Sunday, January 30, 2022

কবিতার ডালপালা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||   অরিজিৎ চক্রবর্তী  

কবিতার ডালপালা ( চতুর্থ পর্ব )

রঞ্জিত সিংহের কবিতার এই উদ্ভব, অভ্যুদয় ও পরিণতির যে চিহ্নায়ক ও চিহ্নায়িত ধ্বনিরূপ, তার ডায়াক্রমিক স্পন্দন অনুভব করতে করতেই আমরা ভাষার সজীব রূপ-রহস্যের দিকে এগিয়ে যাই। তখন বস্তুজগতের নির্দশক অর্থ থেকে যা বিশিষ্ট। কারণ, আমরা ততক্ষণে মনের চোখে প্রত্যক্ষ করি কবিতার ক্রিয়াশীলতা।

ভাষাতাত্ত্বিক সোস্যুরের উত্তরসুরী ইরাকসন ভাষাতত্ত্বের আঙিনা থেকে কবিতার ক্রিয়াশীলতা সম্পর্কে তাঁর প্রাজ্ঞ অনুধাবনে জানিয়েছেন, " The poetic function projects the principal of equivalence from the axis of selection into the axis of combination" একদিকে নির্বাচন, অন্যদিকে গ্ৰন্থনা। শব্দ ও অর্থের সম্পর্ক যখন আপতিক, দার্শনিক চার্লস স্যান্ডর্স পার্সের বিবেচনায়, তা প্রতীক। কিন্তু কিভাবে? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে কবির অন্য একটি কবিতার দিকে মনোনিবেশ করছি।

" সময়ের কখনো পর্যঙ্ক বা কেদারা থাকে না।
পনেরো বছর কোথা দিয়ে চলে গেল---
বাঁশবন, শালবন, একর একর মহুয়ার বন।
একশো আটটা পাঁঠাবলির রক্তে টিলার সারা গা ঘন লাল।
বড়ো বড়ো সিঁদুরের টিপ, লাল পলাশফুল।

মণিকাকে আজকাল সেইভাবে মনে পড়ে না।
জ্যোৎস্নার জোয়ারে আড়াল দিয়ে চাঁদ যেমন
লুকিয়ে-চুরিয়ে রুপোলি হাসির ঝলক দিতে দিতে
চলে যায়, মণিকা তেমনিভাবে, ঠিক সেইভাবে,
হাসির ঝলক কখন যে জোয়ারের বেগে চলে যায়
সারারাত ইজিচেয়ারে বসে থেকেও একদিনও ঠাহর পাইনি।

চমকে উঠি। পরক্ষণে বুঝি ভুল, আমার বয়সের ভুল।
চোখ যেমন সবসময় ঠিক ঠিক দেখে না, এও তেমনি
সেই ভুল দেখা।
রাত্রে সিঙ্গল খাটে ঘুমোচ্ছি, এটা আমার আজীবনের সিঙ্গল খাট,
ওটা আমার পনেরো বছরের ইজিচেয়ার, যে-রাত্রে
ঝাঁক ঝাঁক বাদুড় সফেদাগাছটাকে ঢেকে ফেলে সফেদা খায়,
আমার আর মণিকার সে-দিন জন্মান্তর হয়, দুজনেই বাদুড় হয়ে যাই।

বড্ড বুড়ো হয়ে গেছি, চোখদুটো খুলতেও পারি না, বন্ধ করতেও পারি না।
লেপটা জড়িয়ে ধনুকের মতো বেঁকে শুয়ে থাকি,
পাশ ফিরলেই পিঠ থেকে লেপ সরে যায়,
একটা উষ্ণ তাপ মাঝে মাঝে অনুভব করি,
কে যেন লেপটায় পিঠ ঢেকে দেয়, রাত্রে দু-বার তিনবারও,
কে যেন লেপটা টেনে দেয়।

সকালে উঠে হঠাৎ একদিন দেখি, টিলার গায়ে রক্তের একটুও দাগ নেই,
পলাশের বনে একটিও সিঁদুরের টিপ নেই।

( মণিকা সম্ভবত বিভ্রম )

কবিতাটির নাম 'মণিকা সম্ভবত বিভ্রম'। অর্থাৎ কবি নামকরণেই জানিয়ে দিচ্ছেন মণিকা সম্ভবত বিভ্রম বি. ১. ভ্রান্তি (দৃষ্টিবিভ্রম); ২.(প্রধানত প্রণয়জনিত) মানসিক চাঞ্চল্য বা বিমূঢ়তা; ৩. লীলা; ৪.বিলাস; ৫.শোভা। [সং. বি + ভ্রম]। সুতরাং এখানে আমরা কবিতাটির চিহ্নাবলির তিনটি বিষয় খুঁজে পাচ্ছি। প্রতীক ( Symbol ) , সূচক ( Index ) , এবং প্রতিম ( Icon ) । কবিতাটির আরোপিত অভিজ্ঞানে ভাষার শব্দচিহ্নগুলোও তেমনি ধ্বনিরূপ ও ধারণার আপতিক সম্পর্ক- সঞ্জাত। সূচক ও প্রতিম মূলত বাচনিক নয়, চিত্রধর্মী। যেমন- 'বড়ো বড়ো সিঁদুরের টিপ' থেকে লালপলাশ ফুলের ধারণা কিংবা ' একশো আটটা পাঁঠাবলির রক্তে টিলার সারা গা ঘন লাল' অর্থাৎ অস্তগামী সূর্যের ধারণা। আর এই সমস্ত অনুভবের প্রকাশস্তর থেকে দ্যোতনার প্রকাশস্তরে উত্তরণের অবকাশটি কবি নিজস্ব সূচকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। কবি তুলে ধরলেন তাঁর নিজস্ব চিন্তার সিনট্যাক্স-- প্রদত্ত পুনরুক্তি ও প্রবর্তিত নতুনের মাধ্যমে নিজের ভিতরের বিবাদী ভাবনার রূপায়ণ। 

' বড্ড বুড়ো হয়ে গেছি চোখদুটো খুলতেও পারি না বন্ধ করতেও পারি না' 

সাপেক্ষ অঙ্গবাক্য আর স্বাধীন অঙ্গবাক্য--- এই দুয়ের মিলিত মালকোষে রঞ্জিত সিংহ বাংলা কবিতায় একটি চিরকালীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। " ব্যাগভর্তি সন্ধ্যাতারা" কাব্যগ্রন্থটির প্রতিটি কবিতায় এই স্তরবহুল আকস্মিক উন্মোচনের প্রতিষ্ঠা দেখতে পাওয়া যায়। শুধু অভিধাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না কবিতার ধ্বনি। সহসংবেদনের স্নায়ব সূত্রে তা রূপকধর্মী হয়ে উঠতে পারে। যেমন-

"সকালে উঠে হঠাৎ একদিন দেখি, টিলার গায়ে রক্তের একটুও দাগ নেই,
পলাশের বনে একটিও সিঁদুরের টিপ নেই।"

ভাষা কিভাবে অভিধেয় অর্থ থেকে দ্যোতনা অর্থে পৌঁছে যায় তার একটি মডেল দিয়েছেন রোলাঁ বার্তে। অভিধেয় প্রকাশস্তর থেকে দ্যোতনার প্রকাশস্তরে উত্তরণের ছকটি তিনি এভাবে দেখিয়েছেন---

( ছবি লক্ষণীয় )


বার্তে চিহ্নকে দেখেছেন ECR- র সমবায়।

E -- an expression ( or signiffier )

C -- a content ( or signified )

R --- in relation 

আমি রঞ্জিত সিংহের কবিতার আলোচনার প্রসঙ্গে বার্তের পরিধেয় ভাবনার মডেলটি সঙ্গত ভাবেই গ্ৰহণ করেছি। কারণ, তাঁর কবিতার সাপেক্ষ অঙ্গবাক্য আর স্বাধীন অঙ্গবাক্য গৃহীত ও যোজিত অংশের পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনে সাবলীল। বাংলা কবিতায় এই ধরনের অভিজ্ঞান খুব একটা চোখে পড়ে না। আর পড়ে না বলেই কবিকে থেকে যেতে হয় পাঠকের সচেতন অন্তরালে। প্রাসঙ্গিক ভাবে কারণ সেই একটাই। কবিকে হত্যা করার নিহিত কৌশল। ভাবলে খারাপ লাগে বাংলা কবিতায় মনীন্দ্র গুপ্তকে নিয়ে যে লম্ফঝম্প, যে উচ্ছ্বাস; রঞ্জিত সিংহের কবিতা নিয়ে তেমনটা দেখা যায় না। হয়তো দেখা হয় না।

কবিতার চরম ও পরম চেতনায় দশকের পর দশক ধরে এরকম উৎকণ্ঠা প্রযুক্ত করা হয়। কারা করেন এই প্রযুক্তির কাজ? তাঁরাই করেন যাঁরা 'কবিতা' বাদ দিয়ে সবকিছু করেন। তথাপি কবিতা জেগে থাকে আশাবাদের অলংকার নিয়ে। 

ফিরে দেখা-- ১
----------------
কলকাতার গনেশচন্দ্র এভিনিউতে শতাব্দী প্রাচীন পানশালা ব্রডওয়ে। বাংলা কবিতার দুজন স্বনামধন্য কবির সঙ্গে আমিও পৌঁছে গেছি সেই সন্ধার মায়াবী আলোচনার জগতে। আলো, মায়া আর নৈকট্য নিয়ে সেই ঘন্টাখানেকের আলোচনায় উঠে এসেছে কবিতার প্রকৃত প্রস্তাব। বাড়ি ফিরে একটা ঘোরের মধ্যে কিছুদিন কেটেছে।

মাসখানেক বাদে সেই সন্ধ্যায় উপস্থিত এক কবির বাড়িতে পৌঁছলাম। কথা প্রসঙ্গে আবার কবিতার আলোচনা।

বর্ষীয়ান কবি প্রশ্ন করলেন, ক- এর কবিতা কেমন লাগে?

আমি বললাম, ' খুবই ভালো লাগে। ওনার কবিতা পড়লে একটা পরিত্রাণ অনুভব করি।'

বর্ষীয়ান কবি বললেন, ' তুমি বাল বোঝো কবিতার!'

----' কেন দাদা ? সেইদিন আপনিও ব্রডওয়েতে বসে কত প্রশংসা করলেন ওনার কবিতার। উনি লাজুক কন্ঠে বললেন, ' আরে ছাড়ো অরিজিৎ, ও আমার বন্ধু তো, তাই আমার কবিতার প্রতি দূর্বলতা!'

--- ' দাদা সেইদিন ওরকম বললেন কেন?'

হা হা হা হা... ম্যাচিউরিটি এলো না তোমার ! ওরকম বলতে হয়। আসলে ও কিছু লিখতেই পারে না।

কেন এরকম বলতে হয় হে অগ্ৰজ? আপনি যে সব গুলিয়ে দিলেন। আসলে বাংলা কবিতায় এই গুলিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা যুগে যুগে অব্যাহত।



Friday, January 28, 2022

গার্গী সেনগুপ্তের কবিতাগুচ্ছ

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||     গার্গী সেনগুপ্তের কবিতাগুচ্ছ


অনাময়


নিস্তব্ধতা প্রেমিকের ডাক নাম
বিষণ্ণতাই মেঘেদের  প্রিয় মুখ
বেখেয়ালে যদি দিন যায় কার ক্ষতি
অনাময় পেতে জেগে থাকি উৎসুক।

আকাশের বুকে নীলখামে লেখা চিঠি
বৃষ্টিরা জানে ঝরা পাতাদের মন
সূর্যের আলো সব মানুষের ঘরে
উষ্ণতা দেয় আজীবন, অনুখন।

দুর্বোধ্যতা মনোযোগ ভালো বাসে
শূন্যতা গায় সকালের শিসপাখি
সব স্থলভাগ ভাইরাসে আঁকলেও
পৃথিবীর গায়ে শুশ্রূষা লিখে রাখি।।


বিভাস

১.

ধূ ধূ ওড়ে বালি
চর জাগে অনন্তের
চাবি পড়ে আছে
চির গহনের কাছে
মুখ তুলে দ্যাখো
ও আকাশ,ভাঁটিফুল
বলো ভুলে গেলে কেন?

২.

সোহাগী দোতারা
লালমাটি, পথ জানো?
কদমের পায়ে
বাঁশিও আছড়ে পড়ে
পার্বতী নূপুরে-
বিভঙ্গে অনঙ্গ সুর
অষ্টরতি কেঁদে যায়।

৩.

মেঘের শ্রাবণ
নীল চায়, জল চায়
পুড়ে যায় বায়ু-
স্পর্শহীন ধোঁয়া ওঠে
চরাচর ঢাকে
ভুল পথ ভ্রম শিলা -
তবে এসেছিলে কেন!

৪.

পথ, রেখা দাও
দাও পল্লবে বিদ্যুৎ
তারারাও চুপ
হিসেব জানেনা কোনো
ছায়াপথে ফুল-
শোনো, আলো জ্বেলে রেখো।


প্রাণ বাড়ন্ত

সিলিন্ডার প্রতি
এক জীবন আশা -আকাঙ্ক্ষা
ই এম আই এ মূল্য চোকাব।

দুহাতে ছড়িয়েছি গুণিতকে পাপ
সবুজ মুড়িয়ে হাইরাইজের ব্যস্তবাস,
বনজ কঙ্কালে
ভরে দিয়েছি মাটির গর্ভ।

বেলাইনে ঢুকে পড়ছে কার্বন মনোক্সাইড
পাপমুক্তির টীকা ফীকা থাকলে গুঁজে দাও ।

চোখের কর্ণিয়া পুড়ে বোবা বেগুনি রঙ
ফুসফুস হাপর টানা ফ্যাকাশে
এক ছিলিম ও -টু দে  মা গো
সুখটান দিই।


বেঁচে যাই যদি,
সবুজ বুনে নেব বুকের ওড়নায়
শিমুলের পায়ে নিঃশর্ত  ক্ষমা লিখে দেব
অনাচারী লজ্জিত মানুষ।

লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, মা গো, ইট পেতে...


রোগ শয্যা

প্রতিটি শয্যার পাশে
অমেয় প্রেরণা লিখে দিও।
ঘুমহীন কালরাত্রি-
লৌহচূর গেঁথে গেঁথে স্থবির।
সে সব রাত্রির পাশে
     জোনাকি- অক্ষয় এঁকে দিও,
শব্দফুল ফুটে থেকো
প্রতিটি ক্ষয়ে যাওয়া নগরকীর্তনে....






Wednesday, January 26, 2022

লিপি চৌধুরীর কবিতাগুচ্ছ

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||       লিপি চৌধুরীর কবিতাগুচ্ছ



অপেক্ষার পদাবলী

১.

উষ্ণতা ভালো লাগে, কিন্তু উত্তাপ কোথায়?
দেয়া নেওয়ার অঙ্ক মেলাতে পারিনি কখনো
ইথারে ভেসে আসে দৃশ্য, তবু স্পর্শ পাইনা!
রাতের ইঙ্গিতে ভিজে যায় চাঁদের শরীর
ব্যর্থ আশা নিয়ে ফুল ফোটে , ঝরে যায়...
জলস্রোত কুল ভাঙে বুক ভাঙে অছিলায়
আমি লিখে রাখি অপেক্ষার পদাবলী
তারপর একদিন বানের জল ভাসিয়ে 
নিয়ে যায় খর কুটো ,যত স্মৃতি কথা দুঃখবিলাস।
ডানা কাটা পাখির মত আমি ফিরি সহজিয়া
কুঁড়েঘর আর খাঁচায় মুখ গুঁজে খুঁজে পাই আমরণ।

২.

মাথার ভিতরে তখন অন্ধকার
কার্তিক সংক্রান্তির শেষে নিভে 
গেছে আকাশপ্রদীপ। আমার ভয় করে
ব্যর্থতায় ভর করে অন্ধকার নেমে যায়
শিকড় ফুঁড়ে নিচে ! উনকোটি শ্বাপদের 
ছোবলে ছোবলে নীল হয়ে যাই ।

অপরাজিতার শিরা বেয়ে উঠে আসি
অঘ্রানের নবান্নে। তখন বাতাসে বৃষ্টি,
শীতের আভাস। মেঘ কুণ্ডলী পাকিয়ে 
উড়ে যায় আকাশের দিকে। যেন কোনো
আগ্নেয়গিরি জেগে ওঠে পুনরায়

৩.

রাতের ইঙ্গিতে ভিজে যায় চাঁদের শরীর
ব্যর্থ আশা নিয়ে ফুল ফোটে , ঝরে যায়
জলস্রোত কুল ভাঙে বুক ভাঙে অছিলায়
আমি লিখে রাখি অপেক্ষার পদাবলী

৪. 

তোমার মত করে লিখতে শিখিনি
লিখতে শিখিনি মায়া কুহকের চাঁদ
শুধু দেখি ব্যথারা পেরিয়ে যায়
নিঃশব্দ কুয়াশা মেখে যৌথ এষণায়
আমি দেখি ব্যর্থতার প্রতিবিম্ব
চৌচির কাঁচের বুকে মুখ থুবড়ে
কিভাবে প্রতিফলিত হয়...

হে ভগবান,  কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ কি 
শুধু গান্ধারীর পরাজয়?

Sunday, January 23, 2022

কবিতার ডালপালা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||  অরিজিৎ চক্রবর্তী  
 কবিতার ডালপালা ( তৃতীয় পর্ব )  



Kill a man and you are an assassin. Kill millions of men, and you are a conqueror. Kill everyone, and you are a god.”

 – Jean Rostand

কাব্যের আত্মার কাছ থেকে, প্রেরণাধন্য কবির কাছ থেকে কোন ধরনের সত্য আমরা দাবি করতে পারি? যখন অহমাত্মক বিনয়ের এক জীবন্ত চর্ষায় কবি লিখে চলেন একের পর এক স্বরভঙ্গিমা ! তখন কি কোনো প্রত্যয় কাজ করে তাঁর মধ্যে? নাকি ভাবের পরিখায় নিজেই ঝাঁপ দিয়ে খুঁজে নেন আত্মহননের আকুতি।

      আসলে মানুষ কখনো এমন কোনো কিছুর অন্বেষণে নিজেকে প্রবৃত্ত করে না, যাকে আয়ত্ত করার কোনো সম্ভাবনাই নেই। অমৃত আমাদের ক্ষণে-ক্ষণে স্পর্শ করে যায় বলেই আমরা অমৃতের অভিলাষী। ওটা অধরা, কিন্তু অচেনা নয়। কী বলেছিলেন যাজ্ঞবল্ক্য? তিনি একটা উপমা দেন। নুনের একটা ডেলা জলে ফেলে দেওয়া হলো। সেটা গলে জলে মিশে গেল। এবার সেই দ্রবণের যেখান থেকেই পান করি না কেন, নোনতা স্বাদই পাব। অথচ আলাদা করে নুন বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব আর রইল না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হেমন্তবালা দেবীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, " এই জীবনেই কতবার মরেচি ভেবে দেখ। শিশুকালে আমার দাইকে অসম্ভব ভালোবাসতুম। তখনকার যে জীবন সেটা তাকেই কেন্দ্র করে ছিল। এক ঘন্টার মতো তার তিরোধানের কথা সেদিন বিনা অশ্রুপাতে প্রসন্নমনে চিন্তা করতে পারতুম না। কিন্তু সে আজ ছায়া হয়ে গেল, কোনো ব্যথার দাগ নেই। তার পরে অন্য কেন্দ্র নিয়ে যে জীবন সৃষ্ট হয়েছে সেটার দাম সমস্ত সুখ দুঃখ নিয়ে অনেক বেশি। কিন্তু অবশেষে এ সমস্ত গিয়েও জীবনান্তরে আর একটা সত্তা যখন জমে উঠবে তখন তাকে নিয়েই এত ব্যাপৃত হব যে গতস্য শোচনা বলে পদার্থই থাকবে না।" ( চিঠিপত্র, ১৩৩৮/ ১৯৩১ )

    এই বিশেষ অর্থে মৃত্যু মানে শারীরিক মৃত্যু নয়, মৃত্যু মানে সম্পর্কের মৃত্যু। উৎকর্ষতায় মৃত্যু। অভিযোজনের মৃত্যু। এরকম বহু মৃত্যু অথবা হত্যার সম্মুখীন আমরা প্রত্যেকেই কম বেশি হয়ে থাকি। কিন্তু একজন চিন্তাশীল মানুষ যখন একজন চিন্তাশীল মানুষকে সচেতন ভাবে হত্যা করে; একজন কবি যখন একজন কবিকে সচেতন ভাবে হত্যা করে! তখন ভাবতে কষ্ট হয় এই ঋকবেদেই কবিদের ঋষি বলা হয়েছে। ঋষিমনা য ঋষিকৃৎ পদবীঃ কবীনাম্ ।

    কিন্তু তার পরেও আমরা শেষ হয়ে যাই না, কোনো না কোনো ভাবে সার্থকতা খুঁজে নেবার চেষ্টা করি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সে চেষ্টা আমরা করতে পারি এই জন্যই যে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে মৈত্রেয়ী আছেন, যিনি কেবলই মৃত্যুর হাত থেকে আমাদের বাঁচিয়ে চলেন।যিনি কেবলই বলেন, যাহার লাগি চক্ষু বুজে বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর, তাহারে বাদ দিয়েও দেখি বিশ্বভূবন মস্ত ডাগর।

    নান্দনিক সৃষ্টি সম্বন্ধে মার্ক্স " আত্মিক উৎপাদন"( Spiritual production ) কথাটা ব্যবহার করেছিলেন। Paradise Lost লিখে মিল্টন নাকি পাঁচ পাউন্ড পারিশ্রমিক পেয়ে ছিলেন, তাই মুনাফা এবং বাজারসর্বস্বতার মানদন্ডে, মার্ক্স বলেছেন, মিল্টনের ওই বিপুল শ্রম " অনুৎপাদন " । আর ঠিক সেই কারণেই তা তাঁকে অমর করেছে। কেননা ওটা তাঁর আত্মার আত্মীকরণ, ওটা দমনাতীত একটা প্রক্রিয়া। এমনই একটা কিছু যেটা না করলে উৎপাদকের রেহাই নেই। যেটা সে নিছক বাইরের তাগিদে করছে না, করছে নিজের অন্তরের গভীরতম তাগিদকে প্রকাশ করবার জন্য। 

     অথচ তাগিদ গুলো যখন তদবিরের পাণিগ্ৰহণ করে! তখন গ্ৰহণ আর বর্জনের গোলকধাঁধায় স্রষ্টা বিষ্ঠা ত্যাগ করেন। আমরা যারা কবিতা লিখি কিংবা কবিতা লিখতে চাই এই বিষয়টি খুব দক্ষতার সঙ্গে এড়িয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু পারি কই? পারিনা বলেই চারপাশ হয়ে ওঠে অসত্য, অসুন্দর এবং বিজ্ঞাপিত। ঘটনাক্রমে কত কিছু উঁকি দিয়ে চলে যায়। আবার কত কিছু দগদগে ক্ষত হয়ে থেকে যায়। 

 

কবি রঞ্জিত সিংহের " ব্যাগভর্তি সন্ধ্যাতারা" কাব্যগ্ৰন্থটির পাতা ওল্টাই। 

( প্রকাশকাল- আগষ্ট ২০০৯, প্রকাশক- অস্ট্রিক ) 

 কবিতার চলনে অতীত বর্তমান মিশে এক অদ্ভুত আত্মনিরীক্ষা। ভাষা ও চিত্রকল্পের অবয়বে যেন যাবতীয় নির্বাণ ও নৈকট্য। অনুভূমিক কান্ডের মতো নানা চিত্ররূপ থেকে একটার পর একটা অনুযোগ গড়ে তোলে যে জাদুবাস্তবতা তা অনির্ণেয় অথচ আকাঙ্খিত। তেমনই একটি কবিতার দিকে চোখ রাখলাম----

 "বস্তু থেকে বাস্তব। আমি কি পঞ্চভূত বর্জিত হব?

তখন কি আমি অবাস্তব?

দেওয়ালে টাঙানো হয়তো একটা ছবি অথবা তাও নয়।

 

একদিন রাত্রে যাঁকে দেখেছিলাম, স্বপ্নে না জাগরণে মনে নেই,

তিনি কে? বাস্তব না অবাস্তব কেউ?

মনের ভিতর ঝড়। পঞ্চজ্যোতি চোখে তাঁকে আমি যা দেখেছি,

তাকে অস্বীকার করি কি ক'রে।

শাদা লুঙ্গি, শাদা আলখাল্লা, মাথায় শাদা ফেট্টি,

গাড়ি থেকে নামলেন, চতুর্দিকে তাঁর মণ্ডলাকার দৃষ্টি

ছড়িয়ে আশীর্বাদ করে দ্রুত পদক্ষেপে গাছপালাময়,

যেন একটা ফার্ম হাউস, মুহূর্তে অদৃশ্য।

 

উনি কে? কেউ উত্তর দিল না, শুধু কথাহারা শীতল বাতাসি হাসি।

লোকজন আছে, দেখতে পাচ্ছি, কোথাও তবুও কোনো শব্দ নেই।

 

আমিই-বা এই স্থানের সন্ধান পেলাম কোথা থেকে?

 

টুকরো টুকরো ছড়ানোছিটানো অথচ সুরচিত সরল স্থাপত্য।

লম্বাটে,চৌকো,গোল করুগেটের আচ্ছাদন, মাথার দু-দিকের

ঢাল ছেয়ে গাছপালা, সবুজে সবুজ। বেগুনি, হলুদ, গোলাপি

হরেকরকম ফুল, হরেক রঙের প্রজাপতি।

 

হঠাৎ চোখে পড়ল, মহারাষ্ট্রীয় ভাষায় লিখিত:

'বাবার থান'।

বাবা কে? তারও উত্তর নেই।

প্রধান প্রবেশদ্বারের বাইরে আমাকে কে যেন জোর করে বসিয়ে দিল।

 

আজও বসে আছি। ফটক তো খুলল না।

এ-দিকে যে দিন গড়িয়ে সন্ধ্যার গায়ে।"

 ( বাবা কে?  তারও উত্তর নেই )

    কবিতাটি একাধিকবার শান্ত হয়ে পাঠ করতে করতে অনুভব করলাম প্রতিটি শব্দ যেন যথার্থ, সঠিক অর্থবোধক এবং স্বচ্ছ চেতনাজাত। কবি কী লিখছেন বা লিখবেন এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকলেই কেবল এ কাজ স্বার্থক হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে ‘Album of old verses’ বইতে ভালেরি শব্দের যে পূর্ণ শক্তির কথা উল্লেখ করেছেন, "I feel the full strength of every word for having waited for it"  অর্থাৎ "সেটাই হচ্ছে কবিতার আসল কথা" এই প্রতিভাবনার ক্রমমুক্তি অনায়াসেই ঘটে রজ্ঞিত সিংহের কবিতায়।

   চৈতন্য তীব্র যন্ত্রণাপ্রদ এক অস্তিত্বের নাম। তা সত্ত্বেও চৈতন্য কবির জন্য অপরিহার্য। আর এই চৈতন্যের যতাযথ প্রয়োগের ফলেই অদৃশ্য কিছুও দৃশ্য হয়ে ওঠে। রঞ্জিত সিংহের কবিতায় এই অপরিহার্যতা স্বাভাবিক ও স্বত্যোৎসারিত। 

   আবার চৈতন্য প্রজ্ঞাপ্রদ। কিন্তু সেই প্রজ্ঞা কবিকে জীবনভর যন্ত্রণায় দগ্ধ করে। তাই কবি বলেন, " বস্তু থেকে বাস্তব। আমি কি পঞ্চভূত বর্জিত হব?"

   ভারতীয় দর্শনে পঞ্চভূতের সমষ্টিই এ জগৎ। সে অর্থে মানুষও পঞ্চভূত। ১৩০৩ সালে প্রকাশিত " পঞ্চভূত" প্রবন্ধ গ্ৰন্থে  রবীন্দ্রনাথ এই পাঁচটি উপাদানকে নাম দিয়েছেন ক্ষিতি, স্রোতস্বিনী, দীপ্তি, সমীর ও ব্যোম। এই পাঁচ পাত্রপাত্রী মিলে একটি তর্কসভা গড়ে তুলেছে, যার কেন্দ্রে আছে ভূতনাথ। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। এদের পারস্পরিক তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে বরীন্দ্রনাথ অত্যন্ত সুকৌশলে তার নিজস্ব সহিত্যাদেশ প্রকাশ করেছেন। কবি রঞ্জিত সিংহ আলোচ্য কবিতাটিতে যেন তেমনই এক বার্তাবহ অভিসন্ধির প্রজ্ঞা ফুটিয়ে তুলেছেন।

তারপর একদম অন্তিমে ঘটিয়ে দিয়েছেন ঘটমানের তক্ষণশিল্প।

 "হঠাৎ চোখে পড়ল, মহারাষ্ট্রীয় ভাষায় লিখিত:

'বাবার থান'।

বাবা কে? তারও উত্তর নেই।

প্রধান প্রবেশদ্বারের বাইরে আমাকে কে যেন জোর করে বসিয়ে দিল।

 

আজও বসে আছি। ফটক তো খুলল না।

এ-দিকে যে দিন গড়িয়ে সন্ধ্যার গায়ে।"

   আমি শুধু একাগ্ৰ মনোযোগে এই কবিতার দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু উত্তর পাচ্ছি না। আসলে উত্তর যে প্রত্ত্যুতর হয়ে প্রধান প্রবেশদ্বারের বাইরে আমাকে বসিয়ে রেখেছে। পাঠককে বসিয়ে রেখেছে। তাই

রবীন্দ্রনাথের কথাতেই বলতে ইচ্ছে করছে ‘গড়ের মাঠে এক ছটাক শস্য জন্মে না, তবু অতোটা জমি অনাবশ্যক নহে। আমাদের পাঞ্চ ভৌতিক সভাও আমাদের পাঁচজনের গড়ের মাঠ, এখানে সত্যের শস্য লাভ করিতে আসি না, সত্যের আনন্দ লাভ করিতে মিলি।’ (পঞ্চভূত / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )


Friday, January 21, 2022

সোমা দাসের কবিতাগুচ্ছ

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||   সোমা দাসের কবিতাগুচ্ছ 




পদক্ষেপ 

খোলামকুচির  মত  ছড়িয়ে  থাকে  মেঘ
চারপাশে

অতি  সাবধানে  পা  ফেলে  ফেলে
এগিয়ে  যাই , পাছে-
মেঘেরা  উড়ে এসে  জমাট  বাঁধে  শরীরে!
পাছে-  ঢেকে  দেয়  আমার
প্রস্ফুটিত  রূপ,তণ্বী শরীরে  ফুটে  থাকা  উন্নত  স্তন
শঙ্খের   মুখের  ন্যয়  প্যাচানো  নাভি!

মেপে মেপে  ফেলি  প্রতিটা
পদক্ষেপ -  আমাকে  উর্বশী  করে  তোলে!


পুং জল

ডালিম রঙা  গোধূলির  রং  গায়ে  মেখে
এক  ঘুমন্ত  কুক্কুরিকে  চেটে চেটে
কাম  নিবৃত্তি  করতে  চাইছে,  যেন
সমস্ত  পুংজল  ঢেলে  দিয়ে
মুক্তি  পেতে  চাইছে!

কয়েকটি  বুনো  মাছি  ছুটে আসে
শবের  গন্ধে...



অবকাশ 

সময়ের  অভাবে , অলিখিত  থেকে  গেছো।
সংসার  থেকে  বাঁচানো  অবকাশেও
ছিলেনা  তুমি! ছিল-
ঝর্ণার  কলধ্বনি, ছিল-
পাতায়  পাতায়  কানাকানি,  কেবল
কোথাও  কোনো  অবকাশে ই
ছিলেনা  তুমি!




জীবাশ্ম 

বিস্মিত  চোখে অন্ধকার  গহ্বরের  ভেতর  হাত ঢুকিয়ে
কিছু  খুঁজতে  লাগলে,

একসময়  ক্লান্ত  মুঠোয়  উঠে  এলো
কিছু  জীবাশ্ম!

প্রদীপে  পুড়ে  যাচ্ছে  এক
ব্যর্থ  দিনান্তের  শরীর,  আর  তুমি
মেন্ডোলিনের  সুরে  মুছে দিতে চাইলে
সমস্ত  দস্তখত!


আস্তাবল

অর্ধ  জীবিত  অবস্থায়  পড়ে আছি  আস্তাবলে!
অশ্বখুরে  লেগে  আছে-
গত  রাতের  রণক্ষেত্রে   জয়ের  মাটি
তারাই   জিভ দিয়ে চেটে
পড়ে থাকা  দেহটাকে  লাল মুক্ত  করছে!

হেমন্তের  বনে  তখন
শুরু হয়ে গেছে  পাতা  ঝড়া।

এক.. দুই.. তিন... জানিনা,
জানিনা   সে  কটা  হাত...!



Wednesday, January 19, 2022

জান্নাত মণির কবিতাগুচ্ছ

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||     জান্নাত মণির কবিতাগুচ্ছ



আমি তো আছি ই-
 
পিঠের পেছনে শেষ চুম্বন
অগ্নির্দ্যুতির মত জীবন্ত হল আমার ফ্যাকাসে মুখ।
আমার খোঁপার গুঁজে দেয়া কাঁটা
তুমি হাসলে !
আমার লজ্জাতুর লজ্জা সাত সাগর থেকে
জল তুলে নিল,
উল্কার চোখ সূর্যমুখী আমার
আমি তো আছি ই-
দূর দরান্তের খসে পড়া নক্ষত্রগুলো
এক এক করে জড়ো হতে থাকে
আমার হৃৎপিণ্ড


সাঁকো

আমি পাখির মত পথ চিনে ফিরে আসি মুঠো ভরা শর্ষে ফুলের ঘ্রাণ নিতে। তুমি কেন থামাও পথ বিধাতা ! আমিতো ঢাকতে চাইনা চোখ আমার সোনায় মুড়ানো সুখ। সবুজের সংসারে ফুল ফলের রেণুমাখা প্রজাপতি আমি জড়িয়ে রাখ কেন হলদে শেকড় ? আমিতো ভাসিয়ে দিয়েছি জীবনের মোহনা আমাকে ডেক না- আমি আর ফেরাবোনা মুখ।

হুমায়ন আজাদের ঢাকা

তোমার কাছ থেকে কিছুই নিতে পারেনি-ঢাকা বহু দূরে নিবাস ছেড়ে এসে শুধু মুখের রেখাগুলিই হারিয়েছি সাঁঝ বেলায় ! দাবার ছকের মত সাজানো শহরে কত মুখ কত গল্প কত ঝলমলে ঝিলিক। কাকতাড়ুয়ার ভয় ! ঝলসানো রোদের ভয়,শুয়রের থাবার ভয় কাজলা দিদির মত সন্ধ্যা নামেনি আমার ভাড়াটে ঘরে। যে স্বপ্ন দেখেছি স্বপ্নের মত হারিয়ে গেছে থমথমে আকাশে। এই যে আসছি বলে জ্বলজ্বলে একটি নক্ষত্র মিলে গেছে ওই  দূর পাহাড়ে। দুখিনী হয়েছি দ্বিগুণ, জমে থাকা ডোবার মত হেরে গেছি ! তোমার কাছ থেকে কিছুই নিতে পারেনি-ঢাকা তোমার এলিয়ে দেয়া চুলে রুপোর একটি কাঁটা গুঁজিয়ে দিতে পারেনি আমি, হতে পারেনি রঙিন একটি কাঁচের মার্বেল। হকারের কোলাহল থেকে কাকতাড়ুয়ার ভয় থেকে নিসর্গের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। বৈঠক খানার ছিমছাম ঘরে ইন্টার্ভিউ নামে কুটিল রাজ্যপট ছেড়ে আমি ঘাসফুলের পসরা সাজিয়েছি। ফেলে দেয়া বেহালার ছেঁড়া সুতো দিয়ে দোতরা বানিয়েছি। উদোম শরীরে গুটিগুটি পায়ে ছুটে আসবে সব ল্যাংটশিশুর দল আনন্দে নড়ে উঠবে হেঞ্চি লতার ডগা। তোমার কাছ থেকে কিছুই নিতে পারেনি-ঢাকা।

হলদে ঘুড়ি

জীবন যখন হৃদয়ের কথা বলে হারিয়ে যায় সবকিছু ! যে গৃহে থাকে না ফুলের শোভা শূন্য ভেজা ভাস সুখের দেখা মেলে না তখন। হাতছানি দিয়ে ডাকে অরণ্যের ছোট্ট জোনাক বন্ধ চোখে অন্ধকারে উদ্দীপ্ত ভোর। বিপন্ন একটা ক্ষুধা দাঁড়িয়ে থাকে ফেলে দেয়া মাংসের হাড়ে লেগে থাকে এক চিমটে রস। কেউ ছুঁয়েও দেখেনি বাড়ন্ত ঘাসের ডগা শরতের আকাশে প্রসন্ন স্বর্গ। প্রতিবন্ধী একটি দিন চলে যায় হলদে ঘুড়িটা জানে না নিশীথে একটি দিন চলে যায়। সময়ের আকাশে হলদে ঘড়িটা জীবনের কাছেই তবুও কতদূরে...

উষ্ণদ্বীপ হয়ে মরুভূমি
আমি আলো ছড়িয়ে দেব শুষে নিব অন্ধকার ক্ষুব্ধ শ্লোগানে হেঁটে যাব দুর্গম পথ আমি চিত্রময়ি জান্নাত! চলছে তালাস মানুষের বাস ঘাতকের কামড়ের দাগ, কুঁড়েঘরে হৃদপিণ্ড রেখছি জীবনের কাছে প্রেম চেয়েছি । শেকড় খুঁজতে অরণ্য কেটেছি উষ্ণদ্বীপ হয়ে মরুভূমি । ঠিকানাবিহীন ধর্মশালা দেখছি বিদ্যাপীঠ আইনের পথ মাতালের পথ অচেনা গাঁয়ের পথ। দ্রোহ ছড়াতে জনস্রোত দেখেছি ছায়াতল তলিয়ে নকশিকাঁথা বিছিয়ে দিয়েছি । জন্মাবধি পরিতেক্ত হয়েছি পরাধীনতার কবোর খুঁড়েছি । ছুঁয়ে দেখেছি সভ্যতা ছিন্ন করেছি কাঁটাতার দিয়েছি অনুপ্রবেশের অধিকার । শতাব্দীর স্বরতন্ত্র ছিরে উষ্ণতা গিলেছি দেখেছি ধু ধু মাঠ আমার কোন বংশধর নেই ধূসর দূর্বাচল ।


Sunday, January 16, 2022

কবিতার ডালপালা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||    অরিজিৎ চক্রবর্তী

কবিতার ডালপালা 
দ্বিতীয় পর্ব

সংকেতের কথা বলতে গেলেই আমার মাথায় সংকেত প্রক্রিয়াজাতকরণ (ইংরেজি: Signal processing)  - এর ভাবনা আসে।  তখন বিষয়টি শুধু কবিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এখানে “সংকেত” বলতে বাস্তব বিশ্বের কোন ঘটনার আচরণ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ (যেমন শব্দ, চিত্র,আলো ইত্যাদি) সম্পর্কে তথ্যাদিকে প্রতিনিধিত্বকারী গাণিতিক ফাংশনকে বোঝানো হয়। কিন্তু প্রক্রিয়াজাতকরণ কৌশলগুলি ব্যবহার করে সম্প্রচারিত সংকেতের নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধি, সংকেত সঞ্চয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি, এবং ব্যক্তিমনে সংকেতের মান উন্নয়ন করার প্রচেষ্টায় আমি আবার কবিতার কাছে ছুটে যাই। এই ছুটে যাওয়ার মধ্যেও একটা বিজ্ঞান আছে।কবিতা হলো সেই বিজ্ঞানের অবচেতন। স্পর্ধিত উন্মেষ বীজের নিহিত শক্তির অনিবার্য বিকাশ। এই অনিবার্যতা অবশ্যই মেধার কর্ষিত ভূমির আনুকূল্য চায়। জন্ম নেয় এক সংকেতদ্রষ্টা কবির কাব্যগ্ৰন্থ " জীবনের পাজামা ও গিঁট"।কবির নাম বিল্বমঙ্গল গোস্বামী। বইটির প্রকাশকাল ১ ডিসেম্বর ২০০৮ (প্রকাশক- সমাকৃতি)। নিবাস বিষ্ণুপুর। বছর কয়েক আগে গত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর কবিতার বইটি আমার পড়ার টেবিলে জ্বলজ্বল করছে। যেন এক আশ্চর্য মানস পর্যটন। পরিযায়ী বিহঙ্গের স্বার্থপর বিভ্রমণের থেকে সুদূর সেই পর্যটন। কারণ, সে তো সত্তার যাপিত অযুত জন্মের অতীত থেকে অস্তিত্বের চলমান বর্তমানে, বর্তমানের দুঃসহ অসম্পূর্ণতা থেকে আলোছায়াময় আশ্রয়দাত্রী অতীতে কিংবা স্বপ্নসম্ভব ভবিষ্যতে প্রয়াণ।

"সারাজীবন ধরে একটি মাত্র কবিতাই লিখে এসেছেন আপনি--- আটা দেড় কিলো, চাল দুকেজি, আলু পাঁচশো গ্ৰাম...। রোজ রোজ সকালে লেখা চিরকূট কবিতা আপনার প্রতিদিন সজীব করেছে প্রাণ, সবুজ করেছে দেহ। এইসব জীবন কবিতা লিখে, এইসব জীবনমুখী কবিতা লিখে লিখে আপনি স্বয়ং আজ কবিতা হয়ে গেছেন। এখন আপনার সামনে জীবন্ত দাঁড়ালে মনে হয় হিমালয়ের নীচে আমি এক ছোট্ট দেবদারু। তাই আপনাকে নিয়ে কিছুই লেখা হল না, আমি অক্ষম। আসলে কবিতা নিয়ে কবিতা লেখা অসম্ভব, কবিতার হিমালয় আঁকা যায় না।" ( বাবাকে নিয়ে লেখা )

হয়তো এই কবিতা পাঠ করে পাঠক একটা চিরচেনা ছবির ভিতর নিজেকেও খুঁজে পাবেন। কিন্তু কবি সেই চিরচেনা চিত্রকল্পের ভিতর নিজস্ব স্বরভঙ্গিমার আবহে একটা প্রাণশক্তিকে যেন জারিত করলেন।কাব্যের সেই চরম অনির্বচনীয় রহস্যের প্রতি নয়, বরং কাব্যপ্রবাহের ভাব-সমুন্নতি ও গভীরতার প্রতি।  পিতা ও পুত্রের মধ্যে মহাজাগতিক " কবিতা" শব্দটির প্রয়োগ এবং প্রয়োগের বিস্তার আমাকে বারংবার ভাবিয়ে চলেছে। আসলে বিল্লমঙ্গল গোস্বামী কবিতা লেখার জন্য কবিতা লেখেননি। তিনি সব সময় ঘূর্ণনে দাঁড়িয়ে আছেন, অথচ চারপাশ স্থির নিমগ্ন। তাঁর নিমগ্নতার মধ্যেই সম্পর্কের অক্ষমতা মিলেমিশে একাকার। আর এই দুই অক্ষম-মেরুর সংযোগকারী সেতুটি হলো "কবিতা"!

কবিতাটি পড়তে গিয়ে যেমন ভালো লাগছে, তেমন মনখারাপ ঘিরে ধরছে। কেন যে এরকম হচ্ছে আমি নিজেও বুঝে উঠতে পারছি না। যদিও মনখারাপের কারণ খুঁজতে গিয়ে আমি দেখে ফেলছি, কিভাবে কবিরা কবিকে হত্যা করে ! আজ তেমনই এক হত্যা কাহিনীর বিবরণ তুলে ধরবো এই লেখাটিতে। তবে তার আগে আরও একটি কবিতার দিকে চোখ রাখব। 

" শোনো, তোমার সঙ্গে কয়েকটা জরুরী কথা আছে।
আমাকে যখন মেঝেতে শুইয়ে রাখবে তখন সাদা কাপড় চাপা দেবে না। আমি সরলভাবে শুয়ে থাকবো মাথা উঁচু করে। প্রয়োজনে দুটো বালিশ দিয়ো। পাশবালিশ দিতে ভুলো না।মাথার পাশে ধূপ জ্বালিও না, খবরদার খেয়াল রেখো, কেউ যেন ভুল করেও ফুল না নিয়ে আসে।যারা আমায় দেখতে আসবে তাদের চোখে যেন বিস্ময় ছাড়া অন্য কিছু না থাকে। একবিন্দু জল গড়িয়ে পড়লে আমার আফশোস হবে। তুমি জানো, একটি মেয়ের একফোঁটা প্রকৃত জলের জন্য আমাকে কত ঘুরে মরতে হয়েছে? চন্দনের ফোঁটা দেবে না। আলতা একদম নয়। আর হ্যাঁ, নাকে যেন তুলো না দেওয়া থাকে; বড্ড বিশ্রী লাগে। সেন্ট দিতে পারো কিন্তু অবশ্যই ফরাসি। আমি বীরের মতো ঘুমবো। সেই সময় ফোন এলে আমাকে ডিসটার্ব করবে না। আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এনজয় করবো-- কার মুখ কতটা ফ্যাকাশে হলো। শোনো, ওরা যেন হরিবোল না বলে। অঞ্জন কিংবা সুমনের গান চালিয়ে দেবে। ওদেরকে বলে দিয়ো ওরা যেন আমায় ন্যাংটো না করে। সারাজীবন এতো বার উলঙ্গ হতে হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। ওই দিনটা অন্তত টিপটপ ফিটফাট থাকতে দিয়ো। হাউমাউ করে কেঁদো না। দরজার পর্দা ধরে চুপি চুপি কাঁদবে সুচিত্রা সেনের মতো। বাঙালি কান্নার মধ্যে একটা শিল্প থাকে। আর একটা কথা, সেই পাগলি মেয়েটি যদি আসে, একমাত্র তাকেই আমার হাত ছুঁতে দেবে। আমার ঠান্ডা হাত এক ঝটকায় উষ্ণ হয়ে যাবে, আর আমি ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে পৌঁছে যাব সঠিক ঠিকানায়... ( ইচ্ছাপত্র )

কবিতার বিবরণখানি অতিক্রম করে অতঃপর আমরা পূর্বাপর পরিকল্পিত অনুমানের তামাশা দেখতে পাই। কবি নিজের জীবন ও জগতের মধ্যে গুঁজে দেন কিছু কৌতুকপ্রদ মর্মরধ্বনি। প্রশ্নাতীতভাবেই এই স্বেচ্ছাচারিতা ক্রমাগত আঁকড়ে ধরে বোধের অর্জন। নিজের সর্বৈব বিনাশটিই যেন প্রেমময় হন্তারকের করতলে তুলে দেন কবি। এই নশ্বর জীবনও যে এক চির-অফুরন্ত নিরন্তরতার সোপান--- এমনই নিবিড় অনুভবে এবং ইচ্ছাপত্রের কৃতাঞ্জলিপুটে কবি আমাদের পৌঁছে দেন সেই সঠিক অনন্যূমেয় ঠিকানায়। বিল্বমঙ্গল যেন এরকম একেরপর এক শব্দদ্যোতনায় লিখে চলেন ইচ্ছামৃত্যুর চিরকূট।

" কতো স্বপ্ন আঁকা হয়
  কতো স্বপ্ন মরে যায় উপযুক্ত খাদ্যের অভাবে..." ( ছেঁড়া ভাবনা, টুকরো অনুভূতি )

দীর্ঘ পরিক্রমন শেষে প্রজ্জ্বলন্ত জীবনের উষ্ণতা হারিয়ে কবি দেখে ফেলেন খাদ্য ও খাদকের আত্মভেদী সংকট। আর এই খাদ্য খাদকের জটিল বাস্তুতন্ত্রে ভেসে ওঠে কবি ও কবিতার প্রবৃষ্ট ছায়াযুদ্ধ। তুচ্ছতার বেদনা ছাপিয়ে আত্মহননের অমোঘ নিয়তি।


" একটা মাঝবয়সী বউ, একটি লিকলিকে বাচ্চা
  চলে যেতে যেতে কোনোরকমে টিকে যাওয়া একটা চাকরি
  একটা ভাঙা গিটার,আর একটা ঢলঢলে পুরোনো পাতলুন
                                                      এই আমার কবি জীবন।

                  সেই পাজামায় মিনিমাম ছত্রিশটা গিঁট। সাঁইত্রিশ
           বছর ধরে আমি গিঁট খুলে চলেছি। একটা খুলছি তো
    আর একটা লেগে যাচ্ছে। এরকমই এক একটি গিঁটের মাঝে
ছোটো বিজ্ঞাপন, এর মধ্যেই কখনো চুপ করছি কখনও কথা বলছি,
                                       কখনো রাত্রির দুরভাষে বোকামেয়ের সঙ্গে
                            স্মার্ট কিংবা ন্যাতন্যাতে পঁয়ত্রিশ মিনিট বকমবকম।

             এসবের সঙ্গেই একটা দিগন্তখোলা জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে
                       স্বপ্ন-রোদ-হাওয়া আর বৃষ্টির রিমঝিম অলৌকিক শব্দ।

          এই আমার কবিতা লেখা, মরে মরে বেঁচে থাকার অপূর্ব যন্ত্রণা।"
         
        ( প্রবেশক কবিতা )

এই কবিতার দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকি। চিন্তাগত অভিব্যক্তির মধ্যে জীবন স্পন্দিত হয়। তীব্রতার সাক্ষাৎ সেখানেই পাই যেখানে অন্য অনেক কিছু রয়েছে। অথচ সবই এমন এক সাক্ষাৎদর্শনের তরঙ্গ-ভঙ্গে সবলে বাহিত হয়ে চলেছে, তাকে মরে মরে বেঁচে থাকার অপূর্ব যন্ত্রণার অপরিহার্য অনুষঙ্গে বেঁধে দিয়েছেন স্বয়ং কবি নিজেই। এলিয়ট বলেছিলেন-- 'Poetry is not a turning loose of emotion...' বিল্বমমঙ্গলের কবিতায় আপাত দৃষ্টিতে আবেগের স্বর বেশি মনে হলেও, সেই আবেগের আবেদন অনায়াস ও কাঙ্ক্ষিত। কবিতার আলো ও আনন্দ প্রকাশের জন্যে কবির যে সর্বোচ্চ সামর্থ্য--- তাকে ছুঁয়ে দেখার বিশ্বাসই যেন এই কবিতার আত্মবিলীন চেতনার রঙে রাঙানো জগৎ। অথচ এই জগতের আড়ালে আবডালে হত্যা লুকিয়ে আছে। আমি সেই হত্যাকে চিনতে পেরেছি। আমার কবিতা লেখা জীবনেও যে এরকম হত্যার অনায়াস যাতায়াত। 

কিন্তু কিভাবে তুলে ধরবো সেই কবি বন্ধুর নাম। কষ্ট হচ্ছে। কারণ, বন্ধু কি কখনো হত্যাকারী হয়? বিষয়টা ভাবাচ্ছে! তখন ঘটনাটা লুকিয়ে রাখা মানেই মুখহীন মুখোশের অভিপ্রায়। তাই আমাকে বলতেই হবে। 



Sunday, January 9, 2022

কবিতার ডালপালা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||  অরিজিৎ চক্রবর্তী 


কবিতার ডালপালা  
(প্রথম~পর্ব)

মনে করা যাক, ছোট ছোট ক্ষুদ্রতামুক্ত কোনো এক মানবসমাজের অস্তিত্ব, প্রতিটি মানুষ যখন সাধারণ অপরাধপ্রবণতাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। যেখানে প্রাত্যহিক জীবন-স্তর এমনই যে বস্তুসামগ্রীর জন্য অন্যজনকে বঞ্চিত করতে হয় না, অন্যের অস্বস্তি সম্পর্কে প্রত্যেকেরই একটি স্বাভাবিক বোধ জন্মেছে এবং তাই কৃতকর্মের জন্য অন্য কারো কাছে জবাবদিহিরও দায় নেই। এ অবস্থায় কত বেশি মুক্তির আস্বাদ পাওয়া যেতে পারে যদি স্ববিরোধ-সচেতনতার হাত থেকে নিজেকে আলগা করে নেওয়া যায়! এই আমি পাহাড় চাই, খানিক পরেই চাই না, চাই সমুদ্র, পরক্ষণেই চাই বনানী, পরক্ষণেই লোকালয়– অথবা আমি পাহাড় চাই আবার চাইও না, আমি ভালোবাসার জনের কাছে চলেছি,একটু দ্বিধাও কিন্তু বয়ে নিয়ে যাচ্ছি সঙ্গে করে। কবিতাও যেন তেমনই এক দ্বিধাদ্বন্দ্বের আঁতুড়ঘর। সেখানে নির্দিষ্ট কোন পথরেখা নেই।  সময় ও পরিসর ভাবনার বিচিত্র অভিব্যক্তির মধ্যে কোনো একক কবি কিভাবে নিজস্ব নির্মিত - নৈপুণ্যকে প্রতিষ্ঠিত করছেন, কিভাবেই বা নতুন সময়বোধ ও নান্দনিক চেতনাকে আপন সৃষ্টির উৎস করে তুলছেন আর কিভাবে মেলাচ্ছেন সামাজিক বীক্ষণকে — এইটাই তাঁর সার্থকতার কষ্টিপাথর। আর সেই সঙ্গে রয়েছে জাগতিক তথ্য থেকে কবিতার সত্যে এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে নৈর্ব্যক্তিক উপলব্ধিতে পৌঁছনোর জরুরি পরীক্ষা সমাপনের দায়ও। তত্ত্বগত দৃষ্টিকোণ মুহুর্মুহুঃ পালটে যাচ্ছে! যদিও, এলিয়টের একটি পুরনো ও পরিচিত মন্তব্য আজও সমান প্রাসঙ্গিক; "The progress of an artist is a continual self-sacrifice, a continual extinction of personality"। বস্তুত নিজের ফেলে-আসা পথরেখাকে নিজেই যদি মুছে নেওয়া না যায়, বর্জনীয়েরা শৃঙ্খলিত করবে গতিকে, ঝাপসা হয়ে আসবে গন্তব্য। তাই অভিজ্ঞতার পোড়া মাটি দিয়ে নিজের গভীর ভাস্কর্য গড়ে তোলার প্রাক্‌শর্ত হলো, নিরবচ্ছিন্ন ভাবে নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে এগোনো।

 “…একটি পৃথিবীর অন্ধকার ও স্তব্ধতায় একটি মোমের মতন যেন জ্বলে ওঠে হৃদয়, এবং ধীরে ধীরে কবিতা-জননের প্রতিভা ও আস্বাদ পাওয়া যায় ।” (কবিতার কথা, জীবনানন্দ দাশ) কিন্তু নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির প্রবর্তনায় “ to judge of poets is only the faculty of poets” – বেন জনসনের এই বহুল উচ্চারিত উক্তিটি ভাবতেই হয় । আর ভাবছি বলেই আবিষ্কার করছি সত্তরের এক সত্যি, কবি স্বপন চক্রবর্তী’র কবিতাগুলিকে । 

যে বইটা আমার চোখের সামনে খোলা, ওখানে জীবন নেই । 
ওটা ধর্ম কিংবা মিথ্যার অভিধান । 
যে বইটা অশোকস্তম্ভ দিয়ে শুরু, ওখানে সত্যি নেই । 
ওটা ভারতবর্ষের পবিত্র সংবিধান । (অশোকস্তম্ভ) 

নিজস্ব ঘৃণার বাইরে বেরিয়ে এসে শ্রমজীবী মানুষের যে শ্রেণীঘৃণা, তার যে ব্যাপক সংহত রূপ তার সাথে এক পবিত্র বোবা সংবিধানের উপলব্ধি আমাদের অবাক করল । আসলে স্বপন চক্রবর্তীর কবিতা হতাশ করে না, সাহসভরে ঋজু দাঁড়িয়ে থাকে লোকানো বিস্ফোরকের মতো । 

ঠিকঠাক তাপে রুটি সেঁকো 
অতি তাপ রুটিকে পোড়ায় 
কম তাপে রুটি ফোলে নাকো (রুটি)

এই অপ্রত্যাশিত স্পষ্টভাষণ ও ক্রোধ যেন আমাদের আত্মহুতির মধ্যেই জীবনকে বুঝিয়ে দেয় যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করার দর্শন । কবি হয়তো বলতে চান “রুটি” শব্দটির ক্ষুধা, আর্তনাদ, আগুনে সামঞ্জস্য প্রবাহনের নিয়মধর্মী প্রতিভাস । তাই কবি জানিয়ে দেন, 
“নির্গত শ্বাসে কেবলি সন্দেহ । / গলির এমুখ ঘুমালে ওমুখ জাগে । 
এপাড়া কাঁথা মুড়ি দিলে। / তাকে ঘিরে নাচে বিনিদ্র ভৈরব । ত্রাস । 
চিরুনি তল্লাশ । / তবু চোখের পাতায় কী গভীর উৎসাহ (মিড়) 

সত্তর দশক রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্ঠুরতার পিষ্ট হয়ে মানুষের আদিম গোঙানি হয়ে উঠেছিল । ফুলে ফেঁপে উঠেছিল ক্রোধ । কিন্তু এই ক্রোধ ছিল সম্পূর্ণভাবে নিম্ন মধ্যবিত্তের একান্ত । তাই হয়তো কবি স্বপন চক্রবর্তী উচ্চারণ করলেন : 

“শুনেছি শঙ্খচুড়ও দহনের দাউ নেভাতে পাথরে ঢেলে দিয়ে আসে বিষ 
কিন্তু আমার জ্বলে পুড়ে যাওয়ার তরল আমি কোন পাথরে ঢালব ?” (দাউ) 


সৃষ্টি-মুহূর্তের দহন ও উদ্ভাসন তাঁর সুপরিজ্ঞাত, তিনি ‘অজর, অক্ষর, অধ্যাপক’ এর উপলব্ধি বহির্ভূত সেই দহনের যন্ত্রণাময় প্রস্তুতিতে নিজেও দীর্ণ হয়েছেন । এই নিষ্ঠুর অত্যাচারও যে কোনো-একজন কবি নিজের উপরে করতে পারলেন, তার জন্য কবিকে দোষ দেবো, না সেই আন্দোলনকে, না আন্দোলনের জনক রাজনৈতিক সময়কে, সে বিষয়ে মনস্থির করা শক্ত ।

যেকোনো শিল্প মাধ্যমেই নির্মাণের ভিন্নতা, মূলতঃ চেতনারই পরিবর্তন । চেতনা বদলেই পালটে যায়, দেখার জগৎ ও প্রকাশভঙ্গী । তাবৎ বিশ্বে সব কিছুই কবিতার বিষয় বস্তু হতে পারে । এই দৃষ্টিভঙ্গিকে কেন্দ্র করে বাস্তব ও অবাস্তবতার Tradinational Definition পালটে যাচ্ছে । অনুসন্ধান করছেন তাঁরা । ঘটনার চেয়ে ঘটার সম্ভাবনার মধ্যেই 
বাস্তবতার দেখতে চাইছেন । ফলে ভাষাবদলের কবিতা নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা বাড়ছে । 

আসুন কবি ইন্দ্রজিৎ দত্ত-এর লেখা “রূপসী বাংলা বাই লেন” কাব্যগ্রন্থটির একটি কবিতা নিবিড় পাঠ করি ।

আদৃতা 

হে বাস 
হে ২৩৮ নং বাস, আবার যদি 

আমার মতো 
আয়না বেচতে আসা কেউ 
শহরতলির বাইলেনে হারিয়ে 
ফিরে আসার দিকে তাকিয়ে থাকে অহেতুক 

তাকে আমার কথা বোলো 

তাকে দিয়ো 
আমার অসুখ মাখা চিঠি 
নেমে যাওয়ার যন্ত্রণা 


“আশাবাদের মতো অকাব্যিক আর কিছুই নয়” – লেসলি স্টিফেনের এই বচন সর্বতোভাবে প্রযোজ্য তো বটেই, উপরন্তু সংক্রামক । পূর্ববর্তী প্রধান কবিরা হঠাৎ রাতারাতি নাহলে “সেই অন্ধকার চাই” কিংবা “যে আঁধার আলোর অধিক” ইত্যাকার মন্ত্ররচনার অত ব্যস্তসমস্ত হয়ে উঠতেন না । কিন্তু ইন্দ্রজিৎ-এর বেলায় যে তাঁর চিন্তাগ্রস্ত অস্তিত্বের মূলেই নিরাশা বা অন্ধকারের একটি ন্যায্য ভিতরভূমিকা ছিল, একথা অস্বীকার করা যাবে না । 

আলোচ্য কবিতাটিতে প্রতিদিনের গতির ব্যবহারিক বাস আর নেমে যাওয়ার যে যন্ত্রণা নিছক নান্দনিকেই তার শেকড়বাকড় গচ্ছিত রাখেনা, একটা নতুন ভাবনার উপমাশৃঙ্খল তুলে ধরে তা স্পষ্ট ! আসলে ভাবনার কোনো মানে বই নেই । দৃশ্যের কোনো ব্যাকরণ হয় না । ইন্দ্রজিৎ আয়না বেচতে আসা একটি দৃশ্যের আয়না । যেখানে আমরা নিজেদেরও দেখে ফেলি । তবু কোথাও যেন মনে হয়, ইন্দ্রজিতের কবিতা ক্ষত সৃষ্টি করে না,সেটা তার কাজ নয়, ক্ষতকে আনন্দময় ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলাই তার প্রথম উজ্জীবন । শব্দ ও ভাবনার অন্তর্বর্তী সংকেত ।