কবিতার ডালপালা
নিলস বোর বলতেন, অপোজিট টু এ গ্রেট ট্রুথ ইজ অলসো আ ট্রুথ৷ প্রতিটি মহাসত্যের বিপরীতেও একটি সত্য আছে৷ বিজ্ঞানজগতে এই সত্যাসত্যের সংঘাত মানুষের কাছে চিরন্তন আকর্ষণের বিষয়৷ তারই মধ্যে উঁকি মারে সেই অমোঘ প্রশ্ন- সবকিছুর ভিড়ে মানুষের ভূমিকা কী? মানুষী যে সাফল্যকে মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মনে হয়েছিল, ‘দি মোস্ট ইনকমপ্রিহেনসিবল থিং ইন দিস ইউনিভার্স ইজ দ্যাট ইট ইজ কমপ্রিহেনসিবল৷’ একদিকে বিশ্ব-চরাচরের রহস্যময়তা, অন্য দিকে সেই প্রহেলিকা সমাধানে মানুষের এই নিত্য সাধনাই আমাদের সপ্রাণ, চলমান, আনন্দঘর ! বাহ্যিক অনেক বদলের পরও, মনের মধ্যে সেই একই ধারা বয়ে চলে, জীবনের সেই অখন্ডতা অব্যাহত রাখতে পারাই হয়তো একজন স্রষ্টার কাছে, পৃথিবীর সব ছেঁড়া তার থেকে বেরিয়ে আসা মনোলীন সিম্ফনি। কবি অমৃতা ভট্টাচার্যের "নগ্ন, আনন্দঘর" পড়তে পড়তে আমার এমনটাই মনে হয়েছে বারংবার। কিন্তু কেন? মনে হয়েছে বললাম কেন? বিশ্বাস হয়েছে বলাটা কি সঙ্গত ছিল না? না। ছিল না। কারণ, কবিতায় সঙ্গত বিশ্বাস বলে কিছু হয় না। যেকোনো শিল্প মাধ্যমেই নির্মাণের ভিন্নতা, মূলত চেতনারই পরিবর্তন। চেতনা বদলেই পালটে যায়, দেখার জগৎ ও প্রকাশভঙ্গী । তাবৎ বিশ্বে সব কিছুই কবিতার বিষয় বস্তু হতে পারে । এই দৃষ্টিভঙ্গিকে কেন্দ্র করে বাস্তব ও অবাস্তবতার আলো আঁধারির চেয়ে ঘটার সম্ভাবনার মধ্যেই বাস্তবতার দেখতে চাইছেন । ফলে ভাষাবদলের কবিতা নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা বাড়ছে ।
" হোক থির, টলটল হোক, জরায়ু ঘোর ঘোর
দ্যাখো নাভির নীচে জোড়া জোড়া জোড়া
সব দেওয়া আর ফেরত
চাঁদ... ঈগল...ডানা দ্বীপ ডানা..." ( প্রতি অঙ্গ মোর )
কবিতার চলনে অতীত বর্তমান মিশে এক অদ্ভুত আত্মনিরীক্ষা। ভাষা ও চিত্রকল্পের অবয়বে যেন যাবতীয় নির্বাণ ও নৈকট্য। অনুভূমিক কান্ডের মতো নানা চিত্ররূপ থেকে একটার পর একটা অনুযোগ গড়ে তোলে যে জাদুবাস্তবতা তা অনির্ণেয় অথচ আকাঙ্খিত। তাই " ঘোর ঘোর" আর " জোড়া জোড়া" এই শব্দদুটির দ্বিমাত্রিক ব্যবহারে বহুমাত্রিক সম্ভাবনার আভাস দিতে দিতে কবি মনে করিয়ে দিচ্ছেন কুণ্ডলিনী জাগরণের অমোঘ লক্ষণ হল নাদের স্ফূরণ। নাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে বিন্দু ও কলাতত্ত্ব। জগতের সৃষ্টি প্রণালীর বিবরণ প্রসঙ্গে সারদাতিলকে লেখা আছে---
"সচ্চিদানন্দবিভবাৎ সকলাৎ পরমেশ্বরাৎ।
আসীৎ শক্তিস্ততো নাদস্ততো বিন্দুসম্ভুদ্ভবঃ।।"
এই বিবরণ থেকে আদি সৃষ্টির যে ক্রম পাওয়া যায়, তা থেকে জানা যায় যে, সৃষ্টির আদিতে স-কল পরমেশ্বর থেকেই সৃষ্টির বিকাশ ঘটেছে।'স--কল' বলতে 'কলাসহিত'--- এটাই বুঝতে হবে। আবার 'কলা'শব্দের অর্থ শক্তি। এই স--কল পরমেশ্বর থেকে অবতরণক্রমে শক্তিতত্ত্বের বিকাশ হয়ে থাকে। কবি কি তেমনই কোনো বিকাশের প্রত্যাশী ? তাই "সব দেওয়া আর ফেরত" এর প্রতি তাঁর নির্বাণগামী সোপানের ধারা ! কিংবা হয়তো সংযুক্তি (Conjunction ) ও বিযুক্তির ( distinction ) নিরিখে কবিকল্পনার ঊর্ধ্বায়ন।
"প্রতি এক নতুন দিন অভিপ্রেত শব।
বৃদ্ধ দু-হাত ধীরে ধীরে
ডানা হয়। হয়ে ওঠা কুঁজময়; স্মার্তভার---
যেমন 'হয়' বহুজ প্রজাপতি, তক্ষক আর প্রবাদ;---"
( প্রতি অঙ্গ )
শব্দের হ্যালুসিনেশন কিভাবে কবিতার প্রাচুর্যকে অবারিত করে তোলে, তারই সেমিওলজি অর্থাৎ সংকেতবিজ্ঞানে; যার "স্মার্তভার" অর্থাৎ স্মৃতির অনুসারী সংকেতের বাহ্যিক রূপ ও অন্তর্নিহিত অর্থের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন একের পর এক সংকেত-বিম্ব ! বিশেষ করে ভাষাবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একটি সংকেত দুইটি অংশ নিয়ে গঠিত – বাহ্যিক রূপ বা দ্যোতক (signifier) ও অন্তর্নিহিত অর্থ বা দ্যোতিত (signified)। যেমন ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দ্যোতক হল কোন ধ্বনিসমষ্টি বা চিত্র, যেমন “মহানির্বাণতন্ত্র” একটি ধ্বনিত শব্দ বা লিখিত শব্দ। অন্যদিকে দ্যোতিত হল তন্ত্রের ধারণা, এই দুইটি উপাদান একত্রে মিলে কবি জানিয়ে দিলেন আমাদের দ্বিজত্বপ্রাপ্তির অভিপ্রেত অপেক্ষা। যেখানে একজন পাঠক হিসেবে আমিও তাকিয়ে থাকি আরো বহু অপেক্ষার উৎসে। তখন মনে হয় হৃদয়সংবাদী এসব কবিতা যেন একটি ভ্রমণ।বহুজ প্রজাপতি, তক্ষক ও প্রবাদ কবিতার বয়ানে যেমন ধরা রইল, বহু পাঠপ্রসঙ্গ ঘোষণাহীন প্রখরতায় তেমনি সহৃদয় সামাজিক। আর গড়ে উঠেছে এক বহুস্বরিক আনন্দ। স্বপ্ন কল্পবাস্তব এখানে স্থান পরিবর্তনে অনলস উৎসাহী। কী বলছে নয়, বরং কীভাবে কথনটি পরিবেশিত—সেই বুনন এই কবিতায় তুমুল।
কবিতায় ধ্বনি রচনার দুটি প্রধান বৈপরীত্য আলো-অন্ধকার, স্থিরতা-অস্থিরতা স্বরের ধ্বনিপদার্থিক বৈশিষ্ট্যে আভাসিত। তাই ধ্বনিসচেতন প্রাবল্য অমৃতার কবিতায় অদ্ভুত ভাবেই অনুনাদের চিত্ররূপ। এখানে সচেতন ভাবে বলতে ইচ্ছে করলো না। কারণ, কবিতার আলোর মধ্যে যে শব্দের উত্তোরণ ঘটেছে সেটা আত্মার আলো, বুদ্ধির যবনিকা ভেদ করে সেই আলো আমাদের দেখা ও ভাবার মধ্যে একটা প্রতিসরণ ঘটিয়ে দিয়েছে ক্রমাগত। কিন্তু কিভাবে? আরও একটি কবিতা পড়ে নেওয়া যাক---
" আলোয় দেখেছি কোণ ঠেসে রাখা সিলমোহর
আর যত কিছু বৈধ তলব, সাবধানি
গিঁট বেঁধে রাখা অস্ত-রঙের আবডালে
দারুণ সেজেছ। যত্নে এবার পথভুলে
স্বেদ জমে জমে পুণ্যের লোভে ধূপদানি,
ভালো লাগে দাগ, জাপটিয়ে ধরে চারপ্রহর---"
( আনন্দঘর )
প্রথমত বলে রাখি, কবিতাটি এখানে শেষ নয়। আবার শুরুও নয়। আসলে সমগ্ৰ কাব্যগ্ৰন্থ জুড়ে যেন ভাস্কর্যের চেতনায় এক নর্তকী। মহেঞ্জোদারোর রঙ্গশালায় তাকে দেখা গেছে। অথবা ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে মন্দিরে। মনে পড়ে যায় রামগড়ের গুহালিপিতে দেবদাসী সুতনুকার উদ্দেশ্যে দেবদীন্ন যে ভালোবাসাটুকু খোদাই করেছিল, সেই কাহিনীর অভিমুখ যেন এই কবিতাটি। দেবদীন্ন সুতনুকার সঙ্গে চিরকালের জন্য মিলিত হতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। পারেনি এই কারণেই যে, সুতনুকা নিশ্চয়ই নৃত্যের কারণে দেবতার কাছে আত্মপ্রদও ছিল। তাই বৈধ তলবের চারপ্রহরে কবিতার চিত্রকল্প জুড়ে আমরা দেখতে পাই নারীর সংরাগ, চমকানো মেঘ, করুণ সুখের কুঠুরি!
বহু লুকনো মিথের পরতে পরতে এক প্রিয়দর্শিনীর কথাই হয়তো কবি বলতে চেয়েছেন অবদমনের কলঙ্ক ও কোকনদে। কবির কথায় "ইচ্ছেধারী ছোটে" আর "ইচ্ছেধারী দ্যাখে" সৃষ্টির ঈশ্বরস্রোত... । আসলে অমৃতা দেখিয়ে দিয়েছেন, কিভাবে আপাত সারল্যের মধ্যে ক্রমশ জটিলতর রূপ নেয়; যা কিছু অগভীর তা ক্রমবর্ধমান গভীরতার জন্যে স্থান করে দেয়, বিশ্বলীলার মধ্যে অপরা-প্রকৃতি ক্রমে পরা-প্রকৃতির প্রকাশের জন্য পথ ছেড়ে দেয়... এই সমস্ত কিছুর ঋজু ও প্রত্যক্ষ রীতির ছন্দবিজ্ঞান। যেমনটি " জন্ম" কবিতায় পাই----
" অজান্তে গিলেছ শব্দ, রতিকাঁটা আর অন্তে মিল।
উজ্জ্বল পলায়ন যার,মজুত রেখেছে দিন
ফুটিফাটা কত হেঁটে যাওয়া। রাত তবু
জানলা নেশায় পাশ ফেরে তার, ভাবে,
উদবৃত্ত আলোর মুখে যতটা
বেঁচেছে ঋণ, অন্ধকার চোখে--
তারও রোপণ বাজে, উদাস সে ফেলে যাওয়া দিকচিহ্নময়
কোঁচড়ে কুড়ানো থাক,দশ মাস,নয় দিন, পরাজিত ভয়!"
"পরাজিত ভয়" আনন্দেই কি আমাদের এগিয়ে যাওয়া? আমাদের পিছিয়ে আসা? জীবনের বীজতলায় দাঁড়িয়ে যেন অনন্ত জাগে।নারীদেহে থাকে রাধাবিন্দু এবং পুরুষদেহে কৃষ্ণবিন্দু।দুটি বিন্দুই আধা অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ নয়। কেননা, বাউলদের একাংশ মনে করে কৃষ্ণবিন্দু থেকে রাধাবিন্দুর সৃষ্টি। অর্থাৎ পূর্ণ কৃষ্ণবিন্দু থেকে খ–ত হয়ে রাধাবিন্দুর সৃষ্টি হওয়ায় তা খ–ত। অর্থাৎ অর্ধ। … বিন্দু সাধনায় এই দুই অর্ধবিন্দু নির্দিষ্ট যোগ ও নিয়ম মেনে মিলিত হলে পুনঃ পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। পুনঃ পূর্ণতাপ্রাপ্ত এই রাধাবিন্দু-কৃষ্ণবিন্দুর মিলনে সাধক/ সাধিকা সূক্ষ্মতম মহানন্দের অনুভবে নির্ভার হয়, যা বাউল-সাধনার লক্ষ্য।বিচিত্র সাধনায় এ-দুটিকে মিলিয়ে যার সন্ধান পাওয়া যায় বাউলের ভাষায় সেই হচ্ছে মনের মানুষ, অচিন পাখি, আলেক সাঁই ইত্যাদি ইত্যাদি। একে পেলে মহাসুখ, মহানন্দ লাভ করা যায়। কিন্তু দুই অর্ধবিন্দুকে পূর্ণতায় পরিণত করা কঠিনসাধ্য, আর্জান শাহ তাঁর একটি গানে যাকে কালার সঙ্গে বোবার মিলন বলেছেন। আমার কালা আর বোবার মিলনে খুঁজে পাই বেঁচে আনন্দ। সৃষ্টির ষড়ঙ্গ। আমাদের আত্মিক অভিব্যক্তি, যার শিকড়টি বসানো রয়েছে দৈহিক জীবনের মাটিতে। মানুষের মুক্ত অসীম আর মুখরিত সসীমের আশ্রয় নীড় এই কবিতাগুলির খন্ড খন্ড আনন্দভৈরব...











