিজেকে প্রকাশ করার জন্যই কবিতা লিখি।

৩) আপনিতো প্রচুর জনের লেখা, বিভিন্ন ধরনের লেখা পড়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কোন কবিদের লেখা আপনার পছন্দের? বা এমনও বলতে পারেন এইসময়ে  আপনার কাছে কোন ধরনের কবিতা বেশি প্রাধান্য পায়?

➤রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও অনেক প্রবীন, নবীন কবিরা আমার পছন্দের তালিকায় আছেন। জীবনানন্দ দাস, সমর সেন, শঙ্খ ঘোষ এবং আরও অনেকের কবিতা আমাকে প্রাণিত করে। পোস্ট মডার্ন কালখন্ডে দাঁড়িয়ে প্রিয় প্রভাত চৌধুরীর নাম সর্বাগ্রে করতে হয়। নবীনদের মধ্যে তুমিও তো আমার পছন্দের কবি অভিজিৎ। মাথার মধ্যে কোন কুঠুরিতে যে চমকে দেওয়ার মতো কাব্য ভাবনা, শব্দ ভাবনা মজুদ করে রাখো তা ভেবে আমি কুল কিনারা পাই না।
প্রথা ভাঙার জন্য, ছাঁচ ভাঙার জন্য যাঁরা লেখেন তাঁরা  আমার বিশেষ শ্রদ্ধাভাজন।

--- আমার সৌভাগ্য দাদা। আসলে আমিতো গতানুগতিক ধারা ভেঙে লিখি, এবং এটাও মনে করি এই ধরনের কবিতা লেখার ভঙ্গিতেও একটা আকার আছে,কারণ আকার সব জিনিসেরই হয়, তাই না! আচ্ছা দাদা...

৪) আপনি তো প্রিন্ট পত্রিকার সাথে সরাসরি যুক্ত এবং ওয়েবজিনেও লিখছেন। web.mag, print media আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

➤হ্যাঁ প্রিন্টেড ম্যাগ এবং ওয়েবজিন সর্বত্রই আমি লিখি। সত্যি বলতে কী, এক সময়  ওয়েব ম্যাগাজিনের প্রতি আমার অন্তরের সমর্থন ছিল না। তখন ভাবতাম ওয়েবজিন ক্ষণস্থায়ী। ধীরে ধীরে ভাবতে বাধ্য হলাম ক্ষণস্থায়ী ও দীর্ঘস্থায়ী কালের মধ্যে কত সময়ের ব্যবধান তা কি আমি জানি? অত ভাবনায় আমার কাজ কী। প্রজাপতি তার পাখায় ক্ষণ কালের ছন্দ পেয়ে খুশিতে ডগমগ হতে পেরেছে। প্রজাপতিদের কাছ থেকে আনন্দপাঠ নেওয়ার চেষ্টা করি। ওয়েব জিনের কণ্ঠস্বর চোখের পলক পড়ার আগে সারা পৃথিবীর কাছে পৌঁছে যায়। এর গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই।

৫)  চারিদিকে কবিতার জন্য বিভিন্ন ম্যাগাজিন, সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে কবিদের সম্মান জানানো হচ্ছে।  আপনিও অনেক সম্মানে ভূষিত। আপনার কী মনে হয় এই ভাবে কোনো কবিকে বা লেখাকে সম্মান দেয়া যায়?

➤যাঁরা সম্মান দেন তাঁরা তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির সঠিক বিশ্লেষণ করতে পারবেন। পুরস্কার প্রাপকদের, আমার মনে হয় দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। তাঁদের সম্মানের উপযুক্ত হয়ে ওঠার প্রয়াস জারি রাখতে হবে। প্রচন্ড শক্তিশালী লেখক যখন সম্মান পান তখন অনেক ক্ষেত্রে মনে হয় পুরস্কারই পুরস্কৃত হল। খোদ সম্মানই সম্মানিত হল।


ছবি ঋণ≈ শ্রীমহাদেব (বাঁকুড়া)

✪ সরাসরি কবিতা পাক্ষিক পত্রিকার সাথে যুক্ত। এই জার্নিটা একটু share করুন --- :

দীর্ঘদিন ধরে কবিতা পাক্ষিকে লিখছি। ২০০৩ সাল থেকে সংযুক্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছি। তখন থেকে আজও সম্পাদক মন্ডলীতে আছি। এত দীর্ঘদিন ধরে কবিতা পাক্ষিকের সম্পাদক মন্ডলীতে থাকা বিরল সৌভাগ্যের বলে আমি মনে করি।

✪ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ --আমার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হল:-

১) বুদ্ধদেব সমীপেসু।
২) পাখিদের এসপারান্ত
৩) পুতুলের সংসার
৪) গুরুদেবের পাঠশালা
৫) কোন ভাষায় বিদ্যাপতি
৬) আরও বেশি পৃথিবী
৭) সফেদ শব্দ কিছু
৮) সেমিকোলন
৯) নক্ষত্রের জন্মকথা
১০) একবচন বহুবচন
১১) দাদাগো
১২) স্মৃতিরাই সুন্দর
১৩) উড়ান
১৪) নির্বাচিত কবিতা
১৫)  ইষ্টিকুটুম বেড়াল ছানা (ছড়ার  বই) (যৌথ ভাবে নাসের হোসেন এর সাথে)
ইত্যাদি কবিতার  বই।

গল্পের বই :- 
১) ভদ্রলোকের গল্প

ভ্রমণ এর বই:-
১) কুমায়ুন জানা অজানা
২) রুপলাবণ্যের  কাশ্মীর
৩) সিকিম সিকোয়েন্স
৪) মধ্যপ্রদেশ পাঁচমাড়ি
৫) রাজভূমি রাজস্থান
৬) চোখের আলোয় লেহ লাদাখ।


✪✪ আপনার ২টি প্রকাশিত অথবা অপ্রকাশিত কবিতা দিন।
--গৌরাঙ্গ মিত্র-এর কবিতা

বহুব্রীহি

হি হি হাসির ঝর্না তলায় একটি আকাট বহুব্রীহি হি হি করে হেসে উঠল।
বহুব্রীহি 'এক' হয় নাকি, সে তো একের মধ্যে বহু, বহুর মধ্যে এক।
বহুব্রীহি শুনে ঘাস চিবোতে ব্যস্ত গাধাটি হি হি করে ডেকে উঠল নাকি কেঁদে ফেলল।
গাধাদের হাসি ও কান্নার তফাৎ বুঝতে গেলে শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ চাই। অবশ্য গাধাটি ঠিক ঠিক  গাধা ছিল কিনা জানিনা।
ঘোড়াও হতে পারে। চিহি চিহি আওয়াজের সঙ্গে ঘোড়ার ডাকের
অনেকটাই মিল আছে।


যাহা গাধা তাহাই ঘোড়া

এ আবার হয় নাকি, মশাইরা ভুরু কোচকাচ্ছেন, তাই তো,
আমি বলব হয়, আলবাত হয়।
বাঘ ও বেড়াল একই পরিবার ভুক্ত।
এটা শুনে তো আপনাদের কিছু মনে হচ্ছে না।
গাধা ও ঘোড়া একই পরিবার ভুক্ত হলে কারো পাকা ধানে  মই  পড়ছে কি?
আরও এক ধাপ এগিয়ে বলব উটও গাধাদের পরিবার ভুক্ত।
গাধারা ছোটো ছোটো পায়ে মুটেগিরি করে ।
ঘোড়ারা পাহাড়ে- সমতলে তিড়িং বিড়িং লাফাতে লাফাতে পা গুলিকে একটু বেশি মজবুত ও ঢ্যাঙা করে ফেলেছে।
উটেরা বসবাসের জন্য মরুভূমির গরম বালি বেছে নিয়েছে।
মরুভূমির গরম বালি এড়িয়ে যাবার জন্য লম্বা- লম্বা পা ফেলেছে।
একদিন তারা লম্বা -লম্বা রণপা -র মতো, লম্বা- লম্বা পা পেয়ে গেছে।
গাধা, ঘোড়া ও উট সকলেই পরম শ্রদ্ধেয়, তাদের খুরে নমস্কার জানাই।

ধন্যবাদ কবি গৌরাঙ্গ মিত্র-কে। চির শান্তির দেশে আপনি ভালো থাকুন। 
ভালোবাসা,প্রণাম ও শ্রদ্ধা নেবেন দাদা। 


Sunday, December 13, 2020

| নভেলেট | ডারউইনের চিঠি |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||
| নভেলেট | 


ডারউইনের চিঠি ~ ( পর্ব- ১৫ )
অরিজিৎ চক্রবর্তী




                                  
---"শোন কাকা তুমি একটা বুদ্ধি দাও। গ্ৰামের ব্যাপার বোঝোই তো! এখানকার আটঘাট তুমি ভালো জানবে। কি করা যায় বলো!"

---" কিছুই লয়। তুমি ষোলোআনাকে বলো! মুখিয়াকে একদিন সন্ধ্যায় ডাকো। তারপর খেতে খেতে সব হয়ে যাবে!" লালুকাকা কুটিল ঢঙে মিটিমিটি হাসে।

---" বলছো! তাহলে ডাকো একদিন। কিন্তু ব্যাপারটা ঘেঁটে যাবেনি তো!"

---" মোটেও ঘাঁটবেনি। ইংলিশ খাইয়ে দিবে আর ঝালঝাল মাংস। তোমার কাজ হয়ে যাবে। চিন্তা করোনি!"

---" মালগুলো ঠিক সুবিধার নয়। যাই বলো, পাল্টিবাজ।দেখি একটু চিন্তা করে দেখি কি করা যায়। এখনই কাউকে কিছু বলার দরকার নেই!"

সম্মোহ ভাবলো বিষয়টা লোকাল এমএলএ-কে  জানাবে। উনি সম্মোহের পূর্ব পরিচিত একজন সংস্কৃতিবান মানুষ। কিন্তু মনটা খচখচ করতেই থাকল। ঠিক ভরসা হলো না। কারণ এই ধরনের আঁতেলজীবি জননেতারা কি ধরনের হারামি হয় তা সম্মোহ জানে। সুতরাং তাড়াহুড়ো না করে বিষয়টাকে সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়াটাই সমীচীন মনে হলো সম্মোহের।

ডিনার শেষ করে বিছানায় শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে ফেসবুক লগইন করে বন্ধুদের পোস্ট গুলো দেখছিল। ফেসবুক রঙ্গ দেখতে বেশ মজা লাগে সম্মোহের। বহুদিন কিছু পোষ্ট করা হয়নি। আজ ইচ্ছে করলো..." প্রতিটি সম্পর্কের বাঁকে আত্মহত্যা লেখা থাকে" ( ফিলিং হ্যাপি )
সম্পর্কগুলো বেঁচে থাকে আত্মহত্যার উপর। কখনো আমি আত্মহত্যা করবো! কখনো তুমি আত্মহত্যা করবে। এই আত্মহত্যায় কখনো মাধুর্য, কখনো ক্ষমা, আবার কখনো বিষাদের আনাগোনা। না ইচ্ছে করলো না পোস্ট করতে। এত গভীর কথা বোঝার লোকজন খুব কম।‌সারা ফেসবুক জুড়ে একটা উপায় চালাকি। আহা উহু! তুমি আমাকে লাইক দাও আমিও তোমাকে দেব। এরসঙ্গে জুটেছে ওয়েব চ্যানেল গুলো।

একটা বাংলা ওয়েব চ্যালেলের নোটিফিকেশনে চোখ গেল সম্মোহের... "স্ট্রাইপের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসছে স্তনযুগল"

সম্মোহ খানিকক্ষণ ধরিয়ে তাকিয়ে থাকল। তারপর ছবিটাকে জুম করে দেখল। আহা অনন্য! স্কেচবুক খুলে বেশ কতগুলো লাইন ড্রইং করল সম্মোহ! অদ্ভূত ভাবেই ছবিগুলো কয়েকটা রেখার ইঙ্গিতে ধরা দিল। ভাবলো ছবিগুলো ফেসবুকে পোস্ট করবে। পোস্ট করলো।

--- "অনেকদিন পর এলে। চমৎকার!"

--- "দাদা, জাস্ট ফাটাফাটি।"

---- "ঝিঙ্কু সোনা ভালো লাগলো।"

---- "এই ছবিগুলো আমার চাই। আমার কবিতার সঙ্গে চমৎকার যাবে। এবার একটা বই করবো। তোমার ছবি আমার কবিতা।"

পোস্টের নীচে একেরপর এক কমেন্ট পড়ছে। সম্মোহ কোনো রিপ্লাই দিচ্ছে না। শুধু দেখছে!

ইনবক্সে মেসেজ এলো, "আমাকে কবে আঁকবে?"

সম্মোহ উত্তর দিল, " আগে আঁকাটা ভালো করে শিখি!" সঙ্গে স্মাইলি।

---" এই পাকা বুড়োকে এখনো আঁকা শিখতে হবে!"

---" আমি বুড়ো নই! যযাতি!"

----" তুমি একটা বুনো হাতি!"

সম্মোহ আর কথা বাড়ালো না। লিখলো, " ঘুম পাচ্ছে। কাল কথা হবে।"

---" তোমার এতো ঘুম পায় কেন সোনা! আমি কি নোনা! হিহিহিহি.. "

সম্মোহ মেসেজ সিন করে মোবাইলটাকে ফ্লাইট মোড করলো। কারণ এরপর ফোন করবে। সঙ্গে বিরক্তিকর ঘ্যানঘ্যানানি।দীর্ঘ দশ বছর হাসবেন্ডের সঙ্গে কোনো শারীরিক সম্পর্ক নেই। শুধু কোনো ক্রমে সংসারটা টেনে যাচ্ছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেঁচে থাকা ইত্যাদি ইত্যাদি। বেশির ভাগেরই গল্পটা প্রায় একই ধাঁচের। কোথাও একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায় প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের।

ব্রডওয়েতে মদ খেতে খেতে কৌস্তব বলেছিল, " এদের ফাঁদে পড়ো না। সব শালা সাইকো! যেচে যেচে কথা বলবে, প্রেম নিবেদন করবে তারপর হঠাৎ একদিন স্কিনলর্ট সহ ফেসবুকে পোস্ট! এবার তুমি সামলাও।

---" ছিঃ! ধিক্কার!"

---" মুখ যখন মুখোশ!"

--" ভাগ্যিস তুই লিখলি। ব্লগ করলাম বাঁদরটাকে।"

---" তীব্র প্রতিবাদ করছি!"

কৌস্তবের কথা শুনে সম্মোহ হেসে ফেলে।

---- "এতো জীবন্ত স্ক্রীপ্ট! তুই একটা ওয়েবসিরিজ বানা। জমে যাবে!"

একেকদিন ঘুমোনোর আগে কত রকমের ঘটনা যে চোখের সামনে ভীড় করে তার ইয়ত্তা নেই। ঘুম আসতে চায় না! যেন ঘটনা গুলো হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে আসে সম্মোহের দিকে।

আগে গুণী মানুষ বিখ্যাত কবি শিল্পীদের প্রতি বিশেষ অনুরাগ ছিল সম্মোহের। কত মানুষই থেকে খেয়ে গেল টাকা পয়সা না দিয়ে। সম্মোহ বিষয়টা খুব একটা আমল দেয়নি। বরং প্রশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু পরে কলকাতায় গিয়ে শুনেছে মানুষ গুলোর অসভ্যতার খিল্লি!

---"দাদা বাঁকুড়ার জঙ্গল কেমন ঘুরলে? আর বলিসনা ছোট্ট করে একটু পোঁদ মেরে এলাম। আমাদের খাওয়ালো আদর যত্ন করলো!"কফি হাউসে এক সত্তর্দ্ধো পেইন্টার এই কথা বলে গেছে সম্মোহকে নিয়ে। শুনে সম্মোহ কষ্ট পেয়েছে। আবার ভেবেছে এই বৃদ্ধ বয়সে এসব নিয়ে কষ্ট পাওয়ার কোনো মানে হয় না! এক জীবনে কম কিছু দেখল না সম্মোহ। হয়তো আরো দেখার বাকি আছে। দেখতে দেখতে জীবন নশ্বর হয়ে যাবে। জীবনের সঙ্গে এই নিঃসঙ্গ তাস খেলার নামই তো পেশেন্স! যেখানে বৈপরীত্য আলো-অন্ধকারের। স্থিরতা-অস্থিরতা স্বরের ধ্বনিপদার্থিক বৈশিষ্ট্যে আভাসিত। আলো অন্ধকারের সঙ্গে যেমন Acute-grave স্বলক্ষণের সম্পর্ক, তেমনি স্থিরতা-অস্থিরতার সঙ্গে Compact-Diffuse স্বলক্ষণের সহযোগ।