Friday, October 28, 2022

C/O সুবোধ সরকার | অরিজিৎ চক্রবর্তী

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||



ভাবনাআলেখ্য ও চৈতন্যডোবা   অরিজিৎ চক্রবর্তী 


১৯৯৭ সাল। আমি বেশ কিছুদিন ধরে কবিতার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছি। মাঝেমধ্যে কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্তের অফিসে যাই। রবিবার হলে কবি কৃষ্ণা বসুর বাড়িতে। সে এক অন্য সময়। কৃষ্ণাদি খুব স্নেহ করতেন। আর রবিবারের দুপুরের খাওয়াটা ওনার বাড়িতে প্রায় নির্ধারিত ছিল আমার। একদিন মঞ্জুষদার পোদ্দারকোর্টের অফিসে ঠিক হলো " শুভস্বর" নামে একটি নতুন পত্রিকা প্রকাশিত হবে। মঞ্জুষদা সেই পত্রিকার সম্পাদক। ফলে লেখা জোগাড়ের তোড়জোড়। এক শুক্রবার আমাকে দায়িত্ব দিলেন, সামনের রবিবার সিরিটিতে যেতে হবে। কবি সুবোধ সরকারের কাছ থেকে একটা কবিতা নিয়ে আসতে হবে পত্রিকাটির জন্য। আমি প্রায় লাফিয়ে উঠলাম। তখন সুবোধদার " ছিঃ" পড়ে ফেলেছি। কবিতা সম্পর্কে গভীর ধারণা না থাকলেও এই বইটি পড়ে আমার আত্মতৃপ্তি ঘটে ছিল। একদম অন্যরকম ভাষায় লেখা সেই কবিতার বই। যাইহোক রবিবার সকাল সকাল সোজা সিরিটি পৌঁছলাম। বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম। মঞ্জুষদার কথা বললাম। উনি আমাকে বসতে বললেন। চা বিস্কুট খেলাম। হাতে একটা খাম দিয়ে বললেন," ভেতরে কবিতা আছে।" আমি মাথা নাড়লাম। তারপর খানিকক্ষণ সময় কাটিয়ে প্রিয় কবিকে একটা প্রণাম ঠুকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। সেদিন মল্লিকাদি বাড়িতে ছিলেন না।  রোরো ছিল। ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ভীষণ ভালোলাগা নিয়ে প্রবল কবিতাময় ঘোরের ভিতর রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম।

রাস্তায় লোকজন কম। সকাল দশটা সাড়ে দশটা হবে। গাছের পাতা হাওয়ায় দুলছে। আমার উল্টো দিক থেকে একজন উস্কোখুস্কো চুলের বয়স্ক ভদ্রলোক এগিয়ে আসছেন। সামনাসামনি হতে হাত নাড়লেন। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। উনি বললেন, " সুবোধের বাড়ি গিয়েছিলে?" উত্তরে বললাম, " হ্যাঁ "। উনি বললেন, " আমি প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত।" প্রণাম করলাম কবিকে। জিজ্ঞেস করলেন, " তুমি কবিতা লেখো?" বললাম, " হ্যাঁ"। তারপর এগিয়ে গেলাম। সামনে পার্ক। গাছের নিচে বেঞ্চে বসলাম। ব্যাগ থেকে খামটা বের করলাম। কবিতার নাম- বিসর্গ। কবি সুবোধ সরকার। স্মৃতি থেকে যেটুকু মনে পড়ে, " তোমার পিঠে পেন্সিল দিয়ে একটাই অক্ষর লিখে দেব, বিসর্গ..."  একবারে শেষ অংশে "কত জন কত কি লিখে দিলো! আমি একটা বিসর্গ লিখলে তার মানে বলতে হবে?" কবিতাটা এভাবে শেষ হলো, আমার ওই সময়ের খুবই সাধারণ কবিতা চেতনাকে এই লাইনটি ভাবিয়ে তুলল। শুরু হলো কবি সুবোধ সরকারের সঙ্গে আমার বাল্যকালের সখ্যতা।

পরবর্তী সময়ে তাঁর কবিতা পড়তে গিয়ে বারংবার মনে হয়েছে সুবোধ সরকার ধীরে ধীরে সমস্ত অলংকার ত্যাগ করে কবিতার ভাবনা ও প্রয়োগে বাস্তবের এ্যালিবাইকে তুলে ধরেছেন। যখন "ঋক্ষ মেষ কথা" পড়ছি তখন মনে হচ্ছে শব্দের বৈপরীত্য, সংঘর্ষ, এই দ্বন্দ্ববাদই তাঁর কবিতার মূল কথা। বিপ্লবী মায়াকভস্কি ব্যক্তিগত প্রেমের প্রচন্ড ব্যর্থতার সংকট মুহূর্তে বারংবার হৃদয়ের ক্ষত জুড়োতে নিজেকে মানুষের ভিড়ে লুকোতে চেয়েও পারেননি। তাই সেই ভয়াবহ স্বগতোক্তি--- "I jump, I jump / But I can't jump out of my existence" নিজের অস্তিত্বের, চেতনার, ক্ষমতার গণ্ডীকে ক্রমাগত অতিক্রম করার দুরন্ত প্রয়াস আবার অতিক্রম করতে না পারার সচেতন ব্যর্থতা বোধই শিল্পীমাত্রকে উন্নীত করে মহত্বের সিংহাসনে। সদ্য কবিতা লিখতে আসা তরুণ সুবোধ হয়তো এরকমই কোনো অচেনার দোলাচলে লিখে ফেলেছিলেন এই কবিতাটি।

"আমার মাথার রঙ ও আয়তন দেখে চমকে উঠেছিল মা।

আজ,আমার আর কষ্ট হয় না, 
প্রথম প্রথম অনেকেই ভয় পেত।

আয়নার সামনে এসে দেখি মানুষের না, আমার মাথা এক মেষের 
আয়নার সামনে এসে দেখি মানুষের না, আমার মাথা এক ঋক্ষের 

এই ঋক্ষ মেষ গল্পের ভেতর কোনো হাহাকার নেই, কৌতুক ঢোকেনি কোথাও

এক গন্ধর্বের ছেলেমেয়ে সূর্যাস্ত দেখতে এসেছে
আমি তাদের মাঝখানে পিঠ কুঁজ নিয়ে দাঁড়িয়েছি
কুঁজের অগণিত মুখ নিয়ে বেরিয়ে আসছে কীট।" 

( ঋক্ষ মেষ কথা )

আমি এই বইটির কবিতা গুলো বহুবার পড়েছি।  থেমেছি। বিস্মিত হয়েছি। প্রাথমিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আধ্যাত্মিক নয়, কিন্তু অন্তর্মুখ ও অনুভূতিপ্রধান হবার ফলে বাস্তব স্পর্শের অতীত। হয়তো মরমিতার অপরিচিত সান্দ্রতা--- রহস্য কুয়াশার স্তর; এবং সেই কুয়াশা অনুভব করার অনিবার্য মোহমুক্তি। এই অনুভব কিন্তু অগভীর প্রাণময় আবেগের প্রত্যক্ষতা নয়, আবার যে চিন্তাধর্মী মন আবেগকে জয় করে, যা পর্যবেক্ষণ করে এবং অন্তর্নিহিত চিন্তাগত অবকাশকে প্রকাশ করে, সেই মনের অনুভূতিবিহ্বল সত্যও নয়। আসলে এখানে দু-রকমের বিশুদ্ধ এবং ঐকান্তিক প্ররোচনা আছে।একটি হল, প্রাণ নিজের সম্পর্কে যে সহজাত বোধি লাভ করে, তার শক্তি। এই বোধির ফলে কবিতাটির অনুভূত বিষয় ও তার প্রকাশভঙ্গির মধ্যে একটা প্রত্যক্ষ এবং সুস্পষ্ট তাদাত্ম্যাশক্তি দেখি, সেইটা। অবশ্য এছাড়া চিন্তাগত আন্তরিকতারও একটি শক্তি আছে, কিন্তু সেটা প্রাণ ও আত্মার মধ্যবর্তী স্তরের জিনিস। তাই হয়তো কবি অচিরেই বলতে পারেন, " এই ঋক্ষ মেষ গল্পের ভেতর কোনো হাহাকার নেই, কৌতুক ঢোকেনি কোথাও" তারপর একদম শেষে " কুঁজের অগণিত মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে কীট" এই"কীট"-ই কি কীটদষ্ট অনন্তের গান? আসলে এই কবিতাটির ধ্বনিতরঙ্গ থেকে যে চিত্ররূপের আভাস--- অতীন্দ্রিয় ব্যঞ্জনাবহ হোক কিংবা ইন্দ্রিয়গ্ৰাহ্য , কবিতাটির নির্মাণে তা আবশ্যিক।

বৃহদারণ্যক উপনিষদে ধ্বনিকে আলোর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।যাজ্ঞবল্ক্যের কাছে বিদেহ রাজের প্রশ্ন ছিল-- পৃথিবীতে যখন সূর্য থাকবে না,চন্দ্র থাকবে না, সেই অন্ধকারে কিভাবে পথ চলবো? যাজ্ঞবল্ক্য উত্তর দিলেন-- ধ্বনি। ধ্বনিই তোমাকে পথের সন্ধান দেবে। তাই নির্দ্বিধায় বলতেই হয় " ঋক্ষ" শব্দটির অর্থ ভল্লুক,  আবার নক্ষত্র। আমি পাঠক হিসেবে দুটোকেই আঁকড়ে ধরতে পারি। আবার এই সব কিছুর থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে বলে দিতে পারি বড্ড দুর্বোধ্য। অথচ আমি যতটা পাঠক, তার থেকেও বেশি কবিতার ক্রীতদাস। মার্কসের সবচেয়ে প্রিয় কথাটা খুব মনে পড়ছে "Nothing human alien to me "এই কথাটাই যদি এই কবিতাটির বীজমন্ত্র হয়, তাতেই বা অপরাধ কোথায়? আসলে ঋক্ষ থেকে ঋক্ষের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আজ কবি নিজেই নক্ষত্রের জামা পড়ে ফেলেছেন। তাঁর কবিতার সমগ্ৰতাকে ছুঁয়ে ফেলেছেন। ভবিষ্যতের কবিতার দিকে সুবোধ সরকারের এই স্বচ্ছন্দ চলন বাংলা কবিতার একটি উজ্জ্বল মাইলফলক।



1 comment:

দেবলীনা said...

অসাধারণ একটি আলেখ্য পড়লাম কবি অরিজিৎ চক্রবর্তীর সুদক্ষ কলম ও কাব্য ভাবনায় সেজে ওঠা এই আলেখ্য পড়ে এক অভাবনীয় অনুভবে জাড়িত হলাম। কবির সাথে প্রথম আলাপ থেকে তাঁর কবিতার এমন মর্মভেদী আলোচনায় সমৃদ্ধ হলাম।