Friday, October 28, 2022

C/O সুবোধ সরকার | অভিজিৎ দাস কর্মকার

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন || 
সুবোধ সরকার-কে নিবেদিত কবিতা 



সুবোধ আলোয়  অভিজিৎ দাস কর্মকার 


তুমি যেদিন প্রথম এসেছিলে আমার কাছে
তোমার হাতে মায়াকভ্ স্কি
আর চোখে
সকালবেলার আলো। বলেছিলে
আমেরিকা
যেখানে স্বাধীনতাও একটি মূর্তি। 

আমি মল্ল পথ থেকে তিলোত্তমা নগরে 
ছুটে গেছি দীর্ঘ সাহিত্য নিয়ে। তোমাকে 
আমরা বাঁচাতে পারিনি কবিতা।

সারা দেশ জুড়ে আমরা কেঁদেছি, 
সারা দেশ জুড়ে আমরা ফুঁসেছি।

এতো প্রেম সারা শরীর জুড়ে তবুও মেয়েটিকে 
বলা হয়নি কতোটা ভালোবাসার পর
মন আঙার হয়।শুধু মনে পড়ে

অফ্ পিরিয়ডে ত্রৈলোক্যনাথের ডমরু চরিত পড়ছিলাম
ওটা কেড়ে নিয়ে একটা পেপারব্যাক ধরিয়ে
মেয়েটি হাসতে হাসতে চলে গেল। এখন

আমি পলাশপুরের সেই ছেলেটিই হলাম! 

পলাশপুরের ছেলেটি এই প্রথম মেয়েটিকে দেখল
একটি মেয়ের চলে যাওয়া দেখল। 
পলাশপুরে কি বৃষ্টি এসেছে ?
কতদিন বকফুল ভাজা খাই নি। 
স্টিরিওতে বেজে উঠল গমগমে জ্যাজ, আফ্রিকান ড্রাম
পাশের বাড়ি থেকে চার জন নর্থ স্টার এসে দাঁড়াল
অন্ধকার করে শুরু হল নাচ
এবার সবাইকে নগ্ন হতে হতে, পলাশপুর, পলাশপুর
কাম অন, আমি, আমি, টাচ মি হিয়ার !
অন্ধকারে একটা চাপা কান্না শোনা গেল।

সুইচ অন করতেই কেঁদে উঠল কবিতা

অক্ষরের সাথে বেঁকে বসা অনুসন্ধিৎসা 

মাকে চিঠি লিখলাম। শ্রীচরণেষু মা…
আমার খাতার ভিতর সুবোধ সরকারের কবিতা 
আমি, সে-রকম একটা কবিতার বই লিখবো
যেখানে প্রেম, প্রেম, আর প্রতিবাদ আসবে উঠে 

আমি কোনো দোষ করিনি তো?

আমি বিহারের কথা, দামিনীর কথা, ভিয়েতনাম 
সব
সব অনায়াস মুখস্থ করে নেবে, মা। আমি
রবীন্দ্রনাথের দিব্যি করে বলছি, তোমার মেয়ে ফিরোজা 
আমার মৃন্ময়ী, আমার লাবণ্য
আমার সুচরিতা । মা গো, আবারও

সুইচ অন, দেয়ালে পিঠ দিয়ে
নগ্ন পলাশপুর কাঁদছে
তার পুরুষত্ব পান করছে সালোয়ার কামিজ
যেন প্রাচীন গ্রিসের কোনও ছবি। 

হে চোখের জল, রজনীগন্ধা কফিন-এ
বন্দী থাকা রূপম-এর আর্ত, দামিনীর স্মরণ 
এখন বদলে যাওয়া রামবাবুকে আর ভালো না লাগা
সবই লিখবো এভাবে
বিহারের মেয়েরা
উত্তরপ্রদেশের মেয়েরা 
রান্না করতে করতে কাঁদবে
আর চোখ মুছবে। আমি-ও 
আজ তোমার জন্য কাঁদছিলাম মা

টাকা পাঠালাম, ঠিকমতো ওষুধ কিনে নিও
গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়
এখনো অনেক গ্রন্থ পড়া হয় নি।


Tuesday, May 17, 2022

রঞ্জনা ভট্টাচার্য-র কবিতা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||  রঞ্জনা ভট্টাচার্য




শিরোনামে ঝুল জমে আছে


ছাদ শুনলেই কার্নিশ ভেঙে পড়ার আওয়াজে কান ফেটে যায়, 
ঝুলন্ত তার থেকে নেমে আসা শাড়ির
ফাঁসে আটকে গেছে টবের গন্ধরাজ, 
সাবানের ফেনা মাখা শব্দেরা পিছলে পড়ে যায় টাইলসের। 
আমি ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বলি, 
কিছুই ভাবছিলাম না, ভাবনার বড় জ্বর
জলপটি দিয়ে ওকে ঠাণ্ডা করি আগে। 


বৃশ্চিক রাশিতে চাঁদ প্রবেশ করলে
আমার কেমন দংশন পায়। 
 প্রচুর বিষ ঢেলে সান্ধ্য চাঁদকে পুড়িয়ে
দিই, কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে  থাকে আত্মগত রাত। 
আমি আধখাওয়া নখের কোনে সূর্যোদয়ের আগ ভাগ তুলে রাখি। 


নির্বাসিত স্রোত,  তোমার ঘুমের মধ্যে
অজানা তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বকুলের গন্ধ  ভাসায়, 


  কিশোরী নিঝুম হাতে শব্দবন্ধ
নৌকা বানায়, 
একা একা বেয়ে চলে
  প্রেমিক -তরঙ্গ নির্মাণ, 

 ঠোঁটে তার অমৃত-রোদ।

 নির্বাসিত স্রোতে
হেঁটে যায় পাথরের বুক খুঁড়ে উঠে
আসা পুঁজ -রক্ত। 

জখম এক মাধুর্যের নাম। 
ছুঁয়ে থাকে নির্বাসন, আনাগোনা, 
স্মৃতির পলল.. 

নির্বাসিত স্রোত, তোমার সিঁড়ির নীচে
কেঁপে ওঠা দীর্ঘ কবিতারা কেঁদে উঠে
বলে পাতালপুরীর মুখে অশ্লীল 
 ব্রণের ক্ষত।  ধকধকে চোখের চিৎকার ধীরে পোড়ায়
 ধীরে  শোক-স্বপ্ন-মায়া... 


চিৎ সাঁতারে দেখি 
আমাকে শূন্য করে তুমি 
অঞ্জলি দাও , 
অনুভূতির গায়ে বনতুলসীর ঘ্রাণ। 
মাথার উপর গুমঘর;
আলুঝালু অজ্ঞান আনন্দ হয়ে
নেমে আসে বিমূর্ত শরীরে, 
আমার এঁটো তোমাকে খাওয়াতে
গিয়ে দেখি চারে চন্দ্র মুড়কি বাতাসা
 দুর্ভিক্ষের অভিমান ভাঙে, 
উপোসী রাতে দোতারার ঘরণী আমি
গহীন রাতে বাওরে চাঁদ আর সূর্যের সঙ্গম।


আমার কোনো পড়াশোনা নেই, 
আমি ঘুমন্ত মুখের এক পাশ দিয়ে
ঝরে পড়া লালায় শিখেছি লোভ আর
নির্লিপ্তি। 
আমি আপনাদের শেকসপিয়র পড়িনি, 
দেরিদা কে জানিনা, মনে হয় সময়ের চাবিওয়ালা ছিলেন, আবছা আলোয় 
মায়ের মুখের মেচেতার দাগ দেখে শিখেছি  নারী মানে ইনভেস্টমেন্ট, 
প্রফিটের দোর গড়ায় দাঁড়িয়ে সন্তান
কেমন ক্যাপিটাল হয়ে যায়। 



Tuesday, April 26, 2022

সৈকত ঘোষ-এর নির্বাচিত সিরিজ কবিতা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||  সৈকত ঘোষ-এর নির্বাচিত সিরিজ কবিতা



একটা বিন্দু। এক বুদবুদ। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ বিন্দু থেকে আলফা বিটা গামা পার্টিকেলস ছিটকে পড়ছে ডিমের কুসুমের মতো ফ্রায়িংপ্যানে। সেই বুদবুদ থেকে একটা বিস্ফোরণ। তীব্র মেটালিক। মস্তিষ্কের প্রতিটি গ্রন্থিকে প্রবল ভাবে নাড়িয়ে দিল...

জরাসন্ধের বিছানা 

১.

সময় পেছন দিকে হাঁটলে গ্লাসের জলে
ছায়ার প্রলেপ পড়ে
অন্ধকার আমাদের পরিভ্রমণ করে রোজ
কয়েকটা সংকেত ধরে এগিয়ে গেলে 
যুক্তাক্ষরগুলো ভাঙতে শুরু করে
দহনপর্বে আরও একবার কেন্দ্রচ্যুত ভগবান

মেঘ দিশা খোঁজে না 
চোখ থেকে গড়িয়ে নামে নীল অপরাজিতা 


২.

ভূ-ত্বকের নিচে ক্রমাগত বিস্তার পাচ্ছে অধিকারবোধ 
আমাদের জামাগুলো খুলে নিলে 
হ্যাঙারে ঝোলে হাওয়াই দ্রাঘিমা 

প্রতিটা পাথরে আমি রূপভেদ খুঁজি 
হিমাঙ্কের নিচে মৌলিক হয় নিশ্বাস 
সময়কে ধ্রুবক ধরলে প্রতি অণু নিউক্লিয়াস 
পৃথিবীর পালস রেট ধরে রাখে 

জলের আঁচলে তুলে নিই ছায়ার গ্রাফচিত্র 
নতুন শহরের মানচিত্রে তোমাদের মুখগুলো আঁকা হোক 


৩.

আগামীর যন্ত্রণা কাঁধে হামাগুড়ি দিচ্ছে বিসর্গেরা
সন্ধিবদ্ধ রুমাল জানে তার ব্যপন ক্ষমতা 

একটা ছায়াপথ থেকে খসে পড়ছে সমবাহু গান 
রুপোলি চিৎকার বর্গভেদে বৃত্ত আরও আণবিকে জল 
আনুপাতিক বিভাজন থেকে বসন্তকাল জন্ম নিলে 
সেখানে কোকিলের আনুগত্য থাকে না 

বৃষ্টিরও ঝোক থাকে শ্লীলতাহানির
প্রতি অণু দুঃখের সমীকরণ আগামীর গান শুনেছে 
রহস্য কেবল অনুমানে দানা বাঁধে তা নয় 
অনেক চিন্তাশীল মাথা এক হলে মেরুকরণ স্পষ্ট হয় 


৪.

একচোখ বন্ধ করলে জলের পৃষ্ঠটান 
দরজা সূত্র অতিক্রম করে,

গাছ মাটি পাথর ম্লান হাসে 
ছোটোবেলায় শোনা শিকারি গল্পটার মতো
সৃষ্টির আদি যুগে ফিরে যায় মানুষ 

আত্মজীবনী লিখতে বসলে 
একটার পর একটা সরলরেখা আমাকে ছেদ করে যায়
বিন্দুগুলো জুড়তে বসে সময়ের যমজ

স্মৃতিরা হাইপার সেনসিটিভ 
এডিটিং টেবিলে একটা এল ই ডি আলো
মানচিত্র থেকে ঘুম নিয়ে আসছে 


৫.

ইমেজ অনেকটা নতুন রুমালের মতো 
বুক ভরে শস্যের ঘ্রাণ নিতে নিতে 
কখন আবিষ্ট হয়ে যায় 

তোমার হাসি দেখে বোঝার উপায় নেই 
কেয়ার এবং শেয়ার শব্দদুটো আক্ষরিক অর্থে 
কতখানি ভার বহন করে 

ছাতার নিচে হাঁটলে বন্ধুত্বের সংজ্ঞাটা
কফিকাপে গিয়ে ঠেকে। এর বেশি হলে 

শহরের সমস্ত যানবাহন অবাক চোখে তাকায়
ফায়ারঅ্যালার্মে বুঝি 
আমার গালনাঙ্কে ভিজে উঠেছে পকেটের রুমাল...


৬.

বালিঘড়ি উলটে দিলে 
ভরকেন্দ্র কোমর থেকে নখে স্থানান্তরিত হয়

জোনাকি লেখে নির্ঘুম সংলাপ
স্ক্র্যাবার খুঁটে তুলছে মৃত হাসি কোষ
ঢেউ থেকে রেহাই পায়নি পতঙ্গরাও

আরশিতে রাখা ঘুম সুযোগ বুঝে ঠিক ঠোঁট ফুলিয়েছে
প্রতিটা স্ট্রোকে জলের চিহ্ন ফুটিয়ে তোলে কাগজ
কিছুক্ষণের জন্য সময় ও দূরত্ব গলাগলি
এটা কোনও কোটেশন নয়

প্রতি রাতে বিষণ্ণতার হাজারো এক উপকরণ
কাটা জিভের আরও গভীরে নামছে...


৭.

দেয়াল বন্ধুরা টিসার্টে উঠে এলে 
মিছিলে হাঁটা ছাতারা লজ্জা পায় 
টি আর পি যাই বলুক 
রোজকার মতো সূর্য প্রনাম ধরে রেখেছে মেগাসিরিয়াল

ধর্মের কল কি বাতাসে নড়ে ?
এ প্রশ্নের উত্তর খুজতে যতই সাপ্লিমেন্ট দাও 
ভিটামিনের অভাব পুরো করতে পারেনা ক্রিয়াপদ 

জীবনে যতবার কিছু বলতে গেছি
অসঙ্গতি থেকে গেছে সে বলায়
দূরত্বের স্কেলে কোনোকিছু বিশ্লেষণ করলে 
অক্ষমতাই কেবল প্রকাশ পায় 


৮.

কার্নিশ ধরে দাঁড়াতেই আমার সামনে আসে 
সেই সুগার-ফ্রি মেম 

'ক' এ কাক 
'গ' এ গোরু 
'র' এ রুবারু...

ফ্রেমটা ব্ল্যাকআউট হতেই 
ধারাবিবরণী 

ব্যাকরণে 
        উলটো শয়নে 
                 শির্ষাসনে
                          হাই সেনসেক্স


৯.

ছায়াময়তা থেকে উঠে আসে সবুজ সন্ধে 
সোনালি চতুর্ভুজ চৌকাঠ ডিঙিয়ে শুষে নিচ্ছে উত্তাপ 
ম্যাগনেটিক স্পর্শে আকর্ষণ থাকে না 
গ্রিক পুরাণে বৃষ্টি দেবতা এতটাও স্পর্শকাতর নয় 

চৈত্র সেলে একে অপরের মেরুদণ্ড বেচে দিচ্ছে 
দাড়ি কামানো কুকুরেরা পোজ দিয়ে দাঁড়ালে
জেলিফিশের বুকে মধ্যরাত নেমে আসে 

কোথাও কোনো ঘুলঘুলি নেই, কোথাও নেই জলীয় মিছিল 
দেয়াল চিত্রে পরীক্ষামূলকভাবে আঁকা হচ্ছে যাযাবর জীবন 


১০.

পেছন দিকে দৌড় শুরু করলে আলটিমেটলি
যেখানে পৌঁছানো যায় 
যেখানে শরীরের কোনো আকার থাকে না 

আমার সামনে দপদপ করছে ফিলামেন্ট 
মাথার ভিতর থেকে গ্রে-ম্যাটারগুলো ছড়িয়ে পড়ছে 
ম্যাজেন্টা কালিতে 

প্রত্যেকটা অক্ষর থেকে চক্রাকারে বেরিয়ে আসছে 
অতিরিক্ত আলো 
অভ্যেস বসত পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ শেষে 
কবিতা লিখতে বসলেই একটা প্রশ্ন বারবার 
সামনে আসে 

অনিচ্ছুক চাষিরা কি সভ্যতার ভাগ পাবে না ?


১১.

অবাধে যন্ত্রণারা চরাচর করে মস্তিষ্কে
অসময়ে বিভাজ্যতার নামতা লিখতে বসলে
মুখের চারপাশে খণ্ডে খণ্ডে ভেসে ওঠে 
জীবনের পাইগ্রাফ 

প্রায়শই আমি দিকভ্রান্ত হই
শেষ বিকেলে যখন পাখিরা ঘরে ফিরে যায়
আমার শরীরে ভিড় করে নাগরিক ধোঁয়াশা

প্রত্যেকটা ঘুম কোনও এক আণবিক স্তরে
নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসে


১২.

মেঘেদের বর্ণমালা শুষে নিচ্ছে শহুরে লীনতাপ 
পরজীবী চরিত্রেরা পূর্বজন্মের ইতিহাস আঁকড়ে 
প্রজনন করবে এটাই তো স্বাভাবিক 

যেহেতু আমাদের সভ্যতা নদীমাতৃক তাই 
মেয়েদের ডেনিম থেকে শুরু হয় অ্যানাটমির ক্লাস

আলো নিভে গেলে আমি ঘ্রান নিতে থাকি 
আসেপাশের সমস্ত শূন্যপদ কী এক অজানা টেন্ডারে
লুফে নিচ্ছে খানদানি 'খ' 


Thursday, March 24, 2022

প্রভাতহীন~নীলিমা সাহা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||   নীলিমা সাহা 

আমার চোখে প্রভাত-দা

চোখের আলোয় দেখেছিলেম
                চোখের বাহিরে
অন্তরে আজ দেখব যখন 
               আলোক নাহিরে---

রোদ্দুরের স্বরলিপি ঢুকে পড়েছে অভিমানের দপ্তরে।তিনি এখন ঘুম স্টেশনে অপেক্ষমান।আমি শুনছি ঘুমনৌকোর ছলাৎ...

কবি অলোকবিশ্বাসের প্রতিক্রিয়া সঙ্গে  আমার আন্তরিক বিশ্বাস ছিল যে প্রভাত চৌধুরী এর আগে বহুবার অসুস্থ হয়েছেন,আবার সেরেও উঠেছেন।এবারও সেরে উঠবেন,সেরে উঠে আবার আগের মতো বক্তৃতা দেবেন ।নিজের জন্মদিন পালন করবেন মহাসমারোহে ।তাই সবাই চিন্তা করো,কিন্তু দুশ্চিন্তা কোরো না।দুশ্চিন্তা 
করলে প্রভাতদা ব্যথা পাবেন।

কিন্তু না,কষ্টের, দুর্ভোগের প্রতিকূলতা কাটিয়ে আবারও ফিরে এলেন না প্রভাতদা ।সহসাই উত্তর বাতাস এসে থরথর কাঁপিয়ে গেল শীতজানালা ...দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ ...খুলেই ঢুকে পড়ল কথাহীন ব্যথা --হাতে বিয়োগচিহ্নের সাদা পাতা,কাঁধে নীরবক্লান্তবিষাদ অত্যাশ্চর্য না-ফেরার দেশের ঠিকানা প্রভাতদা এখন অনন্তলোকে।নিনি পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় একদা একান্তেই ভালোবেসে লিখেছিলেন---

নীলিমা-কে নিয়ে লেখা কবিতা//প্রভাত চৌধুরী 

নীলিমাকে আমি পুতুল খেলতে দেখিনি,এই স্বীকারোক্তি থেকে কেউ যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন--নীলিমার
পুতুল খেলার বয়স ছিল না '
এই তথ্যটিকে আমি প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছি--তাহলে ভুল করবেন
আমি আমার সীমাবদ্ধ দ্যাখা কথাই লিখতে চাইছি

নীলিমা ভূত দেখে ভয় পায় কিনা তাও আমার জানা নেই
নীলিমা আদৌ কোনো  ভূত দেখেছে কিনা তাও আমি জানি না 
তাহলে কীভাবে ভূত এসে পড়ল অদ্ভুত ভাবে,তাও আবার পুতুল খেলার অনুষঙ্গে 

পুতুলখেলার সঙ্গে ভূতেদের কোনো সহযোগিতা আছে এমন কথা ত্রৈলোক্যনাথও
লিখে যাননি

নীলিমার কি কোনো পোষা বিড়াল আছে, তাও আমার জানার পরিধির বাইরে 
গোগোল তিতলি অদ্রিজার কাছে ম্যাও-এর মোবাইল নম্বর আছে,আজই আমাকে 
জানিয়েছে,নম্বরটা বলেছিল
গড়গড় করে, সেটাও ভুলে গেছি
নীলিমা  সম্পর্কে এত কিছু না জেনেও নীলিমাকে নিয়ে কবিতা  লিখছি,তবে কথা দিচ্ছি নীলিমাকে পুতুলখেলা
ভূত এবং পোষাবিড়াল সম্পর্কিত তথ্যগুলি সংগ্রহ করার পর আবার  নীলিমাকে
নিয়ে কবিতা লিখতে বসব,
বসলেই একটা টয়ট্রেন এগিয়ে  আসবে, আমি সেই ট্রেনে ওঠার চেষ্টা  করলেও উঠতে পারব না,নীলিমা  কি পারবে,তা নীলিমাই জানেতো,এই হচ্ছেন প্রভাতদা ,কবি প্রভাত চৌধুরী।আর তাঁর লেখনী-স্টাইল!কিভাবে কাব্যভাষায় অক্ষরমহিমা শব্দে শব্দে গড়ে তুলবে এক জাদু-বাস্তবতা ,বলা বাহুল্য যে তা কবিরই অনুপম দক্ষতা।এইভাবেই কবির কবিতার ঘর- ঘরনি এক ঘরানার আবিষ্কার করেছে যেখানে অনায়াস প্রবেশে পাঠকচিত্তের প্রাপ্তি চমকিত আমোদ...শব্দের মোহজালে তাঁর কবিতা খুব সহজেই পাঠক মনকে আকর্ষণ করতে পারে ।যেন টগরের ডালে ডালে দিগন্তের উপাচার সাজানো, যেখানে না-বলা সম্পর্কেরও ফুল তুলিতে ভুল হয় না।

তবু  আকাশের মহাপয়ার, ছন্দপতনে সহসাই জিজ্ঞাসা ও বিস্ময়ের চিহ্ন যে উড়ো এক উদাস বিষাদ সম্ভাষের কাপাসের আঁশ ১৯৪৪ সালে বাঁকুড়ার হাটকেষ্টনগরে প্রভাত চৌধুরীর জন্ম।শৈশবের বেশিটাই কেটেছে কালিঘাটে,কিছুটা বাঁকুড়ায়।পরবর্তীতে পেয়েছি পটলডাঙার ঘরে।ডানাভাঙা গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্ন জড়িয়ে ধরে অনুভবে যিনি এখনও অনুপ্রাণিত, তিনি সর্বংসহা সারদাময়ী যূথিকা বৌদি।তাঁর সঙ্গে আছে পুত্র পুত্রবধূ ও নাতির সাহচর্য ।

৬০এর দশকে কৃত্তিবাস পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্যজগতে কবি প্রভাত চৌধুরীর আত্মপ্রকাশ ।১৯৬৬ সালে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'শুধু প্রেমিকার জন্য '।ভাবতে অবাক লাগে যে এরপর থেকেই একের পর এক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ,বেশ কিছু পত্রিকার সম্পাদনা,নূতন পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ--এত্তসব কাজ কীভাবে করে উঠতেন।যদিও পরবর্তীতে প্রায় দুই দশক নিরলস চর্চার পর আনুমানিক  দশ বৎসর সাহিত্যগত থেকে
নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন।

পুনরায় নতুন উদ্যমে ১৯৯৩ সালে শুরু করলেন কবিতা পাক্ষিকের মতো পত্রিকা, যে পত্রিকা সকল পাঠক তথা লেখকের কাছে একটি মাইলফলক।পত্রিকা  প্রকাশের  পাশাপাশি চলতে থাকে তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ ।প্রকাশিত  হয় 'সাদাখাতা',সাক্ষাত্কার, আবার সাক্ষাত্কার, নোটবই, উত্তরপর্বের কবিতা, এইসব,হল্লাগুল্লা,সুসমাচার, কুশল সংবাদ,এবং প্রভৃতি ।কিন্তু 'কবিতা পাক্ষিক '-এর মাধ্যমেই প্রভাত দা  উত্তর আধুনিক প্রবণতাকে চিনতে ও চেনাতে চেয়েছেন বারেবার।অধুনান্ত কবি প্রভাত চৌধুরীর  প্রচেষ্টা ছিল  এবং চাইতেনও যে কবিতা সর্বদা আপডেট হোক।

বস্তুতপক্ষে উত্তর আধুনিক বা পোস্ট-মর্ডান বিশ্বসাহিত্যে তো বটেই, বাংলা সাহিত্যেও আজ বহুল আলোচিত একটি শব্দবন্ধ ।কবি প্রভাত চৌধুরীর  অদম্য উৎসাহে পাঠক তথা লেখকগোষ্ঠী খুঁজে পেল এমন এক প্লাটফর্ম যেখানে দিনগুজরানোর মধ্যে গচ্ছিত হতে থাকে স্বস্তি, তৃপ্তি ও আনন্দ ।সাহিত্যিক অপেক্ষা তিনি পরিচিত  হয়ে উঠলেন সাহিত্য কাণ্ডারী রূপে।

নিত্য দিনের সুখদুঃখ-আনন্দক্ষোভ-ক্ষুধামোহঅনুরাগ-অভিজ্ঞতার পাশাপাশি বিশ্বপ্রকৃতি জনারণ্য জীবন ও বহমান উত্তাপ এবং মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের হাতছানি তাঁর লেখনীজুড়ে।দিনলিপির মলিন পৃষ্ঠায় 'আমি'-র ক্ষুদ্রত্ব উপস্থাপনেও এক অভিনব পরিবেশন সত্যি খুব আকর্ষণীয় ।

প্রভাত দা নিজেই বলেছেন, তথ্য মেনে কবিতা লেখা হয় না।কবিতা থেকে আবিষ্কৃত হয় তথ্য ।কবিতা-যাপন একটা  বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত । ২৪×৭শুধু কবিতাতেই সাঁতার কেটে চলাই হচ্ছে যাপন।যেমন তিনি বলতেন,ফুলগাছে জল দিচ্ছি, এই জল দেবার কাজটি রূপান্তরিত করতে হবে কবিতালেখার কাজে।এটা কীভাবে করতে হবে সেটাই নিজস্বতা ।প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন ঝুলবারান্দা,ভিন্ন ভিন্ন রান্নাঘর।টেনিস কোর্টও
আলাদা,পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রেও ভিন্ন স্বাদে বৈচিত্র্য আনতে হবে ।

তাঁর একটি কবিতাতেই দেখি এই বৈচিত্র্যের স্বাদ।তিনি লিখছেন---
আমার কবিতা ---আমি বর্ষবরণে কবিতা লিখতে চাইলে বর্ষাবরণের কবিতা উঠে আসতে চায় ।এখন চেষ্টা  করতে হবে বর্ষ এবং বর্ষার পালসরেট।একটা আ-কারের জন্য ব্যাঙ্কের আচরণে কী রাসায়নিক পরিবর্তন হয় কিংবা প্রস্ফুটিত ফুলের রং এবং গন্ধেরও রকমফের  হয়ে থাকে তার জন্য  কোন সূর্যোদয়ে যেতে হবে তাও জানা নেই তবু বর্ষকে তো বরণ করতেই হবে ।না হলে বঁধুয়া কী করে ঘরে ঢুকবে শাঁখ এবং বরণডালা নিয়ে  যারা অপেক্ষা করছেন ।

তাদের কথা না ভাবলে লোকে  মন্দ বলবে যে ---এভাবেই চলার স্বচ্ছন্দ তাঁর কাছে এক শিক্ষণীয় বিষয় 
বাংলা কবিতার  পরিবর্তনে কৃত্তিবাস কতটা সফল হয়েছে তার খোঁজ অমূলক।বরং বলাই বাহুল্য  যে প্রভাত চৌধুরীর কবিতা পাক্ষিক এমন  মাইলফলক,যেখানে নানান ডাইমেনশন, নানান অনুষঙ্গ এবং পরিবর্তিত discourse- এ সাবলীল চমৎকৃত চিত্রকল্পরূপী অটোমেটিক writing skill-এর ব্যাপার টা।এবং পাঠক অনায়াসে তা উপভোগ করে আনন্দ পায় ।প্রভাত দা হলেন rolling stone,তাই শ্যাওলা  জমে না।একাধারে পরাবাস্তব, জাদুবাস্তব যেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, তেমনি আছে তাঁর স্বয়ংক্রিয়তা।তিনি signature তৈরি করে নিজেকে ধরা দিয়েছেন এবং শপথ নিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্মকে শিখিয়ে তোলার কাজে।আসলে তিনি  প্রকৃতই কবিতা প্রেমিক।তবে  তাঁর এই হয়ে ওঠার পিছনে যাঁর ভূমিকা  অসামান্য,তিনি হলেন আমাদের বৌদি, সর্বংসহা সারদা, যূথিকা  চৌধুরী।

বাংলা সাহিত্য জগৎ এই মুহূর্তে  অভিভাবকহীন।১৯৯৩ সালে নতুন উদ্যমে নব কলেবরে কবিতা পাক্ষিক পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করলেও প্রভাত চৌধুরী নিজেকে পরিচিত করেছেন তাঁর পোস্ট মর্ডান টেক্সট স্বরূপ  উপন্যাস, গদ্য, এডিটরিয়াল নোটস-এ।তিনি  ভালই জানতেন কবিতা পাক্ষিক-এর ভেতর দিয়েই বাংলা কবিতার  যাত্রাপথ।এবং এই কবিতা পাক্ষিক তাঁর প্রাণ।তিনি  বারেবারে  বলেছেন, কবিতা হচ্ছে  নিজের মত প্রকাশের একমাত্র জায়গা।

এটা তো ধ্রুব সত্য যে বাংলা কবিতার ভাষা বদল প্রভাত চৌধুরীর হাতেই।অক্ষরবৃত্তের মহাসমারোহে  উত্তর আধুনিক ঢঙ এমন এক রসায়নে রসসিক্ত যে রসিকমাত্রায় কবিতাপথ যেমন রহস্যময় হয়ে উঠেছে, তেমনি বহুরৈখিক হাঁটাহাটি যেন তাঁর কাছে  অনায়াসলব্ধ।তিনি বারবার বলেছেন এর জন্য চাই আপডেট মাইন্ড ও আপডেট চোখ।শব্দের বহুল অর্থের ব্যাপক বিস্তারে ঘটে যায় আত্ম বিবর্তন ।প্রভাত-দার 'নোটবই '-এর কথা এ প্রসঙ্গে উল্লিখিত করতেই হয়।প্রভাত-দার এভাবেই উত্তর প্রভাতে  উত্তরণ ...যেমনটা ব্রাহ্মণ্যবাদের বহতা শব্দের উত্তরণ বুদ্ধে,বুদ্ধ থেকে  ভক্তিবাদ,সেখান থেকে রবীন্দ্র নাথ,রবীন্দ্রনাথ থেকে কল্লোল
---এভাবেই শব্দের  বিষয়মুক্তি ঘটতে থাকে।এমনটা কেবল কবিতায় নয়,উপন্যাস, এডিটোরিয়াল  নোট, গদ্য  সর্বত্র মুক্ত চিন্তনের অবকাশে একাধারে আধুনিক ও অধুনান্তপ্রাপ্ত হয়া ।ফলে পাঠক মনে এক মনকেমনিয়া স্রোত বইতে থাকে।এভাবেই  তিনি জাঢ্য ধর্ম ভেঙে শব্দের ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করেছেন ।....(চলবে)

প্রভাত চৌধুরীর যে সকল উপন্যাস তার মধ্যে 'সতীসাবিত্রী কথা উপন্যাসে ব্যথারা সুখের মতো হৃদয়ের রাত ছিঁড়ে নামে।কালিঘাটের বেশ্যাপল্লির কাহিনি বিশুদ্ধতায় আলোকময় ।আর 'অনুপম কাহিনি 'এমন এক পোস্ট-মর্ডান টেক্সট যেখানে প্রভাত চৌধুরী ও অনুপম একে অপরের অল্টার ইগো।এরা পাশাপাশি থেকে কথা বলাবলি করে সবার অগোচরে  আবার নিজেদের দূরে সরিয়েও রাখে। আত্মজৈবনিক উপন্যাসে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের ছায়ায় এইভাবে  নিজেকে ও পরবর্তী প্রজন্মকে  উপহার দিতে পারার দক্ষতায় প্রভাত দা চিরস্মরণীয় তথা চিরজীবী হয়ে থাকবেন।বলার অপেক্ষা থাকে না যে তাঁর  নিজস্ব পরিচয়ে তিনি অন্যদের থেকে  আলাদা ।

প্রভাতদার একটি স্মরণীয় কবিতা আজ খুব  মনে পড়ছে  :
যারা আমার শবযাত্রায় প্রথম সারিতে থাকবে তাদের বলে দিও--যেন চিৎকার না করে
চিৎকার আমার ঘুম ভেঙে যেতে পারে

যারা আমার মৃত্যুর পরে শোকসভা করবে তাদের  বলে দিও---যেন আড়ম্বর না করে
ঐশ্বর্যের টানে আমি জেগে উঠতে  পারি

যে আমার মৃত্যুর পরে 
চোখের জল ফেলবে সে তুমি---তোমাকে চুপিচুপি 
বলে রাখি,চোখের জলে 
আমার ঘুম ভাঙবে না

প্রভাত-দাকে লিখতে হবে এভাবে কখনও ভাবিনি, যেন নিজেকে তিনি লিখিয়ে নিচ্ছেন,যেভাবে  কবিতা লিখিয়ে নিতেন আদেশের  সোহাগে
যেন চুপিচুপি  আমাকে ডেকে  বলছেন--কে বলে গো এই প্রভাতে নেই  আমি ...

হ্যাঁ, কবির তো মৃত্যু হয় না।
প্রভাত-দা আছেন, থাকবেন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে, আমাদের সাথে, আমরাও আছি তাঁর সঙ্গে, থাকবও।


প্রভাতহীন~শান্তিময় মুখোপাধ্যায়

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||  শান্তিময় মুখোপাধ্যায়


প্রভাত চৌধুরী : বাংলা কবিতার এক মুকুটহীন সম্রাট

প্রায় চার দশকেরও বেশি যে মানুষটির সঙ্গে আমি সপরিবার ওতোপ্রোতো তিনি আর কেউ নন,বাংলা কবিতার আমৃত্য সৃজনকারী একক প্রতিষ্ঠান প্রভাত চৌধুরী। সেই প্রাক আশির দশক, যখন থেকে কলকাতা বইমেলা শুরু তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার বা আমার বন্ধুদের যেমন প্রয়াত শুভ চট্টোপাধ্যায়ের বন্ধনাতীত খুল্লামখুল্লা কোনদিনই বিচ্ছিন্ন হয় নি।তখন কলেজ স্ট্রিটে তিনসঙ্গী নামে একটা প্রকাশন সংস্থা ছিলো।যতদূর জানি তা ছিলো কথাসাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের জামাতা সমীর চট্টোপাধ্যায়ের। প্রায়দিন বিকেলে প্রভাতদার সঙ্গে আমার সেখানে যাবার সুযোগ হতো।এছাড়া ময়দানে বইমেলাতেও তিনসঙ্গীর স্টল থাকতো।প্রভাতদা সেখানে বসতেন।আর লিটিলম্যাগাজিন প্যাভেলিয়ানে বহরমপুর থেকে প্রকাশিত আমাদের রৌরবের টেবিল থাকতো।সেসময় বইমেলার স্টলগুলোর কোনো কোনো দুটো স্টলের মাঝখানে একটু ফাঁকা জায়গা রাখা হতো।যেখানে কতগুলোতে টয়লেট বা পানীয় জলের ব্যবস্থা আর খুব সরু ফাঁকা জায়গাগুলো খালিই থাকতো।যেগুলোকে গোদা বাংলায় আমরা বলতাম গলতা।সেগুলো ছিলো আমাদের মতো আরো অনেকের তরল আগুনে আচমন সারবার অলিখিত এবং নিরাপদ ব্যবস্থাপণা।বলাবাহুল্য প্রভাতদা ছিলেন আমাদের ক্যাপ্টেন। আর কলেজস্ট্রিট পাড়ার বেসামাল মহাপুরুষ  ভেটকি যার ভালো নাম প্রায় সকলেরই অজ্ঞাত সেই সিদ্ধার্থ ঘোষ অনিবার্যভাবেই সঙ্গী হতো আমাদের।বাঁকুড়ার চারণকবি বৈদ্যনাথও দুএকবার সঙ্গী হয়েছিলেন শ্রীমদ প্রভাতদার বদান্যতায়। প্রভাতদা সেসময় লেখালিখির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটা  রাজনৈতিক দলের ট্রেড ইউনিয়নে সরাসরি নেতৃত্বে থাকলেও কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে কখনো কিন্তু যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেননি। রাইটার্স বিল্ডিংসে তাঁর অফিসের টেবিলে প্রতিদিনই কোন না কোনো কবি বা গল্পকারকে উপস্থিত থাকতে দেখেছি। গল্পকার অনিল ঘড়াই এর সঙ্গে আমার সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো সেখান থাকেই।কবি বুদ্ধদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, অরূপ আচার্য(একান্তর),সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, সমীরণ মজুমদার(অমৃতলোক) ছাড়াও আরো অনেককে নিয়ে সেসময় একটা বৃত্ত গড়ে উঠেছিলো প্রভাত চৌধুরীকে কেন্দ্র করেই।৩৬ডি,হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের প্রভাতদার বাড়িও ছিলো অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। কবি যোগব্রত চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর তাঁর প্রথম কবিতার বই 'স্বজন বিদ্রোহ' প্রকাশের পরিকল্পনা হয়েছিলো এখান থেকে।বইটির মুখবন্ধে তারাপদ রায় লিখেছিলেন তা।আমার বিয়েও হয়েছিলো এই বাড়ি থেকেই।প্রভাতদার ইচ্ছেমতো গোধূলি লগ্নে এবং বামপন্থী পুরোহিতের যদিদং হৃদয়ং জাতীয় মন্ত্রোচ্চারণে। 
বাংলা কবিতার এরিণায় প্রভাতদার সব থেকে বড়ো কৃতিত্ব ১৯৯৩ থেকে আমৃত্যু প্রায় ২৯ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে একটা পাক্ষিক এবং পরে সাপ্তাহিক কবিতাপত্র সম্পাদন এবং প্রকাশনা।যার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিলো ২৪ বৈশাখ ১৪০০ বঙ্গাব্দ(ইং ৭ মে,১৯৯৩)।কালীঘাট মিলন সমিতির সভাঘরে ঐ প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, ফাদার গাস্ত রাঁবেজ ছাড়াও কলকাতা তথা বিভিন্ন জেলার অনেক কবিরা।এই কবিতাপত্রটি প্রকাশে তাঁর যে ভাবনাটি কাজ করেছিলো প্রথম সংখ্যার প্রাক কৈফিয়তে সেই কারণটি উল্লিখিত ছিলো -- "বিশ্বের দীর্ঘস্থায়ী কবিতা দৈনিকের সম্পাদনা এবং পরিচালনার সঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবে যুক্ত ছিলাম।পত্রিকাটির নাম 'সান্ধ্য কবিতা দৈনিক'।আমরা চাই কবিতার সেই পরিবেশ ফিরে আসুক।তাই কবিতা পাক্ষিক।"।যদিও আমি গর্বিত তবু বলা বাহুল্য প্রথম সংখ্যা থেকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমি এই পত্রিকা সম্পাদনা এবং প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।এবং প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত।এছাড়া সহযোগী সম্পাদক হিসেবে ছিলেন পিনাকীরঞ্জন ঘোষ ও সুজিত হালদার।আর একটা বড়ো কাজ প্রভাতদা যেটা করেছিলেন তা ধ্বংসকালীন কবিতা আন্দোলনকে দুমলাটের মধ্যে একত্রে সংকলিত করে ভবিষ্যৎ গবেষণার জন্যে উন্মুক্ত করে দেওয়া।বইটি সম্পাদনার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিলো আমার উপর।
পরিশেষে বলা যায় গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার এই রাজনৈতিক শ্লোগানটিকে শতজল ঝর্ণার ধ্বনির পর প্রভাত চৌধুরীই প্রকৃত অর্থে ব্যাপক বিস্তৃতি দিতে পেরেছিলেন।উত্তর ২৪ পরগনার আবীর সিংহ,মেদিনীপুরের রোশনারা মিশ্র,মউলি মিশ্র থেকে শুরু করে পুরুলিয়ার অংশুমান কর --- নব্বইয়ের প্রায় সব কবিরই প্রথম আত্মপ্রকাশ এই কবিতা পাক্ষিক থেকেই। বাংলা কবিতার দুর্ভাগ্য এইসব কবিতাপ্রাণদের কোনো বড়ো প্রতিষ্ঠান বা সরকারী তরফে কোনো পুরষ্কার জোটে না।গার্ড অফ অনার আর রাষ্ট্রীয় কাঁদুনি শুধু সেইসব তথাকথিতদের জন্যে।সফিস্টিকেশনের এই ধুলোবালি গায়ে না মেখেও বাংলা কবিতার মুকুটহীন সম্রাট প্রভাত চৌধুরী, আপনি বেঁচে থাকবেন আমাদের মতো শব্দশ্রমিকদের নিঃশব্দ স্পন্দের মধ্যে,অনুচ্চারিত শোকে ক্রমশ আরো বেশি মুহ্য হতে হতে।