" এই মৃগয়াপাড়ের কারুকাজ ••• "
প্রিয় অনুজ প্রদীপ ,
অব্যবহৃত প্রজাপতিগুলোর ডানা থেকে বহুবর্ণ দেশ ও বহুবর্ণ মধ্যাহ্নের রাগগুলো যখন টুকরো টুকরো হয়ে ঝরে পড়তে লাগলো , তখনই মনে হলো এ তার অনুগমন নয় , ঐতিহ্য মিশে থাকে রক্তকণিকায় বিস্তারের প্রবাহে সুন্দর আসে নদী হয়ে | কবি যত নিমগ্ন হবেন , ততই মনে হবে এতো বর্ণনাতীত | মুগ্ধ এবং বিস্ময় মিশে এ কবিতা হলো মগ্ন চৈতন্যের | চেতনা অনেকটা সমুদ্রের মতো | গভীরে গেলে তার আর কোনও উদ্দামতা থাকে না | গভীরে গভীর ,
খোলসভাঙা নিরাভরণ | এবার অলংকার পরাতে হবে | কথায় কথা জুড়বে রিনিঝিনি
করে |
এখান থেকেই শুরু করা যেতে পারে
লম্বাদৌড় | পৃথিবীর ভরকেন্দ্রে একটা পাখিরালয় , অথৈ নোনা জলের ধারণা নিয়ে জড়িয়ে ফেলছে সুদূরের সম্ভাবনা , তার নিচে পিরিচের উপর একটা হৃদপিন্ড রাখা | সেটি
কার ! প্রথমত কবির | পড়া হয়ে গেলে পাঠকের আত্মা হয়ে ওঠে |
সহজ কবিতার খোঁজ হলো প্রজ্ঞা দিয়ে প্রতি মুহূর্তের জীবনকে সম্পৃক্ত করে তোলা , সেটাই বোধহয় সহজিয়া পাঠ ---
" কত আড়কাঠি টপকে অনন্য জলাশয়ে
লুকোনো গোড়ালি পর্যন্ত একটা অন্তহীন
সন্ধের খোঁজে "
( পৃষ্ঠা : ১০ )
হাপিত্যেশ করে বসে থাকা | তখনই টুকরো টুকরো জীবন শৈশব মাড়িয়ে মধ্যদিনের দিকে হেঁটে যায় | ছুটে নয় , দোদুল চলনে যায় |
তারপরই ভেসে ওঠে বিচিত্র সমাজের
কেরানিকুলের ইতিহাস | জাগ্রত স্বপ্ন থাকে মধ্যবিত্ত চিলেকোঠায় , থাকে , -
" ছায়ার মতো অকিঞ্চিৎকর মাছ অনেক অচেনা বেড়ালের ভিড়ে " বেড়ালের ত্রিনয়ন | আহা ! ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে ইশারা | যার কোনও শেষ নেই | কিন্তু আবার এও সত্য - , চিরসত্য বইতো নয় -
" রোজই তো শেষ দিন কারও না কারও " ۔۔۔
বলা হচ্ছে " কুয়াশা নাকি এলো , ঘুণ - চেরাই হয়ে ", মনে গেঁথে বসলো দুটি দৃশ্য -- একটি বানিয়ে তোলা চরণের হসিত বয়ান , আরেকটি চিরসত্যের নির্মল স্তব্ধতা , পাশাপাশি বসে অমর হতে চায় | এখানেই একজন কবির পরম কাব্যকারিতা | এখানেই কবিতার মহাপ্রাণ ۔۔۔ |
আমরা জানি এক একজন কবির দেখা একেকরকম | দেখা আসে কখনও চারপাশের চলমান বিশ্ব থেকে , আবার আন্তঃপ্রকৃতি
থেকে | দুটি ক্ষেত্রেই মন যা ছেপে তুললো বা ছাপিয়ে তুললো তার একটা রূপ ফুটে উঠবে কলমে , একটা আরেকটার পরিপূরক - সৃষ্টি এবং নির্মাণ | কিন্তু তোমার দেখার তৃতীয় একটি চোখ রয়েছে , যাকে তুমি সবচেয়ে বেশি সক্রিয় রাখতে চাও , সেটি হলো নিরন্তরের পাঠ , পাঠ থেকে পাঠান্তরে যেতে যেতে পাঠবিনির্মাণ ঘটে , তাকেই তুমি চোখ থেকে মনে , মন থেকে কলমে নাও | আসলে তোমার নিজস্ব পাঠ থেকে পাঠককে আরেকটা নতুন পাঠ দিতে চাও | পাঠকের সামনে একই সঙ্গে দুটো পাঠবস্তু খোলা থাকে | একটির পাতা ঝাপসা করে আরেকটিকে তুমিই উজ্জ্বল করেছো -
" সাবেকি চাঁদের ফেরিঘাট ধোয়া শীর্ণ মিজরাব থেকে
উপচে উঠছে আভোগী কানাড়া ۔۔۔"
( পৃষ্ঠা ১২)
আরেকটা এরকমই ধরে নেওয়া যাক | যেখানে আমি আমার সামনে তুলে ধরা ছবিগুলোর মধ্যেই শুধু ডুবে যেতে পারি | ছবি - গান - নাটক - সবকিছুর ক্ষেত্রেই একথা বলা যায় | আর রয়েছে সুরহীন বাক্যের ধ্বনিব্যঞ্জনা |
এই যে বিনোদবিহারীর ছবি থেকে কমলারঙের ভেতর একটা নদীর দিকে চলেছি ,
আমাদের যাওয়াটা থেমে নেই কিন্তু নদীটা থমকে আছে | স্থির জলের ভেতর খেলছে অগাধ শূন্যতা | এখানে পাঠকের কোনও বিনোদবিহারী নেই , রয়েছে মায়া -- প্রয়োগের মায়া , কুসুমিত উপকণ্ঠে একাগ্র নৈঃশব্দ | যা শব্দের নিজস্ব ঢঙে অর্জন করা ছবি প্রায় অদৃশ্য আরেকটি অবয়ব , -- কখন যেন দিবারাত্রির কাব্য হয়ে ওঠে ,
" দুই পংক্তির নিবিড় ফাঁকে ফাঁকে অঝোর নেচে যায় ۔۔۔ আনখ শরীর নেচে ওঠে ۔۔۔"
ঐতিহ্য তার নিজস্ব সত্তা নিয়েই বিস্তারের দিকে পা বাড়ায় , তখন অনেক বিবর্তনের চিহ্ন ফুটে ওঠে | অনেক শব্দ আবার নতুন প্রাণ পায় |
এখানে মাঝে মাঝেই আমরা শুনতে পাচ্ছি পুরাতনী গান , আসরে জমে উঠছে ধ্রুপদ , ধামার , জমে উঠছে মৌন মুখরতাগুলোও |
রন্ধন শিল্পটিও কম অর্জনের নয় | ছুটি ছুটি দিনের গন্ধে মিশে যাওয়া রান্নাঘর বলছে --
" লাউপাতা মুড়ে নারকেল কোরা অল্প চিনি নুন হলুদগুঁড়ো
রাইসর্ষে ইলিশ যেন পোয়াতি পেটের সোহাগ মাখানো " ( পৃষ্ঠা ১৫ )
যখন পরিবেশন করা হলো চেটেপুটে খাওয়ার আগেই আবার বেজে উঠলো --
" শব্দে এটুকুই ধরতাই ••• এটুকুই শাশ্বত বাসনাকুসুম "
যেন পাঠককে বলা হচ্ছে -- কুসুমটি কিন্তু পূর্ণবিকশিত নয় , আরও কিছু পাপড়ি খুলতে বাকি | কবিতার প্রতি নিবিষ্ট হওয়ার বেশ মজা করেই দেওয়া আছে , ক্যানভাসে স্তব্ধ হাওয়ার কথাও বলতে হয় |
এখানে বাঁকগুলো নানা পরতের | জীবন রচিত হচ্ছে ছায়া ছায়া আত্মচরিতবিহীনে | গহ্বরে ঢুকে যাওয়া বৃষ্টির মিশেলে অনেক রিনিঝিনি , ছলনা খেলছে , ধরা দেব কি দেব না করে শেষে খুলে যায় আরও একটি বন্ধ দুয়ার --
" হাতের বাঁধটুকু আলগা হয়ে পড়ে অসাড়ে •••
টের পাই আরেকবার ,
কায়া সাধো কায়া সাধো মাদল বাজছে
আর রোববার হতে চাইছে না ••• "
( পৃষ্ঠা ১৬ )
পড়তে পড়তে গোলাপীবালা উধাও হয়ে গেলো , রোববারের গ্রামোফোন আঁকা দরজাটাও মৃদু হাওয়ায় দুলছে | মাদল থেকে মুখর হচ্ছে শুধু একটি একতারার ধুন | যেন এই দেহতত্বে আর অন্য কোনও সাধন নেই |
একথার আরও একটা ধরতাই আমরা দিতে পারি - বৃষ্টি যখন সেই নিঃস্ব গাছ হয়ে ওঠে , চোখ ধারণ করে বিন্দু বিন্দু সাধনচিহ্নের নীল সনাতনী , ঢেউগুলো আর লহর থাকে না , হরণ করে নেয় স্তব্ধতাকে , নাটক হচ্ছে
ডাকহরকরার | এখানে কোনও শ্রেণীচরিত্র নেই ,
" এলোমেলো " ' আমি ' র সত্তায় কাপালিকতা , আসলে নিসর্গীয় ভূগোলকে এ শুধু রং বদলের খেলা , রসকলি --
" শরীরের দিকে তার বসতবাটি •••
সে কি জীবাশ্ম হয়ে যাওয়া একটা দেহবোধ
না সুরেন্দ্র বিনোদিনী ? " ( পৃষ্ঠা - ১৭)
এভাবে চিহ্নিত করে অনির্দিষ্ট যাত্রার অভিমুখ , লেখা হয় গন্তব্যহীন এক ফেরিওয়ালার ডাকভাঙা দুপুরের অফুর কাহিনী | " সুরেন্দ্র বিনোদিনী " হয়তো অনেকের কাছেই অধরা থেকে যাবে , কিন্তু খোলসটি ছাড়ালে এ দেহ ভান্ডার অটুট অরণ্য হয়ে যায় , আর সমুদ্র হয় ধ্বনিহীন |
বনবীথিতলে পুতুল খেলছে দেহ ও মন , খেলছে জাগরণের ভোর | যেমন অমর ও নশ্বরতা -- খেলাটা জীবনাভিজ্ঞতা নিয়ে | মন যত গভীরে যায় , ততই পথ যেন সহজ হয়ে
ওঠে | এই স্বস্তিটুকু সাম্প্রতিক কবিতায় রয়েছে |
বাসনাকুসুম পাপড়ি মেললে ভেতরে থাকে আধখানা চাঁদ -- এটাও একরকমের দেখা | আবার বাড়িটার নাম যদি হয় গোলাপীবালা , নীল প্যারাসুট খুলে নীচে নেমে যাওয়াটা তখন কিন্তু শুধু নৈসর্গিক নয় , এক আশ্চর্য বোধ , যা দৃশ্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে | তারপর ভাসতে থাকে | যেমন ভেসেছে ' সওদাগরের নৌকো ' দুখানি , ' দামিনী বিজুরি ত্বরিত জলে ••• ' ভেসে যাওয়াটা হলো ভাষার টান | হাজার বছর ধরে ভেসে চলেছে নদীমাতৃক দেশ - গ্রাম - মানবজমিন দুকূল ছাপিয়ে | বোবা পৃথিবীতে আমাদের পেছন ফিরে তাকাবার সময় বড্ডো কম | আমরা ছুটছি , ছুটল বাণকে কি যত্নে নিবারণ করা যায় !
শব্দের ব্যবহার সবসময়েই নজরে পড়ে , গতির ভারসাম্য ও খুব নিমেষ ফেলে ফেলে | আমরা অতিক্রমকেও দেখছি , আঙুলের নিটোল পর্যন্ত সে পৌঁছে যেতে চায় , রয়েছে পরিধেয় কারুকার্যের স্বাদ নিয়েই |
পৃথিবীর শেষ বিপনীবীথিকে খুঁজতে গিয়ে প্রায় পথ হারিয়ে ফেলছিলাম , কিন্তু কাকতাড়ুয়াটা ঠিক চিনিয়ে দিলো , নিমিত্ত বিজনটুকু আরও কত যে সুদূর | এই যে ছয় রিপু ছয় ঋতু দিয়ে মোড়া বা রিপুগুলো ঋতুর নরম আগুন দিয়ে গড়া এরও কিছু টোকা
থেকে , পুরোটাই ইশারা নির্মিত | পুরোটাই নির্ভর করে পাঠক কীভাবে নিচ্ছেন |
' বিভাজিকা ও বিনোদবিহারী ' সিরিজের মান্যতা আরও গভীর , যেন নিজের সঙ্গে অনেকটাই কথা বলে যাওয়া | ছবি থেকে ছবিয়াল , সেই দেহ , সেই অবয়ব , আকারে - নিরাকারে আরও একবার পড়ে নেওয়া গেলো --
' পরিত্যক্ত সিঁড়ির ধাপে বসে রয়েছে
অস্ত আকাশ খেলা ' ( পৃষ্ঠা ২৬ )
হাওয়ার ঝিরি ঝিরি বইছে , দিনফিরতি বাসে তুলে দেওয়া চায়ের গ্লাস তার রঙ ধোয়া চৌকাঠের ওপারে বন্ধ কারখানার পাঁচিলে অপলক একলা খেলছে | খেলতে খেলতে ভেঙে শুনশান কয়েকটুকরো | কত কত শব্দ প্রজাপতি হলো , কত মন রঙরসিয়া --
' সমস্ত রাত জ্যোৎস্নার মাঠ পার হয়ে
কেউ লাফ মেরে উঠে আসে বারান্দায় | '
( পৃষ্ঠা ২৭ )
এরপর শব্দরা কথা বলতে শুরু করে নিজেদের সঙ্গে | প্রতিটি শব্দ স্বমহিমায় নৈর্ব্যক্তিক হয়ে ওঠে | কী চমৎকার তোতা - নকশা | গোলকধাঁধা আজও অলীক ও নরম , ঝড়ের রেশম ছিঁড়ে দেখতে চায় , দেখার শেষটুকু | দেখা হয় না শিশির বিন্দুগুলো | দু পা ফেলে মন তখন তো ঘরের বাইরে |
যে কবি রক্তকরবীর উৎস শুষে নিয়ে কলমে তুলছেন গ্রন্থিত পৃথিবীর ভোর , তাঁর ব্যক্ত অনুরাগ , তাঁর ধ্যান গৃহস্থ হতে চায় | কিন্তু নৈঃশব্দ্যের ঘুলঘুলি দিয়ে ঢুকে পড়ে ঘরহীন নিখিলের ব্যস্ত ওঠানামায় | তারপর অকূল
ছেঁড়া , প্রণয় যশ , বিভঙ্গ , -- তালে পড়ছে জীবিত রাগ , -- ঘুঘুচরা --
' এখানে ' ঘুঘু ' শব্দটার সমুদ্র ছিল
অশেষ অসঙ্গতির জড়রূপ ' ( পৃষ্ঠা ৩৩ )
আমাদের খুব নিবিড় হয়েই বাজিয়ে নিতে হবে অসঙ্গতিকে এবং কোথায় তার জড়ত্ব - সেটুকুও নিজের মতো করে দেখে নিতে নিতে ঢুকে পড়তে হবে দহন ভূখণ্ডে | খন্ড খন্ড তাপ ও চাপের ব্যাসার্ধে এই অহর্নিশ , শেকড় বাকড় ,
চালচুলো , নিষেকের উজ্জীবন , ঝড় উঠলে হড়পা বান , বন গাইবে সর্বগ্রাস •••
নদীর ভেতরে স্তব্ধতা কতটুকু কালে তাকে খুঁজতে আরেকটা ডুব , তোমার অয়দিপাউস , তোমার মদনভস্ম পালা | সেই রাধারানী , সেই মাহেশের রথের মেলা | আমি না ঝড়ের সমগ্রে এক অপরূপ সন্ধ্যাকে সেই কৈশোর থেকেই দেখতে পাই | কিন্তু আমার বাগানে পলাশের মতো আর কোনও পলাশ হবে না | শুধু লাশ , শব্দের শব বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা | শববাহকেরা বোবা | কিন্তু বোকা নয় | মনে মনে রৌদ্রপলাশের গান রচনা করে চলেছে প্রত্যেকে এক কলি | আগুনে ঘৃতাহুতি নয় , এক অন্তত শব্দাহুতি দেবে | তারপর নাভিটি ভাসাবে অবিনাশ ছলাৎছলে |
এসব কথা হয়তো পাঠকের নিজস্ব , কিন্তু কবির কলম বলছে --
••• ' কেউ কি চাঁদের দিকে তেড়ে গেল ?
সেই নবনীত বিড়াল -- ছড়িয়ে ছিটিয়ে খাও ,
পরস্পর ••• আপাদমস্তক রোঁয়া ••• '
( পৃষ্ঠা ৩৬ )
কটিবাস , গন্ধ , রেলিং , কার্নিশ -- এরপর শুধু অনুষঙ্গ মাত্র | আমরা ভেসে যাই জলের প্রতিমায় , শরীরের ভাঙ - এ ভাঙন চিহ্নগুলো দাগহীন | একটা ফুরসৎ , তারপর | তারপর তেষ্টা চুয়িয়ে পড়া |
সমস্তটাই নিজস্ব | প্রদীপ কথিত | এক রহস্য থেকে আরেক রহস্যের পথে যেতে যেতে ফিরে আসার টান আর থাকে না | তবে সমস্তটা ভেতরে নড়ে চড়ে , রক্তপাত লুকিয়ে ফেলে |
কিন্তু ক্ষরণটা চলছে | শব্দের খনন আর আত্মের ক্ষরণ মিলে এই জবাকুসুম , মন পিলসুজ জ্বলে , জ্বলতেই থাকে | আমাদেরও মনে হয় --
' শব্দটি একটু টাল খেলো এমনকি ইশারাও !
অসম্ভবের গাঢ় কড়িকাঠে কীভাবে যেন চিবুক ,
জড়িয়ে আছে বেশ ক' টি প্রকোষ্ঠে | '
( পৃষ্ঠা ৩৮ )
এরপর অন্নদাশঙ্কর রায় যা জানাচ্ছেন তা নিশ্চুপ ভঙ্গিতে আরেকটি রক্তপ্রবাহ | আলপথটা পেরোতে হবে , কখনও বুকের আলপথ , কখনও চোখের | চোখ সইতে না সইতে নুপুর শব্দ | ধ্বনির মধ্যে দৃশ্য , দৃশ্যের মধ্যে ঘ্রাণ , মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকানো | আশ্চর্য সিঁড়িখানা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে নেমে যাচ্ছে অন্তহীনের দিকে --
' দৃশ্যসীমা ক্রমশ নেমে আসে |
দীনতর ক' রে বিক্ষত প্রতিরূপ ••• '
( পৃষ্ঠা ৪০ )
বইছে এক এক পরতের হাওয়া , তার সঙ্গে ফুটে ওঠা প্রহরগোনা ছায়া | টলতে টলতে ভেজাচুলের গন্ধে পাথর ও ঝর্ণা | পথ কি কখনো একা হতে পারে ! ওই যে একপশলা মানুষের দেশে কত কত অপেক্ষা জমেছে ! শিশির পড়লে হাসিও নামবে | নেমে নেমে আরও গড়িয়ে যাওয়া |
' ঢাক ও মেয়েপুতুল ' কবিতায় চলনটা শুরু হয়েছিল একেবারে অন্য এক প্রদীপের ছাপ নিয়ে | যেখানে বলা হচ্ছে --
' ঢাক বলতে আল্টিমেটলি আমি বুঝলাম একটা কাঠের কুঁজো যার ওপর একটুকরো চামড়ার পলাতক লেগে থাকে ••• ! '
( পৃষ্ঠা ৪৫ )
' আল্টিমেটলি ' এবং ' পলাতক ' শব্দদুটি একেবারে অন্যমাত্রা থেকে ব্যবহৃত হয়েছে |
এর যা অনুরণন এবং যা মেজাজ সেটা শেষপর্যন্ত অন্য বোধে নিয়ে ফেললো | গোটা কবিতার মধ্যে পাঠকের শ্বাস নেওয়ার কোনও জায়গা নেই | অথচ ' পলাতক ' শব্দটি কী যে বাজছে ! আহা !
অবশ্য একজন কবিয়াল পৃথিবীর নিসর্গে ঘুরে ঘুরে , হারানো চোখ , হারানো স্থপতি থেকে অমূল্য তুলে তুলে আমাদের যা দেন তা মহার্ঘ ,
তা পরমান্ন | তাঁরই রচনা ' চিরহরিতের টোল ' |
এই টোলে আমাদের পাঠ দিচ্ছেন তিনি , চাঁদের পাঠ , জগৎকুয়াশার পাঠ , আরও আরও ঘন ঘোর | একবার ডুবে বসি , আবার ডুবে যাই | শুধু ' যাওয়া - আসা ', খেয়া পারাপার --
' কারো জানলা থেকে যতদূর , ততদূর খেয়ার অবকাশ ••• ' ( পৃষ্ঠা ৫৩ ) ছোট্ট প্রাণ নড়েচড়ে , কিন্তু একজীবনে অবকাশ কি আর ফুরোয় ! কতটুকু আর দেখা যায় ! আবার জীবন তো সেই একটাই | কী যে করি --
' একটা গন্ধের বকুল যদি প্রবাসী হয় ,
প্রবাসী পাখিরা বিজনে ওড়ে
রঙ রেখা জঙ্গলের ভোরে ••• ' ( পৃষ্ঠা ৫৪ )
কবিয়ালের সব সুর ইশারাচিকন দু গালের টোল খুটে খুটে তুলছে | কিছু পাখি মাছরাঙা , কিছু পাখি বেনেবউ | আর কাগজের পাখিরা !
তারাও তুলছে ইচ্ছে রঙের ডানায় দু ' একটা স্পর্শ ছলাৎছল , স্রোতধারা ••• |
ছায়ার খেলা বুঝতে বুঝতে অনেকটা পথ পেরিয়ে এলাম , যেন অনেকটা জীবনও | বিন্দু বিন্দু ফেলে রাখছি মোহতাপ , অঝোরমোহিনী |
স্মৃতিময় ۔۔۔
' কুহেলিকা মোড় , পেরিয়ে ক্রসিং , ছায়াতে কুপার্সক্যাম্প
দুধফোটার উপনিবেশ ••• ' ( পৃষ্ঠা ৫৯ )
একে ঠিক কত মাত্রা দেবে ! আরও নির্জনে নেমে যাওয়া অফুর নদীটি | কত কথা বলতে চায় ! নুড়ি ভাঙে চোখের ছেনিতে | না থেকে
নয় , নয়ে নয়ে শূন্য আঁকা একটা রোবট , তার জন্ম , তার 'জন্মের ভ্রুণ ' একটা স্বপ্ন দেখে , একটা স্বপ্ন আড়মোড়া ভাঙা |
আরও একটু রাত্রি নিবিড় হলে আমাদের আকালের সন্ধান নেমে পড়তে চায় পাতার উপসর্গে | পাতায় পাতায় ফিরছে পরিচর্যা | তার গাঙ্গেয় বঙ্গের গোলক -
' কাঁটায় কাঁটায় চুলের ঈষৎ
নুয়ে পড়া সন্ধে ' ( পৃষ্ঠা ৬৭ )
'তিমির ' এখানে ঘননীল বিশ্বের অন্য এক ছায়া ,
অন্য এক ছবি | কাটা কাটা ছায়াছবি | চলছে তো চলছে , বুকের বাঁশিতে মোহন বাজছে | ভোরের পাখি , দেহের পাখি আলাদা আলাদা দৃশ্য তুলছে | মনদরিয়ায় উড়ান দিচ্ছে
সূক্ষ্মতারা | ফাল পাড়ছে এলোকেশে | মেঘবসনে গোলকধাঁধা | ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এক শূন্য থেকে আরেক শূন্যে ছুঁড়ে দিচ্ছে উন্মাদনা |
বোধের গভীরতা এবং ভাবনার নিবিড় যেখানে এসে মেশে তার দেয়ানেয়াটুকুই মনদরিয়া | উথালপাথাল | কিন্তু বাইরে তার প্রকাশ কম | যেন বস্তুকণার সব রহস্যই অনামিকার খেয়াল | যেন --
' বিতানের জল কখনো জল হয়ে ওঠে না
লম্বালম্বি চিরে গেছে বিতানের এই দৃশ্য ' •••
( পৃষ্ঠা ৭০ )
বারীনদাকে উৎসর্গ করা হয়েছে ' ফিরে আসার গল্প ' দুটি পর্বে | এ কবিতায় যে অপসারণের শব্দ আছে তা কোনও সমীকরণেই মেলে না | তোমার পাঠ নীরব এক উঠোন , সেখানে যখন রোদ এসে পড়ছে তা মিহিসুতোয় বোনা | এই প্রবেশদ্বারটি যখন উন্মুক্ত হলো তখন বারবার মন বলছিলো অন্ধ আবেগ দিয়ে কোনও অনুসরণ হয় না , অতিক্রান্ত দিনের শেষে রক্তিম আভাটুকুই অশেষ রচনা --
' একটা দেশের দারুহরিদ্রায় সজনে গাছের বহর
সমান মগডালে ডেকে ডেকে ক্লান্ত একফালি পাখির গ্রন্থিত সহচরী ,' ( পৃষ্ঠা ৭১ )
চলমান অন্ধকারের মধ্যেও এক একটি মুখ ভেসে ওঠে | সত্তা তাদের উজ্জ্বল করে রাখে |
সামান্য দিগন্তই তখন অসামান্য | সরল পসরা প্রদীপ সাজাতে পারে না বলেই সে ঠিক তার মতো | পুরোনো বন্ধুর পুরোনো একটা বাড়ি ছায়া দেয় আকাশ থেকে কখনও মাটিতে পড়ে না | আমাদের এই পাঠ নিজেদেরও কিছুটা শিক্ষিত করে তোলা | ' অব্যবহৃত প্রজাপতিগুলো ' আমাদেরই ঘিরে ডানা মেলছে রঙ ফেলছে | আরও একটি বাঁকের অপেক্ষায় দাঁড় করিয়ে রাখতে চাইছে | আসলে আমাদের যেন স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছে --
' যারা কবিতাকে ছুটির সঙ্গী বলে ভাবে , কবিতার প্রতি ছত্র পড়ে হৃদস্পন্ধন অনুভব করতে চায় তাদের কবিতা না পড়াই উচিৎ | •••'
( সুধীন্দ্রনাথ )
কবিতা রয়েছে তার সমগ্রের মধ্যে , বহু পরতে , নানা রঙের আলো নিয়ে রহস্য নিয়ে | আমরা হয়তো একটু খন্ডাকারে দেখে ফেলি |
যাহোক সন্ধান তো জারি থাকবেই | স্বকীয় এবং স্বনির্মিত ভাষায় পৌঁছতে একজন কবি নিরন্তর নিজেকে ভাঙবেন , আবার গড়তে থাকবেন | এখানেই সেই সত্য --
' দুরূহ আঙুলগুলো হাতে জড়িয়ে
অঝোর অর্জিত
এবং
অন্তিম শ্বাস মেপে নৈর্ব্যক্তিক ব্যাভিচারী ' •••
( পৃষ্ঠা ৭০ )
এভাবেই নিগড় শব্দের সরগম শুনে চলেছি আমরা | চলতে থাকি |
ভালো থেকো , এই শুভ কামনা |
ইতি ,
প্রিয়জন চিত্ত দা , ১০ / ৫ / ১৮
ছবি ঋণ≈ শ্রীমহাদেব (বাঁকুড়া)
তিন •
একটি গভীর কলগার্ল
মিরিক থেকে ফিরে আসছে
চাঁদনিরাতে সীমান্তরক্ষী সৈন্যদের ঘোড়া
হাসছে দুলছে রাম খাচ্ছে নাইটক্লাবের বারে
এপার থেকে সোনা ওপারে যায় •••
মিনিয়েচার হাতিদের নিজস্ব পথ
অন্নহীন রসহীন মাংসহীন ক্লেদহীন
বিজন পৃথিবী
আগুন জ্বলছে কাঠের আগুনে
গ্রীষ্মে বিষুবরেখা টপকে দুজনেই বেরোবো শিকারে
মেঘেদের ধানক্ষেতে একলা ময়ূর
এক দূরাগত নদী আছে , নেমে যেতে হবে
ক্ষুৎপিপাসার নীলাজ কিনার ঘেসে
ফুটে উঠলো স্তবকে স্তবকে ,
ঝরে পড়তে থাকলো কয়েকটা ছায়াশরীরী রহস্যময় ছায়ার মধ্যে ডুবে
যখন বাড়িটা আমার মধ্যে ঢুকে জানলা দরজা খোলে
পৃথিবীকে ঢেকে দেয় ময়ূরের কলাপ
ছায়াহীন শরীরী নটী নিঃশব্দে আসে , আবার নিঃশব্দে চলে যায়
শিখরের পর শিখরে আঘাত করে ভোরবেলা •••
চার •
লতানো ঝরোখাখানি ছায়াচিত্র |
রক্তের দহে গিয়ে ঘুম ভেঙে দেখি
বেহিসেবী স্বপ্নধ্বংসী একরোখা মানুষটার
পাকদন্ডীতম বিন্দুর কাছে
ঠান্ডা বরফকুচি দেওয়া দুধ এমনকি মাতৃদুধও
তার চিরহরিৎ তেষ্টা মেটে না
প্রিয় প্রেতকথা , মুজরা চটুল ভানুমতী খেল
পুতুল ঠমকী দেহহীন সূক্ষ্ম তমসমা
থেরীগাথার মধ্যে , বৈশালীর রাস্তায় উপাসিকারা
অবৈধ টক কুল খেতে ইচ্ছে হয় , সল্টেড ইমলি
টক টক গন্ধে শরীরের প্রাতরাশ তুলে দেয়
ভারতীয় গোধূমখেতের মধ্যে বিবমিষা
সাক্ষী : শরৎশশী
টোল পড়ে ডিমের কুসুমে
কিছু মদ্দা হুল্লোড়বাজ ,
মাস্টারবেট করতে করতে মহাকাশে
নিমিত্তমাত্র হয়ে এ ওকে ছেদ করে যাচ্ছে
ছোট ছোট কাষায় বস্ত্র পরে মস্তকমুন্ডিত মেয়েরা চলেছে
উদাসী মনে জগৎ ভ্রমণ করছিলেন তথাগত
শরীরে নৌকোর দুধ - উথলে কাগজের সাম্পান চলে আসে
পুব - দখিন দোর খোলা ,
এতো হিমেল ' তমিস্রা ' অথির তরঙ্গ ,
তার বিজাতীয় নৌকো চলেছে একা
অন্ধকারের কোনো কোনো অংশ জ্বলে ওঠে
ধ্বক ধ্বক করা রক্তমাংসেডোবা মন
ডুবতে ডুবতে নৌকোটি সাপের পেটের রঙ নিয়ে চলেছে নিরুদ্দেশে •••

ছবি ঋণ≈ শ্রীমহাদেব (বাঁকুড়া)
পাঁচ •
শিবিকার ভেতরে বসে একজন মানবী শুধু
মাধ্যাকর্ষণ শাসিত |
রক্তের গন্ধের মধ্যে স্বল্পায়ু লৌহকণা
ফলত জলের অস্ত্রাগারে সাড়া প'ড়ে গেছে
সর্বাঙ্গীন আমার শরীরে তার নিজস্বতা অর্জন ,
জলীয় নক্ষত্র হাইরোগ্লিফিক
দীর্ঘতমা জলসরস্বতীর চুলে টক গন্ধ বাসি আলো ,
ছুরির ফলায় তৈরী হচ্ছে একটা লম্বা ফাটল
স্বপ্নে চাঁদের আলো চেনা যায় না
কোনদূর ছাপোষা পিলসুজ জ্বলছে নিভছে
কাছাকাছি
নদী পাড়ে পালযুগের পসরা নিয়ে মেলা বসেছে
বাতাসে মরা শ্রমণের পচনধরা পেশী ,
ভয় ও খনন
মুখগুলো সারারাত ব্যথায় নীল হয়ে ফিরে আসবে
একটি ন্যূনতম সারমেয় একা একা লেজ নাড়ছে
কতদিন পর ভুয়াং দুলিয়ে ফুল ফোটে
মানবীর আলটপকা বুকের নীচে কথিত চাঁদ
ঈষৎ সন্ধিহানে জষ্টিমাসের কালোজাম টুপটাপ খসে পড়ে •••