Sunday, August 22, 2021

| নভেলেট | ডারউইনের চিঠি |

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||      

অরিজিৎ চক্রবর্তী-র   ডারউইনের চিঠি  পর্ব~২২

সন্মোহ দেখল তাকে।

খুব নিচু স্বরে বলল, তোমার ভাবনাগুলোকে আমি এনডোর্স করছি না। তবে এখন যা ভাবার আমি ভাবব। যা বলার আমি বলব। তুমি চুপ করে শুনবে। প্রতিবাদ করবে না। প্রতিরোধ করবে না। মেঘে ঢাকা তারার ভেতর থেকে এগিয়ে আসবে চাঁদের মতো।পাটভাঙা দুধে আলতা শাড়িতে খোলাচুলে তুমি হয়ে উঠবে সিন্ডারেলা!

আচমকা উচ্চকিত হাসিতে চারিদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। একদলা ঘৃণা ছড়িয়ে কেউ বলে ওঠে, ছিঃ! প্রতারক! স্বার্থপর! অমানুষ!

সন্মোহ চেঁচিয়ে উঠলো, " তুমি আসলে কেউ নও! তুমি প্যারানইয়া! সন্দেহবাতিকগ্ৰস্থ রুগি! 

---- ঠিক বলেছ। একজন সুস্থ মানুষকে রুগি বলে চালিয়ে দেওয়ার সহজ প্রতিহিংসা তোমার মধ্যে ছাড়া আর কার মধ্যে থাকবে!

"মুহূর্তের নির্বাপন চাইছি আর দশবার চটজলদি
"গীতা"উচ্চারণ করছি... তুমি শুনছ "ত্যাগ"

অরিজিতের লেখা কবিতার দুছত্র মনে পড়ে যায় সম্মোহের। মনে পড়ে যায় আরও অনেক কিছু। 

মহাদেবের কথায় ব্রক্ষ্মা লজ্জা পেলেন এবং একই সঙ্গে অনলের ন্যায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠলেন। তারপর বললেন, " কাম যেমন আপনার সন্মুখে আমাকে শরাঘাত করল, তার ফল সে পাবে। এই কন্দর্প অহঙ্কারে মত্ত হয়ে অতি দুষ্কর কাজ করতে গিয়ে আপনার নয়নানলে ভষ্মীভূত হবে।"

এই শাপ শুনে ভীত কাম ব্রক্ষ্মাকে বললেন, " আমার কি দোষ প্রভু? আপনিই বলেছিলেন যে, "আপনি, বিষ্ণু এবং মাহেশ্বরও আমার বশবর্তী হবেন। আমি তো তারই পরীক্ষা করছিলাম। আমি নিরপরাধ। আমার শাপ মোচন করুন।"

ব্রক্ষ্মা বললেন," তুমি মহাদেবের নয়নাজলে ভষ্মীভূত হয়ে আবার তারই অনুগ্ৰহে শরীর ফিরে পাবে।"

---- গাঁড় মারানোর কেত্তন!" সম্মোহ অস্ফূটে বলে উঠলো। আজ যেন চিন্তার কোন মাথামুন্ডু নেই।"

একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল। ট্রু-কলারে ভেসে উঠলো, অলিভিয়া দত্ত।

---- "হ্যালো!"

---- "হ্যাঁ হ্যালো, আমি অলিভিয়া দত্ত বলছি ব্যারাকপুর থেকে। আপনার ওখানে আগামী শুক্রবার রুম পাওয়া যাবে?"

---- "হ্যাঁ, পাওয়া যাবে। কটা রুম লাগবে?"

----- "একটাই ডবল বেড। আমি আর আমার মা যাব। সঙ্গে জিল। পেট অ্যালাও তো!"

---- "না না, হবে না।"

-----" জিল খুব ভালো। সহবত জানে। আপনাদের কোন অসুবিধে করবে না। প্লিজ না বলবেন না।"

----" আচ্ছা ঠিক আছে। দায়িত্ব আপনার। কাউকে আবার যেন কামড়ে-টামড়ে না দেয়!"

---- " আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। কোনো অসুবিধা হবে না। আমি কিছু এ্যাডভান্স পাঠিয়ে দিচ্ছি।"

-----" লাগবে না। চলে আসুন। এটা কি আপনার হোয়াটসঅ্যাপ নং?"

-----" হ্যাঁ, এটাই।"

 -----"আমি লোকেশন পাঠিয়ে দিচ্ছি।"

----" ঠিক আছে। অনেক ধন্যবাদ। আর একটা কথা, সঙ্গে ড্রাইভার থাকবে। ওর থাকার একটা ব্যবস্থা করবেন প্লিজ।"

-----" শুনুন রুম চার্জ পনেরো শো। এখানে এসির কোনো ব্যবস্থা নেই। ড্রাইভার রুম পাঁচশো। খাওয়াদাওয়া আলাদা। আপনার জিল বিড়াল কিংবা কুকুর যাইহোক ও যদি আপনাদের সঙ্গে থাকে, সেক্ষেত্রে আমরা চাদর বালিশের ওয়্যার প্রোভাইড করবো না। আপনাদের করে নিয়ে আসতে হবে। কারণ, বড় সমস্যা হয় এদের নিয়ে। দাঁত দিয়ে কেটে ছিঁড়ে দেয়।"

---- না না, আপনি একেবারেই চিন্তা করবেন না। ও খুব জেন্টল!"

-----"সে হোক। তাও ওগুলো সঙ্গে নিয়েই আসবেন। ঠিক আছে। রাখি তাহলে,  ভালো থাকবেন।

সম্মোহ ফোনটা রেখে আকাশের দিকে তাকাল। তাকিয়েই থাকল! যেন চারপাশে একটা ঘোর লেগে আছে। আকাশের তারা গুলোকে কেমন যেন সেলাই করা সারি সারি বিস্ময়চিহ্নের মতো লাগছিল! জীবনের বিস্তারিত আয়োজনে কোথায় যে কী অভিজ্ঞতা বা অনুষঙ্গ সমাহৃত হয়ে থাকে তা আগে থেকে বোঝা যায় না।

মজার ব্যাপার এই, আমাদের আচরণের মূল নিয়ন্ত্রক মস্তিষ্ক। আরো বিশদ ভাবে বলতে হয় মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্র। মানসিক অস্থিরতার গভীরে ডুবে থেকেও কী করে যে নিজেকে সৃজনশীলতার শীর্ষে নিয়ে বসাতেন ভ্যান গখ, সে এক বিস্ময়। এক অস্থির মুহূর্তে নিজের কান কেটে তিনি পাঠিয়ে দেন জনৈকা নগরকন্যাকে। তারপর আত্মপ্রতিকৃতি আঁকেন!

আজ কি এমন হলো সম্মোহের! ঘুরে ফিরে বিভিন্ন ভাবনা আর কথার মিথোস্ত্রিয়া ঘটে চলেছে মনে, মনের গভীরে। সেখানে হয়তো মন কিংবা  মন্তব্য নেই। কেবল একটা অস্থিরতা আছে।কিছুতেই যেন নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। তবে কি এবার একজন মনোবিদের সাহায্য নিতে হবে সম্মোহকে!

ফেসবুকে একটা নটিফিকেশনের শব্দ হলো টিং। সম্মোহ খুলে দেখল অনলাইন কাগজ গুলোর সেই একই ঝালমুড়ির গল্প!

বলিউডের প্রথমসারিতে ইতিমধ্যেই নিজের নাম পাকিয়ে নিয়েছেন বঙ্গতনয়া শ্রেয়া। যার হট মুভসের আভায় মুগ্ধ সাইবারবাসী। এককথায় বলিউড মাতিয়ে রেখেছেন বাঙালি কন্যা। সম্প্রতি পছন্দের ডেস্টিনেশন মলদ্বীপ গিয়ে একগুচ্ছ ছবি শেয়ার করেছেন। ব্রালেট-মিনিস্কার্টে খোলামেলা শরীরে ঝড় তুললেও পোশাকের উপর স্পষ্ট শরীরের হাড়। মৌনির এই সুপারহট ছবি দেখেই কটাক্ষ করেছেন সাইবারবাসী।

বিষয়টা পড়তে পড়তে শ্রেয়ার শেয়ার করা ছবিগুলো দেখতে ইচ্ছে করে সম্মোহের। নারীর এই শরীরী ভঙ্গিমা শিল্পীর চেতনায় কত ধরনের মোটিভ রচনা করে! সম্মোহ হাতের কাছে একটা কাগজে কয়েকটা লাইন ড্রইং- এর আঁকিবুকি কেটে নেয়। তারপর অদ্ভূত ভাবে খানিকটা শান্ত হয়ে যায়। অনেক দিন বাদে আবার ছবির কাছে যেতে ইচ্ছে করে। ছবি আঁকাটাই এক সময় জীবনের প্যাশন ছিল! আজ সবটাই অতীত।

ছবি ঘুমন্ত। অথবা সে নিদমহল। ঘুমন্ত বাক স্বয়ং।তার মধ্যে গা-ঢাকা দিয়ে উপস্থিত এই যে প্রচ্ছন্ন অনাদি রূপটি-- সদাসর্বদা সে অপেক্ষমান গা-ঝাড়া দিয়ে সজীব ও সক্রিয় হয়ে উঠবার জন্য!  তাই চিত্রকলা সান্দ্র অনচ্ছ ছায়াঘন। আমাদের দৃষ্টিপাত তাতে, মাত্র তাতেই, সংলগ্ন হয়ে যায়! 

একজন শিল্পীর ন্যুডস্টাডি করার সময় এই দেখা গুলোই অনপেক্ষ এবং সাপেক্ষ। অর্থাৎ পার্থিবে বিরাজমান দ্রষ্টব্যগুলি হল অনুকার্য, আর অনুকারক হল অনুকৃতির আদর্শে উদ্বুদ্ধ রূপসাদৃশ্যের ন্যায় মেনে সৃষ্ট ভিন্ন ভিন্ন চিত্র-ভাস্কর্য এবং সাহিত্য-কর্ম।

রবীন স্যারের কথাগুলো আজও মনের মধ্যে গেঁথে আছে সম্মোহের। আজকাল ছবি আঁকার ইচ্ছেটা হারিয়ে ফেললেও ভেতরের উজ্জীবনটা রয়ে গেছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তাই তো আজও কয়েকটা আঁচড়েই জীবন্ত হয়ে ওঠে সম্মোহের অনায়াস লাইন ড্রইং।
মাঝেমধ্যে সে সব ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে সম্মোহ। অনেক প্রশংসা পায়। পুরনো বন্ধুরা দু-একজন যারা ফ্রেন্ডলিস্টে আছে, তারা সম্মোহকে আবার ছবি আঁকায় ফিরতে বলে।




Wednesday, August 18, 2021

বিশেষ সংখ্যা~অনিন্দ্য রায়

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||

অনিন্দ্য রায়-এর ট্রিওলেট কবিতা

ত্রিওলে/ ট্রিওলেট হল আট লাইনের এক স্তবকের কবিতা, যার প্রথম লাইনটির চতুর্থ আর সপ্তম লাইনে এবং দ্বিতীয়টির অষ্টম লাইনে পুনরাবৃত্তি ঘটে। অন্ত্যমিল-বিন্যাস ক খ ক ক˚ ক খ ক˚ খ˚ ( ˚ চিহ্ন পুনরাবৃত্তি বোঝাতে ব্যবহৃত)।  

 এর জন্ম মধ্যযুগীয় ফরাসি কবিতায়, ফ্রান্সের উত্তরভাগে পিকার্দি অঞ্চলে।

 বাংলায় এই ফর্মের প্রথম রচয়িতা বীরেন্দ্রচন্দ্র বসু, তিনি এর নাম দিয়েছিলেন তেপাটি।  




স্নানের দিকে জানলা খুলে রাখি 

জল এখনও কলেজ পড়ুয়া তো

কুয়োর পাড়ে চোখেরই গুস্তাকি  

স্নানের দিকে জানলা খুলে রাখি

লেবুগাছের আড়াল থেকে নাকি 

উনিশ-কুড়ি দেখেদেখেই স্নাত    

স্নানের দিকে জানলা খুলে রাখি 

জল এখনও কলেজ পড়ুয়া তো 


   


বিকেল ভাঙছে আজও 

মদে ফ্রস্টেড কাচে 

উদাসীন এস্রাজও   

বিকেল ভাঙছে আজও

যেমন ইচ্ছে সাজো   

মাধুর্য ঠিক আছে  

বিকেল ভাঙছে আজও 

মদে ফ্রস্টেড কাচে 



পিছুডাক

ফিরে যাই 

মুনস্ট্রাক 

পিছুডাক 

উড়ে যাক

স্মৃতি ছাই 

পিছুডাক

ফিরে যাই 




দীঘির পাড়ে কাদের বাড়ি?

রোদের ছাদ ও ছায়ার বেড়া 

পেছনে তার মেঘের সারি

দীঘির পাড়ে কাদের বাড়ি?

আমরা কদিন থাকতে পারি? 

আমরা দুজন শ্মশান-ফেরা 

দীঘির পাড়ে কাদের বাড়ি?

রোদের ছাদ ও ছায়ার বেড়া 



মুখোমুখি সারাদিন বসে আছ চুপ    

আমাদের নীরবতা ছিঁড়ে দেব কাকে?

ক্রমাগত পিন প’ড়ে মাঝখানে স্তূপ  

মুখোমুখি সারাদিন বসে আছ চুপ

কাগজের আঁকিবুকি বোবা অনুরূপ  

ফাঁকা রেস্তোরাঁ জুড়ে কে যেন কু ডাকে 

মুখোমুখি সারাদিন বসে আছ চুপ    

আমাদের নীরবতা ছিঁড়ে দেব কাকে?




শ্রী মহাদেব



শীত ছিল চিৎকৃত

গান একা পিকনিকে   

কেউ কাছে যায়নি তো  

শীত ছিল চিৎকৃত

গান আরও অভিভূত  

যায় মোহনার দিকে 

শীত ছিল চিৎকৃত

গান একা পিকনিকে    



বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি ভোর থেকে

মাথা গোঁজার কিছুটি নেই শুধু ব্যাঙের ছাতা

তলায় ঢুকে পড়ছি সাথে ব্যাঙ্গমিকে ডেকে   

বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি ভোর থেকে

অঝোর জলে আফ্রোডিজিয়াক মিশিয়েছে কে?  

একটি ফোঁটা জিভে ছুঁতেই কাণ্ড ঘটে যা তা   

বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি ভোর থেকে

মাথা গোঁজার কিছুটি নেই শুধু ব্যাঙের ছাতা



আলোরা নাচে আর ছিটিকে পড়ে রাত   

পায়রা উড়ে যায়, কাঁপছে থিয়েটার 

টিকিট না কেটেও এসেছি দৈবাৎ 

আলোরা নাচে আর উল্টে পড়ে রাত 

আমাকে দেখে তুমি মঞ্চে নাড়ো হাত 

জানি না প্রয়োজন আদপে কী এটার 

আলোরা নাচে আর ছিটকে পড়ে রাত   

পায়রা উড়ে যায়, কাঁপছে থিয়েটার



কবুতর নিয়ে লেখা সোজা  

কঠিন সেটাকে মুছে ফেলা  

(হয়তো করতে পারে ওঝা) 

কবুতর নিয়ে লেখা সোজা

আজ তাকে ধরেই হল যা   

বেজে ওঠে ছ’টি ভুভুজেলা  

কবুতর নিয়ে লেখা সোজা

কঠিন সেটাকে মুছে ফেলা 





                                                                                        শ্রী মহাদেব


১০


আমারও পতাকা ছিল কোনও একদিন

গুমোট শহরে মামুলি, অনালোচিত   

ওড়াতাম রোজ বেহায়া, অসমীচীন 

আমারও পতাকা ছিল কোনও একদিন

প্রতিবেশী ছাদে কেউ কি দৃষ্টিহীন 

এসে দাঁড়াত ও সংকোচ খুলে দিত 

আমারও পতাকা ছিল কোনও একদিন

গুমোট শহরে মামুলি, অনালোচিত  


১১


নজরুলগীতি

ছুঁতে পারি না তো 

চোখে-চোখ রীতি      

নজরুলগীতি

নীল শাড়ি স্মৃতি  

স্থির, অভিজাত

নজরুলগীতি

ছুঁতে পারি না তো 


১২


নিজেকে মেল করার মতো সারা দুপুর 

সারা দুপুর, সারা দুপুর মেলানকলি 

মনে কেবল একটি লেখা ঘুরছে দু ফু-র  

নিজেকে মেল করার মতো সারা দুপুর 

উপন্যাসের বিশাল খাটে একলা উপুড়  

পড়ছি শুয়ে শূন্য পাতার গ্রন্থাবলী    

নিজেকে মেল করার মতো সারা দুপুর 

সারা দুপুর, সারা দুপুর মেলানকলি


১৩ 


একটি পানপাতা, ইচ্ছে ছিল শুধু হাত রাখার  

অথচ সে নিজেই ফস্কে উড্ডীন শহরময়   

বোঝে না প্রেম বলে কাকে ও কার নাম বলাৎকার   

একটি পানপাতা, ইচ্ছে ছিল শুধু হাত রাখার 

আমারও একা লাগে, বরোজে ঢুকি তাই নির্বিকার    

অচেনা গাছগুলি শরীর ছুঁয়ে যায়, পুলক হয়     

একটি পানপাতা, ইচ্ছে ছিল শুধু হাত রাখার  

অথচ সে নিজেই ফস্কে উড্ডীন শহরময়    


১৪


হাতের পানীয়ে অশান্তিগুলো একটা পোকার মতো 

ভাসছে, তুমিও খাচ্ছ না, শুধু ধরে আছ ক্যাজুয়েলি 

দেখি কব্জিতে সদ্য বাতিল সম্পর্কের ক্ষত 

হাতের পানীয়ে অশান্তিগুলো একটা পোকার মতো

তোমার গ্লাসে যে আঙুল ডোবাব অতটা অসংযত  

হতে পারছি না প্রথম আলাপে, পোকাটা কীভাবে ফেলি! 

হাতের পানীয়ে অশান্তিগুলো একটা পোকার মতো 

ভাসছে, তুমিও খাচ্ছ না, শুধু ধরে আছ ক্যাজুয়েলি



                                                                                                                শ্রী মহাদেব


Sunday, August 15, 2021

বিশেষ সংখ্যা~আলোক মণ্ডল

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||            

আন্দামানের সেলুলার জেল ও বাঁকুড়ার স্বাধীনতা সংগ্রামী

 আলোক মণ্ডল

 

বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ   ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে ১০০০ মাইল দূরে   "কালাপানি" পার করে আন্দামানে ১৮৫৮ সালে ৪ মার্চ ২০০ জন "সিপাহী বিদ্রোহে" বন্দী সিপাহিকে নিয়ে প্রথমে চাথাম আইল্যান্ড পরে রস আইল্যান্ডে জেলখানা গড়ে তুলতে নৌযাত্রা শুরু করে এবং রস আইলান্ডে বন্দিব্যারাক, ভাইপারে ও চাথামে জেলখানা গড়ে তোলে। ১৮৫৮ সালেই বার্মা ও ভারতের থেকে আসা জেলবন্দির সংখ্যা ১৬১০০ গিয়ে দাঁড়ায়। ফলত ভাইপার আইল্যান্ডের জেলখানায় যেখানে ভাইসরয় লেঃজেনারেল লর্ড মেঁওকে হত্যা করেছিলেন (ওয়াহবি আন্দোলনের জন্য বন্দী) শের আলি এবং তার জন্য তাকে গাছে টাঙিয়ে ফাঁসি দেয় বৃটিশ কর্তৃপক্ষ কিংবা পুরীর রাজা গজপতি বীর কিশোর সিং ( বৃটিশ বিরোধী হওয়ার দোষে দীপান্তরিত) নির্যাতনে মৃত্যু হয়। সেই ভাইপার জেলে বন্দিদের রাখা সম্ভব না হওয়াতে একটা বড় জেলখানার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
ডাঃ আলফ্রেড সোয়াইন লেথব্রীজ ও চার্লস জেমস্ ১৮৯০ এপ্রিল ২৬ সরকারের কাছে রিপোর্ট পেশ করে যে আন্দামানে ৬০০ সেল যুক্ত একটি জেলখানা গড়ে তোলার প্রয়োজন আছে, সেই মাফিক পোর্ট ব্লেয়ারের এবারডিন এলাকায় ৬০০সেল যুক্ত জেলখানা গড়ে তোলার প্রস্তাবও দেয়।  সেই মাফিক চিঠি নং ১২০১ তাং ৩ সেপ্টেম্বর ১৮৯৩. বাস্তবায়নের নির্দেশ জারি হয়।সাব-ইঞ্জিনিয়র ডাব্লিউ  জি ম্যাককুলিন  এস্টিমেট দেন আইরন মেটিরিয়াল ছাড়া খরচ পড়বে ২,৫৯, ৭৬৪ টাকা আর বন্দিলেবার দের জন্য পারিশ্রমিক বাবদ ১,৬২,৬০২ টাকা।

                   কাজ শুরু হোল সেলুলার জেলের, সমুদ্র তল থেকে ৬০ ফুট উঁচুতে তারামাছের আকৃতিতে তিনতলা বিশিষ্ট ৭ টি  ব্লক বা wing প্রতি ব্লক তিন তলার।প্রথম ও দ্বিতীয়  ব্লকে সেলের ( কুঠরির) সংখ্যা ৩৫×৩= ১০৫, তৃতীয় ব্লকে সেল সংখ্যা ৫০×৩=১৫০,চতুর্থ  ব্লকে২৬×৩=৭৮, ৫ম ব্লকে ২৪×৩=৭২,৬ষ্ঠ ব্লকে ২০×৩=৬০ আর ৭ম  ব্লকে ৪২×৩=১২৬টি, সর্বমোট ৬৯৬ টি সেল।এই বিশাল জেল তৈরী করতে ২০ হাজার কিউবিক ফুট  স্টোন চিপস আর ৩০ লাখ ইট লেগেছিল,লেগেছিল ১০ বছর সময় আর ৬০০ শ্রমিক।  প্রতি সেলে ১ জন করে স্বাধীনতা সংগ্রামী বন্দী থাকতেন। সেলের পরিসর ১৩.৫ ফুট লম্বা ৭.৫ ফুট চওড়া। ৯ ফুট উঁচুতে পেছুনের দিকে একটি মাত্র লোহার গ্রুিল দিয়ে আটকানো ঘুলঘুলি। সামনে মোটা লোহার গেট তার লক দু'ফুট দূরে  দেওয়ালের ভেতরে কুলুঙ্গি করে তালা,বন্দির পক্ষে হাতবাড়িয়েও নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। সেলের ভিতরেই বন্দিদের প্রাতঃকৃত্য করতে হোত, পেট খারাপ হলে সারাদিন ঐ টয়লেটের নোংরা নিয়েই থাকতে হোত। সামনে ৪ ফুট চওড়া লম্বা বারান্দা, প্রতি ব্লকে প্রবেশ পথ মোটা লোহার গেট দিয়ে আটকানো।এক সেলের বন্দির সংগে অন্য সেলের বন্দির দেখা হওয়া বা কথা বলার কোন সম্ভবনা ছিল না।প্রতি ব্লকে ২১ জন করে ওয়ার্ডেন্ট ও সশস্ত্র প্রহরী দিনরাত্রি তিন ঘণ্টা করে ডিউটিতে থাকত।প্রতি ব্লকের সামনে একাধিক ঘানী থাকত বন্দিদের নারকেল তেলের ঘানী চালাতে হোত, না করলে অকথ্য অত্যাচার, তার কাহিনি বড়ই নির্মম ও পৈশাচিক।জেল বন্দীদের মাথা পিছু ঘানি টেনে শুকনো নারকেল থেকে ৩০ পাউন্ড নারকেল তেল বার করতে হত। কয়েদীদের মধ্যে কেউ জেলারের প্রতিবাদে উঁচু গলায় কথা বললে তাকে উলঙ্গ করে ফগিং স্ট্যান্ডে উল্টো করে হাত পা বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা হত। তারপর বন্দীর নিতম্বের উপর সাদা এক টুকরো কাপড় রেখে চাবুকের ঘা মারা হত। চাবুকের ঘায়ে নিতম্ব ফেটে রক্ত বের হয়ে আসত। এর ফলে সেই বন্দীর পরিনতি হতো খুব খারাপ,বন্দী ভালো করে মল ত্যাগ করার জন্য বসতে পারতেন না ফাটা চামড়ায় টান পড়তো।

বন্দিকে পাটের তৈরি কাপড় পড়তে দেওয়া হত যাকে "পানিশমেন্ট-ড্রেস" বলা হত। সেই পাটের ড্রেস পরে নিতম্বের ফাটা জায়গায় পাটের কাপড়ের ঘষা লেগে ঘা হয়ে যেত। এরকম শতশত
অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বটুকেশ্বর দত্ত যেমন পাগল হয়ে গিয়েছিলেন তেমনি কত বন্দী অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিলেন। তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে জেল প্রশাসন একবার এক সঙ্গে ৭৮ জন বন্দী কে এক সঙ্গে ফাঁসি দিয়েছিল। কত যে নির্মম অত্যাচারে প্রাণ হারিয়েছিলেন তার হিসেব আর এক নিবন্ধের সূচনা করবে।

বর্তমানে সেলুলার জেলের মাত্র তিনটি ব্লক আছে বাকিগুলি কিছু ভূমিকম্পে এবং বেশীরভাগ ২য় বিশ্ব যুদ্ধের সময় জাপানি বোমার আঘাতে ধূলিস্মাৎ হয়েছে।ভারত সরকার দুটি ব্লক ভেঙে সেখানে ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট "জে বি পন্থ হসপিটাল "গড়ে তুলেছেন পরবর্তীকালে।                                                                                                                                                             
সেলুলার জেলে  অবিভক্ত বাংলা থেকে ১৯১০ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ৩৭০ জন, উত্তর প্রদেশ থেকে ২০ জন, অবিভক্ত পাঞ্জাব থেকে ৮৪ জন,বিহার থেকে ১৮ জন,  দিল্লী থেকে ১ জন, মাদ্রাজ থেকে ৩ জন এবং মহারাষ্ট্র  থেকে ৩ জন স্বাধীনতা সংগ্রামী জেল খেটেছেন

আমাদের জেলা,বাঁকুড়া থেকে মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায় সেলুলার জেলে বন্দি ছিলেন বিষ্ণুপুর ডাক গাড়ি লুঠের অভিযোগের শাস্তি স্বরূপ।সাত বছরের জন্য তাঁর দ্বীপান্তর হয়েছিল। তিনি ১৯৩৭ সালে জেলের অভ্যন্তরে আমরণ অনশনেও যুক্ত ছিলেন।১৯৩৮ সালে জেল মুক্ত হয়ে ১৯৩৯ সালে  ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হন এবং পরে দল ত্যাগ করে মাকর্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং জেলা সম্পাদক হন। কিন্তু সেই পার্টিই তাঁকে  দল থেকে বহিষ্কার করে স্বাধীনতা সংগ্রামীর দের সম্মান জানিয়ে ভারত সরকার যে  "তাম্রপত্র'' দেয় তা গ্রহণের অপরাধে।শেষ জীবন তাঁর চরম দারিদ্র্যে কাটে অবহেলায় ও বিনাচিকিৎসায় মারা যান।


                                1৊ বিমল সরকার     
2৊ সুধাংশু দাশগুপ্ত

বন্দী ছিলেন বাঁকুড়া জেলার মালিয়াড়া গ্রামের প্রভাকর বিরুনি। পিতা শশীভূষণ বিরুনি। জন্ম- ফেব্রয়ারি ১৮৯৮,অসহযোগ আন্দোলনের(১৯৩০) সংগে যুক্ত ছিলেন অনুশীলন সমিতির  অন্যতম এই সদস্যটিকে বে-আইনী অস্ত্র রাখার অভিযোগে ২৮ আগষ্ট ১৯৩৪ সালে বন্দী করে ৫ বছরের জন্য সেলুলার জেলে চালান করে দেয় বৃটিশ সরকার।তিনি জেলখানায় দ্বিতীয় "হাঙ্গার স্ট্রাইক"-এ অংশ নেন জুলাই ১৯৩৭,   মুক্তি পান ১৯৩৯ এ। জেলার কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য, তাঁর পুরুষ্ঠ গোঁফ ওয়ালা ছবি এখনও সেলুলার জেলে দৃশ্যমান। তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৭৬ সালে।

যুগান্তর দলের সদস্য , বিষ্ণুপুর ডাকলুঠের সংগে যুক্ত থাকার অভিযোগে বিমল কুমার সরকারের দীপান্তর হয়। তিনি সেলুলার জেলে বন্দী থাকেন ১৯৩৩ সালে,৫ বছরের জন্য।  তিনিও জেলে দ্বিতীয় "হাঙ্গার স্ট্রাইক"-র সংগে যুক্ত ছিলেন, মুক্তি পান ১৯৩৮ সালে। পরবর্তি সময়ে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন এবং  ১৯৩৬ সালে বাঁকুড়া জেলাপার্টির প্রথম সম্পাদক হন।

বে-আইনী অস্ত্র ও বিস্ফোরক রাখার জন্য বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা  দীননাথ কর্মকারের  ছেলে ভবতোষ কর্মকারকে ব্রিটিশ সরকার  ১৯৩৫ সালে ৪ এপ্রিল মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি করে এবং পরে তাঁকে সেলুলার জেলে স্থানান্তরিত করে। তিনি  সেলুলার জেল থেকে মুক্তি পান ১৯৩৮ এ তারপরেও তাঁকে অন্য জেলেই   থাকতে হয়।

মেছুয়াবাজার বোমা ষড়যন্ত্র মামলায় সুধাংশু দাশগুপ্তের ৯ ডিসেম্বর  ৫ বছরেরর  জেল হয় জেলবন্দি অবস্থায় সেলুলার জেলে বিমল সরকারের সাহচর্যে এসে সুধাংশু দাশগুপ্ত কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত হন এবং জেল থেকে ১৯৩৫ এ মুক্তি পেয়ে বাকি জীবন বিষ্ণুপুরে সংগঠনের কাজে কাটিয়ে দেন,  সে হিসেবে তিনি এই জেলারই মানুষ।

একই ভাবে বিহার থেকে সেলুলার জেলে বন্দী প্রমথনাথ ঘোষও পরবর্তী ১৯৩৭ এর পর মুক্তি লাভ করে কর্মক্ষেত্রে হিসেবে বাঁকুড়া জেলাকেই বেছে নেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির সংগে যুক্ত হন।

আমরা অনেকেই খুব আবেগ প্রবন ও গল্পবাজ তাই গল্পের গরু গাছেও চড়ে! তাই মনীষীদের নিয়ে সহজেই গল্প ছড়িয়ে পড়ে।  এমনই এক গল্প সেলুলার জেলবন্দি বীর সাভারকারকে নিয়ে। বলা হয়, তিনি সেলুলার জেল ভেঙে পাহাড় প্রমান প্রাচীর ডিঙিয়ে ১০০০ মাইল উত্তাল সমুদ্র সাঁতরে পালিয়ে এসেছিলেন ভারতের মূল ভূখন্ডে। এরকম গপ্প কিন্তু ডাহা মিথ্যা তার কোন তথ্যও নেই।আসলে,১৯০৯ সালে ১ জুলাই  মদনলাল ধিংড়া বৃটিশ প্রভু কার্জন ওয়াইলি কে লন্ডনে গুলি করে হত্যা করেন সেই সময় ভিনায়ক দামোদর সাভারকার বোমা তৈরীর মেথড নিয়ে জাহাজের কুক হয়ে লন্ডনে গিয়েছিলেন কিন্তু ধরা পড়ে যান। বৃটিশরা তাঁকে বন্দী করে জাহাজে  ভারতে চালান করার সময় দামোদর ১৩ মার্চ ১৯১০  এ জাহাজ থেকে ঝাঁপ দিয়ে ফ্রান্সের পোর্ট  মারসেল্স বন্দরে পৌছে আত্মগোপন করেন, ফ্রান্স পুলিশ তাঁকে আবার ধরে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেয়।১৯১১ সালে ৯ ফেব্রুয়ারি  কার্জন হত্যায় যুক্ত থাকার  মামলায় এবং নাসিক ষড়যন্ত্র মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে   সেলুলার জেলে বন্দি হন ৫০ বছরের জন্য।বৃটিশ সরকারের অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তিনি জেল মুক্তির জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেন তারপর ১৯২৪ সালে বৃটিশ সরকার তাঁকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তির প্রস্তাব দেয়, ইতিমধ্যে কংগ্রেস দল ভারতের ৭ টি রাজ্যে ক্ষমতায় এসে গেছে,সেটা ১৯৩৭ সাল,বিনায়ক দামোদর সাভারকার ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া  শর্ত মেনে মুচলেখা( বৃটিশ বিরোধী কোন আন্দোলনে থাকবেন না,কোন রাজনৈতিক কাজ-কর্মে যুক্ত  থাকবেন না শুধু সমাজসেবায় যুক্ত থাকবেন এই শর্তে।) দিয়ে সেলুলার জেল থেকে মুক্তি পান।এই হচ্ছে  তথ্য স্বীকৃত ইতিহাস। অথচ সেলুলার জেলের সামনেই যে পার্ক, তা সেটি তাঁর নামেই উৎসর্গীকৃত , পোর্টব্লেয়ার এয়ারপোর্টের নামও"বীর সাভারকার এয়ারপোর্ট"  তাঁর নামেই  অথচ নেতাজীর ১৯৪৩ এ বৃটিশমুক্ত আন্দামানে প্রথম স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন তার  কোন স্বীকৃতি নেই! এমনকি তিন শতাধিক বাঙালী বীর বন্দিদের নামের তালিকা যা এতোদিন সেলুলার জেলের দেওয়ালে মার্বেল পাথরে উৎকীর্ণ ছিল তা প্রতিদিনই কোন এক অদৃশ্য কারনে কমতে থাকছে।যেমন আমরাও ভুলে যাচ্ছি বাঁকুড়ার ঐ সমস্ত বীরদের কথা,  ক'জনই বা জানি তাঁদের সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে!