Wednesday, May 28, 2025

পুরাণ থেকে প্রমাণের পথে : সরস্বতী নদী | সঞ্চারী ভট্টাচার্য

|| ব্ল্যাকহোল পত্রিকা ||সঞ্চারী ভট্টাচার্য 
পুরাণ থেকে প্রমাণের পথে : সরস্বতী নদী
পর্ব:১


মা সরস্বতীর কতগুলি রূপ পাওয়া যায় শাস্ত্রে?

 

শাস্ত্রসমূহে মা সরস্বতীর একাধিক রূপ পাওয়া যায়। এই রূপগুলি ভৌগোলিকআধ্যাত্মিকদার্শনিকতান্ত্রিক ও প্রতীকী ব্যাখ্যার ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে পরিলক্ষিত হয়। সরস্বতী কেবলমাত্র বিদ্যার দেবী ননতিনি জ্ঞানশব্দভাষাবুদ্ধিসঙ্গীতকবিতানদী এবং শক্তির প্রতীকও। তাঁর রূপসমূহ সময়ের সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে এবং ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিফলিত হয়েছে।

 

প্রথমতবেদের মধ্যে সরস্বতীকে একটি নদী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ঋগ্বেদে তিনি একটি বিশেষ পবিত্র নদীরূপে বর্ণিতযিনি সাতটি নদীর মধ্যে প্রধান এবং যাঁর মাধ্যমে প্রাচীন আর্য সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। বেদে এই নদী শুধুমাত্র ভৌগোলিক নয়বরং জ্ঞানের ধারাকে প্রতীকীভাবে বহন করে। এই নদীরূপ সরস্বতীকে বলা হয়েছে 'সরদ্ ধারাবা 'সপ্তস্বতী', যা সাতটি প্রকারের জ্ঞানের প্রবাহ নির্দেশ করে।

 

ঋগ্বেদ ছাড়াও যজুর্বেদসামবেদ ও অথর্ববেদে সরস্বতীকে বাক্‌দেবী তথা ভাষার দেবী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে তিনি পরম ধীশক্তিযিনি ভাষাকে প্রকাশ করতে সাহায্য করেন। বাক্‌দেবীর চারটি রূপ শাস্ত্রে নির্ধারিত: পরাপশ্যন্তীমধ্যমা ও বৈখরী। এই চার স্তরের বাক্‌সমূহ মানুষের অন্তর্লোক থেকে বহির্জগতে ভাষারূপে প্রকাশ পায়। পরা বাক্‌ ব্রহ্মচৈতন্যের সঙ্গে যুক্তপশ্যন্তী হচ্ছে অন্তর উপলব্ধ ধ্বনিমধ্যমা বাক্‌ মানসিক স্তরের ভাষা এবং বৈখরী বাক্‌ শ্রবণযোগ্য ধ্বনি।

 

উপনিষদে সরস্বতী মূলত ব্রহ্মজ্ঞানের মাধ্যমরূপে দেখা দেন। তিনি ব্রহ্মার বাম অংশ থেকে উৎপন্নতাই তাঁকে ব্রহ্মপত্নী বলা হয়েছে। সরস্বতী এখানে জ্ঞানের উৎসশব্দের আধার এবং সচেতনতার প্রকাশ। বামদেবীয় উপনিষদ ও মাণ্ডূক্য উপনিষদে বাক্‌ বা ধ্বনির মাধ্যমে আত্মার উপলব্ধির কথা বলা হয়েছেযেখানে সরস্বতীই এই ধ্বনির রূপে বিরাজমান।

 

পুরাণসমূহে সরস্বতীর রূপ আরও বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে। ব্রহ্মান্ড পুরাণস্কন্দ পুরাণশিব পুরাণদেবী ভাগবত ও পদ্ম পুরাণে সরস্বতী কখনও শান্তশ্রীদায়িনীকখনও রুদ্রাণীকখনও ত্রিদেবীর অন্যতমা মহাশক্তিরূপে উপস্থিত। দেবী ভাগবত পুরাণে তিনি আদ্যাশক্তিতাঁর রূপই ললিতাদুর্গাকালী ও সরস্বতী। শিব পুরাণে তিনি ব্রহ্মার মানসকন্যাআবার কখনও তাঁর পত্নী। কোনো কোনো পুরাণ অনুসারে সরস্বতী রুদ্রের শক্তিরূপে আবির্ভূতাযাঁর দ্বারা সমস্ত শব্দতত্ত্ব ও উচ্চারণ শুদ্ধ হয়। ব্রহ্মার চার মুখ থেকে চার বেদ যেমন নির্গত হয়েছেতেমনি সরস্বতীর মুখ থেকেও জ্ঞানের ঝর্ণাধারা প্রস্ফুটিত হয়েছে। পুরাণে সরস্বতীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ হল শ্বেতবসনা’—যিনি হাতে বীণাপুস্তকজপমালা ধারণ করেন ও রাজহংসে বিরাজমান।

 

তন্ত্রশাস্ত্রে সরস্বতী একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শক্তির রূপ। তিনি এখানে শুধুমাত্র বিদ্যার দেবী ননবরং একটি জীবন্ত মন্ত্রময়ী চেতনা। সরস্বতীর তান্ত্রিক রূপগুলির মধ্যে অন্যতম হল 'বাগ্লামুখীও 'ত্রিপুরাসুন্দরী'-র সহচরী। তন্ত্রে তিনি বীজমন্ত্রের মধ্যেও বাস করেন। যেমন—'ऐं' (ঐং) হল সরস্বতীর বীজমন্ত্রযা জ্ঞানবৃদ্ধিবাগ্‌সিদ্ধি ও অন্তর্দৃষ্টি প্রস্ফুটনের জন্য ব্যবহৃত হয়। তন্ত্রসারে মা সরস্বতী দশ মহাবিদ্যার অংশ নন ঠিকইকিন্তু তন্ত্রচর্চার জন্য অপরিহার্য। অনেক তান্ত্রিক মত অনুসারে তিনিই বীজজ্ঞান ও জপের অন্তর্গত সত্তা।

 

লোকসংস্কৃতি ও গ্রামীণ ধর্মাচরণেও মা সরস্বতীর নানা রূপ পাওয়া যায়। বাংলায় তাঁকে 'বসন্তপঞ্চমীর দেবীহিসেবে পূজা করা হয়যেখানে তাঁর প্রতীক হল খড়ের তৈরি পট বা হংসবাহিনী রূপ। রাজস্থানে তাঁকে 'চারবাহুরূপে দেখা যায়যেখানে তাঁর হাতে থাকেন কলমকিতাবসঙ্গীততন্তু ও মালা। দক্ষিণ ভারতে তিনি 'শারদানামে পরিচিতআর কর্ণাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশে 'সরস্বতী হোমও 'আক্ষরাব্যাহানামক রীতি প্রচলিত আছেযেখানে শিশুদের বিদ্যার সূচনা সরস্বতীকে উৎসর্গ করে হয়।

অনেক স্থানে সরস্বতীকে রুদ্রাণী বা কালী রূপেও কল্পনা করা হয়েছেযেখানে তিনি শুধু শুভ্র ননকখনও রক্তবর্ণাও। কাশ্মীরের একাধিক তান্ত্রিক গ্রন্থে সরস্বতীকে ত্রিনেত্রা ও দশভুজা হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই রূপে তিনি ভাষার স্রষ্ট্রী এবং ধ্বংসকারিণী একত্রে।

 

সংগ্রহ করলে মা সরস্বতীর শাস্ত্রসম্মত রূপগুলি এভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়:

 

১. নদীরূপে – ঋগ্বেদ অনুসারেসাত তীরবাহিত এক পবিত্র নদী।

২. বাক্‌দেবীরূপে – ভাষা ও ধ্বনির প্রতীকচারস্তরীয় বাক্‌তত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত।

৩. জ্ঞানের দেবীরূপে – বেদ ও উপনিষদ অনুযায়ী চৈতন্য-জ্ঞানের আধার।

৪. ব্রহ্মপত্নীরূপে – পুরাণে ব্রহ্মার শক্তিস্বরূপা।

৫. শ্বেতবসনা ও বীণাবাদিনী রূপে – শিক্ষাসঙ্গীত ও শিল্পকলার অধিষ্ঠাত্রী।

৬. তান্ত্রিক রূপে – বীজমন্ত্রের আধারশক্তিরূপিণীত্রিনেত্রা ও দশভুজা।

৭. লোকরূপে ও উপজাতীয় প্রতিমায় – আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের প্রতিফলন।

৮. সিদ্ধিদাত্রী ও বাগ্‌সিদ্ধি দায়িনী – সাধনা ও মন্ত্রচর্চার ক্ষেত্রে অন্যতম।

৯. রুদ্রাণীরূপে – শিবতত্ত্বের সহচরীশব্দতত্ত্বের সংহারিণী রূপে।

১০. ধর্মদর্শন ও সংগীতের রূপে – সমস্ত শাস্ত্রকলা ও বিজ্ঞানরূপী চেতনার উৎস।

 

এইসব রূপ আলাদা আলাদা হলেও তারা এক মূলতত্ত্বের দিকে ইঙ্গিত করেসেই মৌলিক জ্ঞানচেতনাযা ভাষার ভিতর দিয়ে প্রকাশিত হয়সৃষ্টির ভিতর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং সাধনার ভিতর দিয়ে উপলব্ধ হয়। মা সরস্বতী সেই চেতনার বহুমাত্রিক প্রকাশ। তাই তাঁকে গণনা করা যায় না কেবলমাত্র সংখ্যায়কারণ তিনি সংখ্যার অতীতবর্ণের অতীতএবং রূপেরও অতীত। তবুযেহেতু মানুষ রূপের ভেতর দিয়ে চিন্তা করেতাই এই রূপগুলি আমাদের অন্তর্দৃষ্টিকে প্রসারিত করেআত্মিক অনুসন্ধানকে শক্তি জোগায়।


সরস্বতীর কোন রূপটি নদীরূপে চিহ্নিত?

 

মা সরস্বতীর উপাসনা ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান ধারার মধ্যে পড়েতবে আজ যাঁকে আমরা শিক্ষাসংগীতবিদ্যা ও ভাষার দেবী বলে জানিসেই সরস্বতী এক কালে প্রথমত পরিচিত ছিলেন একটি নদী হিসেবে। এই রূপটি সর্বপ্রথম এবং সর্বাধিক গুরুত্বসহকারে পাওয়া যায় ঋগ্বেদে। তাঁর নদীরূপটি শুধু ভৌগোলিক নয়বরং আধ্যাত্মিকসাংস্কৃতিক ও ভাষাতাত্ত্বিক ইতিহাসের অন্যতম মূল আধার। এই রূপটিই হল মা সরস্বতীর প্রাচীনতমমৌলিক ও সর্বাপেক্ষা বিস্তৃত প্রতীক।

 

ঋগ্বেদের প্রায় ৭২টি মন্ত্রে সরস্বতীর নাম উল্লেখিত হয়েছে। এর মধ্যে বহু ক্ষেত্রে তিনি নদী হিসেবে চিহ্নিত। বিশেষ করে ঋগ্বেদ ৬.৬১ সূক্তে সরস্বতীকে একটি জলপ্রবাহঅর্থাৎ নদী বলা হয়েছে – “ইমাম্‌ মে গঙ্গে যমুনে সরস্বতী শুতুদ্রে স্তোমম্‌ সচ্ছতা পরূষ্ণ্য। এখানে গঙ্গাযমুনা ও সরস্বতীকে পাশাপাশি উচ্চারিত করা হয়েছেযা নদীরূপে তাঁকে গঙ্গা ও যমুনার সমপর্যায়ে স্থাপন করে। এছাড়া ঋগ্বেদ ১০.৭৫-তে নদীসূক্ত’ নামে পরিচিত একটি সম্পূর্ণ সূক্ত রয়েছেযেখানে দশটিরও বেশি নদীর নাম রয়েছে এবং সরস্বতীকে সেখানে নদীনাম্‌ শ্রেষ্ঠা বলা হয়েছে।

 

এই নদী শুধুমাত্র একটি জলপ্রবাহ নয়বরং ঋগ্বেদীয় আর্য জীবনের প্রাণরেখা। সরস্বতী নদী প্রাচীন ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রবাহিত হতো বলে মনে করা হয়বিশেষত বর্তমানে হারিয়ানাপাঞ্জাব ও রাজস্থান অঞ্চলজুড়ে। বহু গবেষণা ও উপগ্রহচিত্র পর্যালোচনায় প্রমাণ মিলেছে যে, ‘ঘঘর-হাকড়া’ নামে যে শুকনো নদীর ধারা পাকিস্তান ও ভারতের মরুভূমি অঞ্চলে দৃশ্যমানসেটিই প্রাচীন সরস্বতীর ধারা হতে পারে।

 

ঋগ্বেদের মতেএই নদীর উৎস ছিল হিমালয় থেকে এবং এর জলধারা ছিল অত্যন্ত প্রবাহমানসজীব ও উর্বর। তাঁকে বলা হয়েছে – “সপ্তস্বতী” অর্থাৎ সাতটি ধারা বিশিষ্ট নদী। আবার অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী” – এই শ্রুতিতে তাঁকে বলা হয়েছে স্নেহময়ী মাসর্বশ্রেষ্ঠ নদী এবং দেবীএই তিন রূপে একত্রিত প্রতীক।


এই নদীরূপে সরস্বতী কেবল শারীরিক বা ভৌগোলিক উপস্থিতি নয়বরং প্রাচীন ঋষিরা তাঁর মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন এক ধারাএক জ্ঞানস্রোতযা মানবজীবনে ভাবভাষা ও ধ্যানের রস এনে দেয়। তাঁর নামের অর্থই হল – ‘সরঃ’ অর্থাৎ প্রবাহ ও স্বতী’ অর্থাৎ স্বতঃস্ফূর্ত। সেই অর্থে সরস্বতী মানেই যিনি নিজের থেকে প্রবাহিত হন। এই প্রবাহ শব্দেরবাক্‌শক্তিরজ্ঞানের এবং ধ্যানের।

 

মার্কণ্ডেয় পুরাণবিষ্ণু পুরাণ ও ব্রহ্মান্ড পুরাণেও সরস্বতী নদীর উল্লেখ পাওয়া যায়। বিষ্ণু পুরাণে বলা হয়েছেএই নদী হিমালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে ব্রহ্মাবর্ত অঞ্চলে প্রবাহিত হত এবং পরে রজতপর্বতের মধ্যে আত্মগোপন করে। এই আত্মগোপন করাকে মহাকালগত ব্যাখ্যায় ব্যাখ্যা করা হয়একদা যে জ্ঞানযে ভাষা সমাজকে আলোকিত করতকালের প্রবাহে তা অন্তর্হিত হয়ে পড়ে।

 

মহাভারতের ভীষ্ম পর্বে স্পষ্টভাবে সরস্বতী নদীর অবস্থান ও গুরুত্বের কথা বলা আছে। সেখানে পাণ্ডবরা সরস্বতীর তীরে তপস্যা করেন এবং বহু ঋষি এই নদীতীরকে আশ্রম স্থাপনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন। নদীটি তখনও প্রবাহমান ছিলযদিও কিছু কিছু স্থানে তার জলধারা ক্ষীণ হয়ে পড়েছে বলেই বর্ণনা।

 

জৈন গ্রন্থাবলিতেও সরস্বতী নদী উল্লেখিত হয়েছেযদিও সেখানে তাঁর নদী ও দেবীরূপের সংমিশ্রণ খুব সীমিত।

 

পরবর্তীকালে এই নদীর ধারা হারিয়ে যায় বা ভূগর্ভস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রতীকার্থে সরস্বতী রয়ে যানকখনও গঙ্গার মধ্যেকখনও ত্রিবেণী সঙ্গমে অদৃশ্য তৃতীয় নদী’ হিসেবে। এই ত্রিবেণী সঙ্গমেযেখানে গঙ্গা ও যমুনা মেলেছেসেখানে বলা হয়, ‘সরস্বতী গুহ্যভাবে প্রবাহিত’—অর্থাৎ তিনি আর দৃশ্যমান ননকিন্তু তলে তলে রয়েছেন। এই অন্তর্হিতা সরস্বতী’ হলো আধ্যাত্মিক প্রতীকযে জ্ঞান দৃশ্য নয়কিন্তু উপলব্ধির জন্য অপেক্ষমাণ।

 

তন্ত্রশাস্ত্রেও নদীরূপে সরস্বতীকে চর্চা করা হয়েছে। বিশেষতনদীর প্রবাহ ও বীজমন্ত্রের ধ্বনির মধ্যে এক সাদৃশ্য খুঁজে পেয়ে বলা হয়েছে, 'যে নদী অন্তরে প্রবাহিতসেই সরস্বতীই প্রকৃত তন্ত্রময়ী'। এই তত্ত্ব অনুসারেসরস্বতী নদীই শব্দতত্ত্বের উৎসঅর্থাৎ ধ্বনির যে উৎসতা-ও একধরনের প্রবাহ এবং সেই ধ্বনিই মন্ত্রের রূপে প্রতিষ্ঠিত।


আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানও এই নদীর অস্তিত্বের পক্ষে অনেক প্রমাণ এনেছে। ২০০২ সালে ইসরো ও জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া যে উপগ্রহচিত্র সংগ্রহ করেতাতে স্পষ্টভাবে একটি বৃহৎশুকিয়ে যাওয়া নদীর শুষ্কপথের চিহ্ন ধরা পড়েযা ঘঘর নদীর সঙ্গে মিলে যায়। বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনযেমন হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতার উপকরণকেশেতুবানওয়ালিকালিবঙ্গা প্রভৃতি স্থানেও এই নদীস্রোতের সঙ্গে সংযুক্ত নগরভিত্তিক বসতির প্রমাণ মেলে। এর অর্থসরস্বতী নদী শুধু ধর্মগ্রন্থেই নয়সভ্যতার গঠনতেও প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।

 

তবে এই নদীরূপটি ক্রমশ লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেলেও তার প্রতীকমূল্য কখনও মুছে যায়নি। মা সরস্বতী আজ দেবী হিসেবে পূজিতা হলেওতাঁর নদীরূপে স্মরণ আজও তীর্থক্ষেত্রেমন্ত্রেআশ্রমে ও আধ্যাত্মিক সাধনায় প্রতিফলিত হয়। একদিকে তিনি দৃশ্যজগতের গঙ্গা ও যমুনার মাঝখানে অদৃশ্য’, অন্যদিকে তিনিই অন্তর্দৃষ্টিঅন্তর্জ্ঞান ও মৌনবাক্‌রূপে প্রবাহিত।

 

এইরকমভাবে মা সরস্বতীর নদীরূপটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে জ্ঞান একটি প্রবাহযা স্থির নয়এক স্থানভিত্তিক নয়বরং সে গতিশীলসজীবকখনও প্রকাশমানকখনও অন্তর্হিত। এই প্রবাহ কখনও শোনার মতোকখনও উপলব্ধির মতোকখনও শুধুই অনুভবের মতো।

 

সুতরাংশাস্ত্রে সরস্বতীর যে নদীরূপ চিহ্নিততা কেবল এক ভৌগোলিক স্মৃতি নয়তা ভারতীয় চেতনায় এক মৌলিক ও চিরন্তন স্রোতযা যুগে যুগে প্রকাশ পেয়েছে ভাষাবাক্‌সঙ্গীত ও সাধনার মধ্যে দিয়ে। তিনি যে নদীসেই নদীই আজ বাক্‌দেবীআর সেই বাক্‌ই আবার আমাদের কাছে হয়ে উঠেছে ব্রহ্মতত্ত্বে পৌঁছবার সেতু।


তথ্যসূত্র –

 

১. সরস্বতী নদী: ইতিহাস ও পুরাণ – ড. শিবপ্রসাদ চক্রবর্তী১৯৮৫

২. ভারতের হারানো নদী: সরস্বতী – বিভূতিভূষণ সেনগুপ্ত১৯৯২

৩. সরস্বতী ও বাণীপুরাণ – প্রফুল্ল চন্দ্র দত্ত১৯৭৮

৪. ভারতের জলপথ: সরস্বতী নদীর গৌরব – অমরেন্দ্র কুমার দাস২০০১

৫. পুণ্যসরস্বতী: নদীসংস্কৃতি ও লোককথা – হেমন্ত মুখার্জী১৯৯৯

৬. ভারতের হারিয়ে যাওয়া নদীগুলো – ড. অনিলকুমার রায়২০০৫

৭. সরস্বতী নদীর ভৌগোলিক ইতিহাস – ড. মধুসূদন বসু১৯৯০

৮. বৈদিক ভারতের নদী ও সরস্বতী – স্বর্ণলতা সেন১৯৯৪

৯. সরস্বতী নদী: পুরাণ থেকে বিজ্ঞান – রবি চন্দ্র ঘোষ২০০৩

১০. নদীর দেবী সরস্বতী – কুমুদ রায়১৯৮৮


 

Thursday, May 1, 2025

ষাটের যুবক | অনুরূপা পালচৌধুরী

|| ব্ল্যাকহোল পত্রিকা ||অনুরূপা পালচৌধুরী || ২য় পর্ব



ষাটের যুবক,

আমার শব্দ বরাদ্দ উপবাস আপনার প্রিয় শহরের দেয়াল লিখন। নেশাহীন লাল পতাকার গভীরে ভারী হয়ে আসা কথারা থতমত বাড়ীর খড়কুটো আঙুলে হেঁটে বেড়ায় ১ নাগরিকঘন বিষন্নতা।   মনে পড়ে যায় আপনার এলোমেলো আঙুল বিক্রির ফতোয়া। উচ্চারিত চেতনার ফোঁটা ফোঁটা জলে আমি পাঠাচ্ছি আপনাকে হাঁসের পালকে প্রশস্ত নিউরোণ রঙের ধবধবে দাঁতের হাঁসফাঁস। আমায় স্বেচ্ছামৃত্যুর পরোয়ানা জারি করলেন অথচ আজীবন ভালোবাসার ক্ষতবিক্ষত কলমে আত্মহত্যার বিপ্লব নিভে যাচ্ছে পায়ের পাতার ফলকে। পরিযায়ী ঠিকানা সরিয়ে বুনিয়াদি বিকেল লিখে দিলেন আর মানসী তখন মুন্সি অথবা মুনস্ কিংবা দুহাতে সরব হত্যার গোলামে হৃৎপিণ্ড পুড়িয়ে দিলো সস্তার ভাত-বালিশে।

আমি তো কবি হতে চাইনি যুবক! যুবকত্বের চৌকাঠ পেড়িয়ে শুধু হাতা-খুন্তির টুং-টাঙে না হয় শয়ে শয়ে কবিতার ফসিল হয়েই আপনার অভ্যেসের জল,মাটির বারুদমাখা এঁটো প্রলাপের চড়াই বোনা সকাল সাজতাম। অথচ আপনি তীব্র ভর্ৎসণায় ছুঁড়ে ফেললেন আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। তীব্র নোনা ঢেউয়ে ভিজে যাওয়া আমাকেই আবার বুকে রাখলেন আর আমি খুলে ফেললাম অজস্র শব্দের জমে যাওয়া নীলনদ। আমার ষাটের যুবক! নিদারুণ চোখের সুতোয় অবসরমাখা দুপুরগুলিতে পায়ে পায়ে পালটে যায় তর্জনী থেকে মধ্যমা। তখন উৎসবের আলোতে গলে যায় উল্লাসের মেঘসম্ভাব্য ক্ষয়মুখ। কথার পাশে শুয়ে থাকা ডানার স্তাবক প্রজাপতি কিংবা ব্রহ্মা কোনোটাই নয়।

শুধু যাকিছু ব্যক্তিগত উপান্ত যুবক
নির্বাসিত কোনো ১নদী ভাবো 
ছায়া হয়ে ছিঁড়েছো আলোর নুপুর 
এসো হে গভীর কলমের ক্রীতদাস
তবু আমি ১ সহজ কোলাজ______


                                    ইতি
                     জন্মান্ধ কুয়াশার পুনর্জন্ম



রাণাঘাট
১৮/৪/২০২৫


Wednesday, April 23, 2025

II ষাটের যুবক II অনুরূপা পালচৌধুরী

|| ব্ল্যাকহোল পত্রিকা || অনুরূপা পালচৌধুরী: প্রথম পর্ব



ষাটের যুবক,

ভেবেছিলাম আর কোনো চিঠিবৃত্তই আপনার পাঠক্রম ঘেমে মায়াবী হাত হবে না। যারা বলেছিলো, আজীবন ভালোবাসার অর্থনৈতিক মন্দার কথা সেখানে যুবকত্বের অমরত্ব প্রতিষ্ঠায় জোনাকি রঙের নির্জন ক্ষেত্রফল উঠছে আকাশ জুড়ে। ভুলে যাওয়া ১ উপবাসী অপরাধ যে অপরাধে ভালো আছির ঠিকানায় যানজট লেগে যায় ক্রমাগত। অবসাদের ঘড়ি বেয়ে দু-একটা চোখের দাগ আপনার প্রিয় দিন। বিজয়গড়ের উল্লাসিত পতাকার পদার্পন ঘেটে আজো উড়ে যাচ্ছে কোনো ১দেহাতি সন্ধ্যা জমানো জীবনদানি থেকে উঠে আসা না বলা যাবতীয় উপকূলের বকেয়া ডালপালা। আমি তো জানি কেমন থাকার প্রশ্নউত্তর! একাকীত্বের আল্পনায় আস্ত বৃক্ষস্রোত, যার জানলায় নৌকা চিহ্নের যুবকবন্যা বাঁধা থাকে।

আমার ষাটের যুবক, আজকাল অনেকটা সূর্য ভেজা পিরামিড মনে হয় আপনাকে। আজো নীল ছবির জিহবা কুড়িয়ে নিচ্ছেন ঝিনুকের আঁচর অথচ আঙুলে ১খন্ড কুয়াশার ক্ষয়। জানি, চিঠি ভেবে ভুল করবেন না তবু বলি, বেশ আলো অন্ত অগছালো মানসী বিভাগের বীজমন্ত্রে আগুনশোক দাহো হলো। ঘরভর্তি বয়সের চিলেকোঠায় চড়াই পোষা কাব্যজল।  আপনি সমারোহে ঘর ঘর গন্ধটা তীব্র হচ্ছে। ইঁট বালির ফাঁক ফোঁকরে লেগে যাচ্ছে মায়াহীন এক জ্বর। অবিকল আয়নার বিপরীতে ঠোঁট, চোখ, মুখ, জিভের গন্ধগুলো আর আলাদা করা যাচ্ছে না। বহুদিনপর দেখলাম আমার সেই ব্যাথার গন্ধরা আজো স্বচ্ছ কীটের মতোই উদ্যোগী। জানেন তো, অসমাপ্ত দেওয়ালের ওপারে যে দেওয়াল বোনা হয় তাতে বসন্তের ছায়া লুকিয়ে যায়। 

পুনশ্চঃ কোনো বেহালাদীপ্ত আগুনের অন্ধকারে সহস্র সংখ্যার এপাড় থেকে কোনো উত্তম পুরুষ কখনো শতাব্দীর সিংহাসনের দাবীদার হতে পারেনি।
 
                               ইতি 

              জন্মান্ধ কুয়াশার পুনর্জন্ম


রাণাঘাট
২১/০৩/২০২৫


Sunday, March 30, 2025

কবিতার ডালপালা

|| ব্ল্যাকহোল পত্রিকা || অরিজিৎ চক্রবর্তী

কবিতার ডালপালা
অষ্টম পর্ব                                                                                         

নিলস বোর বলতেন, অপোজিট টু এ গ্রেট ট্রুথ ইজ অলসো আ ট্রুথ৷ প্রতিটি মহাসত্যের বিপরীতেও একটি সত্য আছে৷ বিজ্ঞানজগতে এই সত্যাসত্যের সংঘাত মানুষের কাছে চিরন্তন আকর্ষণের বিষয়৷ তারই মধ্যে উঁকি মারে সেই অমোঘ প্রশ্ন- সবকিছুর ভিড়ে মানুষের ভূমিকা কী? মানুষী যে সাফল্যকে মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মনে হয়েছিল, ‘দি মোস্ট ইনকমপ্রিহেনসিবল থিং ইন দিস ইউনিভার্স ইজ দ্যাট ইট ইজ কমপ্রিহেনসিবল৷’ একদিকে বিশ্ব-চরাচরের রহস্যময়তা, অন্য দিকে সেই প্রহেলিকা সমাধানে মানুষের এই নিত্য সাধনাই আমাদের সপ্রাণ, চলমান, আনন্দঘর ! বাহ্যিক অনেক বদলের পরও, মনের মধ্যে সেই একই ধারা বয়ে চলে, জীবনের সেই অখন্ডতা অব্যাহত রাখতে পারাই হয়তো একজন স্রষ্টার কাছে, পৃথিবীর সব ছেঁড়া তার থেকে বেরিয়ে আসা মনোলীন সিম্ফনি। কবি অমৃতা ভট্টাচার্যের "নগ্ন, আনন্দঘর" পড়তে পড়তে আমার এমনটাই মনে হয়েছে বারংবার। কিন্তু কেন? মনে হয়েছে বললাম কেন? বিশ্বাস হয়েছে বলাটা কি সঙ্গত ছিল না? না। ছিল না। কারণ, কবিতায় সঙ্গত বিশ্বাস বলে কিছু হয় না। যেকোনো শিল্প মাধ্যমেই নির্মাণের ভিন্নতা, মূলত চেতনারই পরিবর্তন। চেতনা বদলেই পালটে যায়, দেখার জগৎ ও প্রকাশভঙ্গী । তাবৎ বিশ্বে সব কিছুই কবিতার বিষয় বস্তু হতে পারে । এই দৃষ্টিভঙ্গিকে কেন্দ্র করে বাস্তব ও অবাস্তবতার আলো আঁধারির চেয়ে ঘটার সম্ভাবনার মধ্যেই বাস্তবতার দেখতে চাইছেন । ফলে ভাষাবদলের কবিতা নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা বাড়ছে । 

" হোক থির, টলটল হোক, জরায়ু ঘোর ঘোর

   দ্যাখো নাভির নীচে জোড়া জোড়া জোড়া

   সব দেওয়া আর ফেরত

   চাঁদ... ঈগল...ডানা দ্বীপ ডানা..."  ( প্রতি অঙ্গ মোর )

কবিতার চলনে অতীত বর্তমান মিশে এক অদ্ভুত আত্মনিরীক্ষা। ভাষা ও চিত্রকল্পের অবয়বে যেন যাবতীয় নির্বাণ ও নৈকট্য। অনুভূমিক কান্ডের মতো নানা চিত্ররূপ থেকে একটার পর একটা অনুযোগ গড়ে তোলে যে জাদুবাস্তবতা তা অনির্ণেয় অথচ আকাঙ্খিত। তাই " ঘোর ঘোর" আর " জোড়া জোড়া" এই শব্দদুটির দ্বিমাত্রিক ব্যবহারে বহুমাত্রিক সম্ভাবনার আভাস দিতে দিতে কবি মনে করিয়ে দিচ্ছেন কুণ্ডলিনী জাগরণের অমোঘ লক্ষণ হল নাদের স্ফূরণ। নাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে বিন্দু ও কলাতত্ত্ব। জগতের সৃষ্টি প্রণালীর বিবরণ প্রসঙ্গে সারদাতিলকে লেখা আছে---

"সচ্চিদানন্দবিভবাৎ সকলাৎ পরমেশ্বরাৎ।

আসীৎ শক্তিস্ততো নাদস্ততো বিন্দুসম্ভুদ্ভবঃ।।"

এই বিবরণ থেকে আদি সৃষ্টির যে ক্রম পাওয়া যায়, তা থেকে জানা যায় যে, সৃষ্টির আদিতে স-কল পরমেশ্বর থেকেই সৃষ্টির বিকাশ ঘটেছে।'স--কল' বলতে 'কলাসহিত'--- এটাই বুঝতে হবে। আবার 'কলা'শব্দের অর্থ শক্তি। এই স--কল পরমেশ্বর থেকে অবতরণক্রমে শক্তিতত্ত্বের বিকাশ হয়ে থাকে। কবি কি তেমনই কোনো বিকাশের প্রত্যাশী ? তাই "সব দেওয়া আর ফেরত" এর প্রতি তাঁর নির্বাণগামী সোপানের ধারা ! কিংবা হয়তো সংযুক্তি (Conjunction ) ও বিযুক্তির ( distinction ) নিরিখে কবিকল্পনার ঊর্ধ্বায়ন। 

"প্রতি এক নতুন দিন অভিপ্রেত শব।

বৃদ্ধ দু-হাত ধীরে ধীরে

ডানা হয়। হয়ে ওঠা কুঁজময়; স্মার্তভার---

যেমন 'হয়' বহুজ প্রজাপতি, তক্ষক আর প্রবাদ;---" 

( প্রতি অঙ্গ )

শব্দের হ্যালুসিনেশন কিভাবে কবিতার প্রাচুর্যকে অবারিত করে তোলে, তারই সেমিওলজি অর্থাৎ সংকেতবিজ্ঞানে; যার "স্মার্তভার" অর্থাৎ স্মৃতির অনুসারী সংকেতের বাহ্যিক রূপ ও অন্তর্নিহিত অর্থের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন একের পর এক সংকেত-বিম্ব ! বিশেষ করে ভাষাবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একটি সংকেত দুইটি অংশ নিয়ে গঠিত – বাহ্যিক রূপ বা দ্যোতক (signifier) ও অন্তর্নিহিত অর্থ বা দ্যোতিত (signified)। যেমন ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দ্যোতক হল কোন ধ্বনিসমষ্টি বা চিত্র, যেমন “মহানির্বাণতন্ত্র” একটি ধ্বনিত শব্দ বা লিখিত শব্দ। অন্যদিকে দ্যোতিত হল তন্ত্রের ধারণা, এই দুইটি উপাদান একত্রে মিলে কবি জানিয়ে দিলেন আমাদের দ্বিজত্বপ্রাপ্তির অভিপ্রেত অপেক্ষা। যেখানে একজন পাঠক হিসেবে আমিও তাকিয়ে থাকি আরো বহু অপেক্ষার উৎসে। তখন মনে হয় হৃদয়সংবাদী এসব কবিতা যেন একটি ভ্রমণ।বহুজ প্রজাপতি, তক্ষক ও প্রবাদ কবিতার বয়ানে যেমন ধরা রইল, বহু পাঠপ্রসঙ্গ ঘোষণাহীন প্রখরতায় তেমনি সহৃদয় সামাজিক। আর গড়ে উঠেছে এক বহুস্বরিক আনন্দ। স্বপ্ন কল্পবাস্তব এখানে স্থান পরিবর্তনে অনলস উৎসাহী। কী বলছে নয়, বরং কীভাবে কথনটি পরিবেশিত—সেই বুনন এই কবিতায় তুমুল।

কবিতায় ধ্বনি রচনার দুটি প্রধান বৈপরীত্য আলো-অন্ধকার, স্থিরতা-অস্থিরতা স্বরের ধ্বনিপদার্থিক বৈশিষ্ট্যে আভাসিত। তাই ধ্বনিসচেতন প্রাবল্য অমৃতার কবিতায় অদ্ভুত ভাবেই অনুনাদের চিত্ররূপ। এখানে সচেতন ভাবে বলতে ইচ্ছে করলো না। কারণ, কবিতার আলোর মধ্যে যে শব্দের উত্তোরণ ঘটেছে সেটা আত্মার আলো, বুদ্ধির যবনিকা ভেদ করে সেই আলো আমাদের দেখা ও ভাবার মধ্যে একটা প্রতিসরণ ঘটিয়ে দিয়েছে ক্রমাগত। কিন্তু কিভাবে? আরও একটি কবিতা পড়ে নেওয়া যাক---

" আলোয় দেখেছি কোণ ঠেসে রাখা সিলমোহর

আর যত কিছু বৈধ তলব, সাবধানি

গিঁট বেঁধে রাখা অস্ত-রঙের আবডালে

দারুণ সেজেছ। যত্নে এবার পথভুলে

স্বেদ জমে জমে পুণ্যের লোভে ধূপদানি,

ভালো লাগে দাগ, জাপটিয়ে ধরে চারপ্রহর---"

( আনন্দঘর )





প্রথমত বলে রাখি, কবিতাটি এখানে শেষ নয়। আবার শুরুও নয়। আসলে সমগ্ৰ কাব্যগ্ৰন্থ জুড়ে যেন ভাস্কর্যের চেতনায় এক নর্তকী। মহেঞ্জোদারোর রঙ্গশালায় তাকে দেখা গেছে। অথবা ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে মন্দিরে। মনে পড়ে যায় রামগড়ের গুহালিপিতে দেবদাসী সুতনুকার উদ্দেশ্যে দেবদীন্ন যে ভালোবাসাটুকু খোদাই করেছিল, সেই কাহিনীর অভিমুখ যেন এই কবিতাটি। দেবদীন্ন সুতনুকার সঙ্গে চিরকালের জন্য মিলিত হতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। পারেনি এই কারণেই যে, সুতনুকা নিশ্চয়ই নৃত্যের কারণে দেবতার কাছে আত্মপ্রদও ছিল। তাই বৈধ তলবের চারপ্রহরে কবিতার চিত্রকল্প জুড়ে আমরা দেখতে পাই নারীর সংরাগ, চমকানো মেঘ, করুণ সুখের কুঠুরি! 

বহু লুকনো মিথের পরতে পরতে এক প্রিয়দর্শিনীর কথাই হয়তো কবি বলতে চেয়েছেন অবদমনের কলঙ্ক ও কোকনদে। কবির কথায় "ইচ্ছেধারী ছোটে" আর "ইচ্ছেধারী দ্যাখে" সৃষ্টির ঈশ্বরস্রোত... । আসলে অমৃতা দেখিয়ে দিয়েছেন, কিভাবে আপাত সারল্যের মধ্যে ক্রমশ জটিলতর রূপ নেয়; যা কিছু অগভীর তা ক্রমবর্ধমান গভীরতার জন্যে স্থান করে দেয়, বিশ্বলীলার মধ্যে অপরা-প্রকৃতি ক্রমে পরা-প্রকৃতির প্রকাশের জন্য পথ ছেড়ে দেয়... এই সমস্ত কিছুর ঋজু ও প্রত্যক্ষ রীতির ছন্দবিজ্ঞান। যেমনটি " জন্ম" কবিতায় পাই----

" অজান্তে গিলেছ শব্দ, রতিকাঁটা আর অন্তে মিল।

উজ্জ্বল পলায়ন যার,মজুত রেখেছে দিন

ফুটিফাটা কত হেঁটে যাওয়া। রাত তবু

জানলা নেশায় পাশ ফেরে তার, ভাবে,

                           উদবৃত্ত আলোর মুখে যতটা

বেঁচেছে ঋণ, অন্ধকার চোখে--

তারও রোপণ বাজে, উদাস সে ফেলে যাওয়া দিকচিহ্নময়

কোঁচড়ে কুড়ানো থাক,দশ মাস,নয় দিন, পরাজিত ভয়!"

"পরাজিত ভয়" আনন্দেই কি আমাদের এগিয়ে যাওয়া? আমাদের পিছিয়ে আসা? জীবনের বীজতলায় দাঁড়িয়ে যেন অনন্ত জাগে।নারীদেহে থাকে রাধাবিন্দু এবং পুরুষদেহে কৃষ্ণবিন্দু।দুটি বিন্দুই আধা অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ নয়। কেননা, বাউলদের একাংশ মনে করে কৃষ্ণবিন্দু থেকে রাধাবিন্দুর সৃষ্টি। অর্থাৎ পূর্ণ কৃষ্ণবিন্দু থেকে খ–ত হয়ে রাধাবিন্দুর সৃষ্টি হওয়ায় তা খ–ত। অর্থাৎ অর্ধ। … বিন্দু সাধনায় এই দুই অর্ধবিন্দু নির্দিষ্ট যোগ ও নিয়ম মেনে মিলিত হলে পুনঃ পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। পুনঃ পূর্ণতাপ্রাপ্ত এই রাধাবিন্দু-কৃষ্ণবিন্দুর মিলনে সাধক/ সাধিকা সূক্ষ্মতম মহানন্দের অনুভবে নির্ভার হয়, যা বাউল-সাধনার লক্ষ্য।বিচিত্র সাধনায় এ-দুটিকে মিলিয়ে যার সন্ধান পাওয়া যায় বাউলের ভাষায় সেই হচ্ছে মনের মানুষ, অচিন পাখি, আলেক সাঁই ইত্যাদি ইত্যাদি। একে পেলে মহাসুখ, মহানন্দ লাভ করা যায়। কিন্তু দুই অর্ধবিন্দুকে পূর্ণতায় পরিণত করা কঠিনসাধ্য, আর্জান শাহ তাঁর একটি গানে যাকে কালার সঙ্গে বোবার মিলন বলেছেন। আমার কালা আর বোবার মিলনে খুঁজে পাই বেঁচে আনন্দ। সৃষ্টির ষড়ঙ্গ। আমাদের আত্মিক অভিব্যক্তি, যার শিকড়টি বসানো রয়েছে দৈহিক জীবনের মাটিতে। মানুষের মুক্ত অসীম আর মুখরিত সসীমের আশ্রয় নীড় এই কবিতাগুলির খন্ড খন্ড আনন্দভৈরব...

Friday, October 28, 2022

C/O সুবোধ সরকার | সুবোধ সরকার-এর কবিতা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||  সুবোধ সরকার-এর কবিতা



রামবাবু 

আগে আপনাকে ভালো লাগত, রামবাবু
এখন আপনি বদলে গেছেন।
কখনও কখনও আপনাকে কংগ্রেস মনে হত
কখনও সি.পি.এম
কখনও সি.পি.আই
মার্কিন সেনেটে আপনার নাম উঠেছিল
কিন্তু ভিয়েতনামের পক্ষে
আপনি বালিদ্বীপ পর্যন্ত ছুটে গেছেন।

বিহারের লছমনপুরে আপনাকে প্রথম দেখি
ততদিনে আপনার স্ত্রী আপনাকে ছেড়ে গেছেন
বিহারের গ্রাম
আপনি তো ভালোই জানেন, খুব সুবিধের জায়গা নয়
ওখানকার লোকেরা বলে
পাতাল প্রবেশ হল স্রেফ ধাপ্পা
আপনি নাকি
উত্তরপ্রদেশের গ্রামে একটা কুয়োর ভেতর
বউকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলেন।
এখনও সেই কুয়োর ভেতর বসে
মা সীতা কাঁদেন,
তখন গোটা বিহারের মেয়েরা
উত্তরপ্রদেশের মেয়েরা
রান্না করতে করতে কাঁদে
আর চোখ মছে।

আগে আপনাকে ভালো লাগত, রামবাবু
কত রাত্রে আমি না খেয়ে
মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছি
শুধু আপনার তীর ধনুকের গল্প শুনতে শুনতে।
ছোটবেলায় আপনার ভাইকেও আমার খুব ভালো লাগত
কী সুন্দর ভাই
এক ডাকে সাড়া দেয়
যে কোনও দরকারে দাদা বললে
ভাই একপায়ে খাড়া।
পরে বড় হয়ে দেখলাম
আপনার ভাই বীর হতে পারে তবে বড্ড মেনিমুখো
দাদার সমস্ত অর্ডার
সাপ্লাই দেওয়াতেই তার সুকৃতি।
আমি যদি আপনার ভাই হতাম
ও.বি.সি-দের মেরে ফেলার আগে বলতাম
দাদা, এ কাজ করিস না,
লঙ্কা পোড়ানোর আগে আমি বলতাম
ঠিক হচ্ছে না, দাদা, ফিরে চল।

আপনি এবং আপনার হনুমান
শুধু ভারতবর্ষে নয়
গোটা উপমহাদেশে হয়ে উঠলেন সোশ্যালিজম
মার্কস এঙ্গেলস এলেন
মাও-সে-তুং হো-চি-মিন এলেন
এল শিল্পায়ন পোখরান
কিন্তু আপনি এবং হনুমান এখনও পর্যন্ত
উত্তম-সুচিত্রার চেয়েও জনপ্রিয় জুটি।
কোভালাম বিচ থেকে বনগাঁর সেলুনে
আপনাদের জোড়া ক্যালেন্ডার।

আগে আপনাকে ভাল লাগত, রামবাবু
ত্রিপুরায় উপজাতিরা ঢুকে পড়ল
আপনি হনুমানকে দিয়ে খাদ্য পাঠালেন
মরিচঝাঁপি তৈরি হল
আপনি পানীয় জলের ব্যবস্থা করলেন
বাংলাদেশ থেকে পিল পিল করে পিপীলিকারা
চলে এল শিয়ালদায়
আপনি আপনার বৈমাত্রেয় বোন
ইন্দিরার পাশে দাঁড়ালেন, জলপাইগুড়িতে দাঁড়ালেন
অন্ধ্রে গিয়ে দাঁড়ালেন।

তখনও আপনি দাঁড়াতেন
আপনাকে নিয়ে লেখা
তুলসীদাসের রামচরিতমানস
আপনিও শুনতেন তখন
আপনার চোখেও বাষ্প ঘনিয়ে আসত।

কিন্তু এখন আপনি আর
আপনি নেই, আপনি
আদবানীকে ভুজুং দিচ্ছেন
জয়ললিতাকে ফুচুং।
পাকিস্তান নামে সবচেয়ে বড় বিষফোঁড়াটাকে বলছেন ফুসকুড়ি?
আমি বলব আপনিই নষ্টের গোড়া
বাল্মীকি আপনাকে যতই নরশ্রেষ্ঠ বলুক
নির্মল জলের মত বলুক
আমার সন্দেহ আছে
ওরা যখন অযোধ্যায় গেল
আপনার বাধা দেওয়া উচিৎ ছিল।
বম্বে থেকে বাঙালিকে ধরে ধরে
ফেরত পাঠাল মহারাষ্ট্র
তাহলে উড়িষ্যা থেকে মালয়ালিদের
ফেরত পাঠাক কলিঙ্গরাজ।
কর্ণাটক থেকে তামিলদের
পাঞ্জাব থেকে মারাঠিদের।
সারা দেশ জুড়ে লেগে যাক ফেরত আর ফেরত
এই ফেরত দেওয়ার মারি ও মড়ক
আপনি সামলাতে পারবেন, রামবাবু?

বনে থাকার দিনগুলো ভুলে যাবেন না
আপনার বাবার ভুলের জন্য
মনে মনে আপনি বাবাকে ক্ষমা করেননি কোনও দিন
আমি জানি
জঙ্গলে থাকতে আপনার ভালো লাগত না
সেই খারাপ দিনগুলো আপনি মনে করুন
তারও চেয়ে খারাপ দিন
আমাদের সামনে, আপনার হাত কাঁপছে না, ভয় করছে না
আপনার নামে ভারতবর্ষে
হাজার হাজার বালকের নাম
তারা বড়বাজারে, মেটিয়াবুরুজে, চাঁদনিচকের
দোকানে দোকানে কাজ করে
দিনান্তে বাড়িতে আটা কিনে নিয়ে যায়
ধোঁয়াভর্তি উনুনে বসে
তাদের মা রুটি ভেজে দেয়।

সারা ভারতবর্ষ জুড়ে
সন্ধে সাড়ে আটটায় কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে
যে বালকেরা এখন
দুটো রুটি নিয়ে বসেছে খাবে বলে
তাদের কে রাম কে রহিম
সেটা আপনার দেখার কথা ছিল না

বাল্মীকির সাথে দেখা হলে বলবেন
রামায়ণের পরবর্তী সংস্করণের আগে
অর্থাৎ প্রেসে পাঠাবার আগে
উনি যেন নতুন করে আর একবার লিখে দেন ।


রূপম 

রূপমকে একটা চাকরি দিন—এম. এ পাস, বাবা নেই
আছে প্রেমিকা সে আর দু’-এক মাস দেখবে, তারপর
নদীর এপার থেকে নদীর ওপারে গিয়ে বলবে, রূপম
আজ চলি
তোমাকে মনে থাকবে চিরদিন
রূপমকে একটা চাকরি দিন, যে কোন কাজ
পিওনের কাজ হলেও চলবে |

তমালবাবু ফোন তুললেন, ফোনের অন্য প্রান্তে
যারা কথা বলেন
তাদের যেহেতু দেখা যায় না, সুতরাং তারা দুর্জ্ঞেয় |
তমালবাবু মামাকে বললেন কূপমের একটা চাকরি দরকার
মামা বললেন কাকাকে, কাকা বললেন জ্যাঠাকে,
জ্যাঠা বললেন
বাতাসকে |
মানুষ জানলে একরকম, কিন্তু বাতাস জানলে
প্রথমেই ছুটে যাবে দক্ষিণে, সে বলবে দক্ষিণের অরণ্যকে
অরণ্য বলবে আগুনকে, আগুন গেল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে
আলিমুদ্দিন ছুটল নদীকে বলার জন্য
নদী এসে আছড়ে পড়ল
উপকূলে, আসমুদ্র হিমাচল বলে উঠল
রূপমকে একটা চাকরি দাও, এম. এ. পাশ করে বসে আছে ছেলেটা |

কয়েক মাস বাদের ঘটনা, আমি বাড়িফিরছিলাম সন্ধেবেলায়
গলির মোড়ে সাত-আটজনের জটলা দেখে থমকে দাঁড়ালাম
জল থেকে সদ্য তুলে আনা রূপমের ডেডবডি
সারা গায়ে ঘাস, খরকুটো, হাতের মুঠোয়
ধরে থাকা একটা এক টাকার কয়েন |
পাবলিক বুথ থেকে কাউকে ফোন করতে চেয়েছিল, রূপম?
ভারত সরকারের এক টাকা কয়েনের দিকে আমার চোখ |

সারা গায়ে সবুজ ঘাস, ঘাস নয়, অক্ষর
এম. এ. পাস করতে একটা ছেলেকে যত অক্ষর পড়তে হয়
সেই সমস্ত ব্যর্থ অক্ষর ওর গায়ে লেগে আছে |

একটা ছেলেকে কেন আপনারা এম. এ. পড়ান, কোন আহ্লাদে আটখানা
বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়েছেন? তুলে দিন
এই কথাগুলো বলব বলে ফোন তুললাম পবিত্র সরকারের
ফোন বেজে উঠল, ফোন বেজে চলল, ফোন বেজেই চলল
২০ বছর ধরে ওই ফোন বেজে চলেছে, আরো কুড়ি বছর বাজবে |

বাতাস বলছে অরণ্যকে, অরণ্য চলেছে নদীর দিকে
নদী উপকূল থেকে আছড়ে পড়ে বলল :
রূপমকে একটা চাকরি দিন |
কে রূপম?
রূপম আচার্য, বয়স ২৬, এম. এ. পাস
বাঁ দিকের গালে একটা কাটা দাগ আছে |



শাড়ি 

বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরো ছটা
এতো শাড়ি একসঙ্গে সে জীবনে দেখেনি।

আলমারির প্রথম থাকে সে রাখলো সব নীল শাড়িদের
হালকা নীল একটা কে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই আমার আকাশ
দ্বিতীয় থাকে রাখল সব গোলাপীদের
একটা গোলাপীকে জড়িয়ে সে বলল, ‘ তোর নাম অভিমান’
তৃতীয় থাকে তিনটি ময়ূর, যেন তিন দিক থেকে ছুটে আসা সুখ
তেজপাতা রং যে শাড়িটার, তার নাম দিল বিষাদ ।
সারা বছর সে শুধু শাড়ি উপহার পেল
এত শাড়ি সে কি করে এক জীবনে পরবে  ?

কিন্তু বছর যেতে না যেতেই ঘটে গেল সেই ঘটনাটা
সন্ধের মুখে মেয়েটি বেরিয়েছিল স্বামীর সঙ্গে, চাইনিজ খেতে ।
কাপড়ে মুখ বাঁধা তিনটি ছেলে এসে দাঁড়ালো
স্বামীর তলপেটে ঢুকে গেল বারো ইঞ্চি
ওপর থেকে নীচে। নীচে নেমে ডান দিকে ।
যাকে বলে এল ।
পড়ে রইলো খাবার, চিলি ফিস থেকে তখনও ধোঁয়া উড়ছে ।
-এর নাম রাজনীতি, -বলেছিল পাড়ার লোকেরা ।

বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরো ছটা
একদিন দুপুরে শাশুড়ি ঘুমিয়ে, সমস্ত শাড়ি বের করে
ছতলার বারান্দা থেকে উড়িয়ে দিল নীচের পৃথিবীতে ।
শাশুড়ি পড়িয়ে দিয়েছেন তাকে সাদা থান
উনিশ বছরের একটা মেয়ে সে একা ।

কিন্তু সেই থানও এক ঝটকায় খুলে নিল তিনজন, পাড়ার মোড়ে
একটি সদ্য নগ্ন বিধবা মেয়ে দৌড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে, ‘বাঁচাও’
পেছনে তিনজন, সে কি উল্লাস, নির্বাক পাড়ার লোকেরা ।

বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরো ছটা….





বিটগাজর যখন রগে উঠে যায় 

ভারত মহাসাগরের তীরে আমি ইয়ার্কি মারতে আসি নি
আহা মেঘ, ওহো মেঘ কী যে মেঘ |
আমি ন্যাকামি করতে আসিনি
আমি কয়েকটা ঝাড়া হাত-পা সত্যি বলতে চাই |

দাদা, সত্যি সবাই বলে, চেপে যান
চেপে যাওয়ার আগে শুনুন আমার কী হয়েছিল
মাথার বাঁদিকটা ঘর্ ঘর্ করত, ডানদিকে আশ্বিন মাস

এক শিঙওলা ভদ্রলোক ভিড় বাসের ভেতর
একটা স্কুলের মেয়েকে ঘষছিল |
আমি প্রতিবাদ করেছিলাম
সে আমাকে বাস থেকে নামিয়ে থাপ্পড় মেরেছিল বাঁ গালে!

আমার ব্রহ্মতালু গরর্…গরর্…গরর্…গরর্…
একটা বালককে দিয়ে বাসন মাজিয়ে গা টিপিয়ে নিয়ে
পেছনে লাথি মেরে তিনি বললেন, এই ৬০ টাকা
একটা পাঁইট আনবি, তারপর খেতে বসবি, যা |
আমি আর পারিনি, কলার টেনে ধরে তুললাম
কিন্তু সে আমার মুখে একদলা থুথু ছিটিয়ে দিল
থুতুতে কী ছিল জানি না, অসংখ্য ডুমুর ফুল
এসে আমার মুখের সামনে নাচতে লাগল |

পার্টি অফিস থেকে একটা ছেলে এসে বলল
আপনার ভূগোল বদলে দেব |
আমি পার্টি অফিসে গিয়ে বললাম
সম্পাদক বললেন, হুম, ছেলেটিও আমাদের
আপনিও আমাদের, মানিয়ে নিন |

পরের দিন সেই ছেলেটি আমাকে রাস্তায় বলল
মুখে রড ঢুকিয়ে পেছনের ফুটো দিয়ে
বের করে আনব, শালা দেড়েল!

বিটগাজর যখন রগে উঠে যায়
ভারত মহাসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে মেঘ দেখে
আপনি কী বলবেন?
গুরু গুরু মেঘ গরজে গগনে গগনে….


মৃত্যুর আগে তুমি কাজল পরেছিলে 

তুমি গঙ্গার একটা অংশ ছেড়ে চলে যাচ্ছ
কিন্তু তোমার আঁচলে নদীর আত্মজীবনী লেখা রইল |

বিচানার নীচ থেকে কয়েক লক্ষ কর্কট
বিছানা-সমেত তোমাকে তুলে নিয়ে চলেছে মহাকাশযানে |

ম়ৃত্যুর কয়েক মিনিট আগে তাও তুমি কাজল পড়েছ,
কাজল ও কান্নার মাঝখানে তোমার মুখে এক চামচ জল

 হ্যাঁ, আমি এক চামচ জল হয়ে
এক চামচ অন্তর্জলী হয়ে,  এক চামচ অঞ্জলি হয়ে,

তোমার ভেতরে একটা পূর্ণিমায় ভেসে যাওয়া
বিমানবন্দরে আমি বসে থাকতে চেয়েছিলাম |

আমি বলেছিলাম এটা বিমানবন্দর নয়
এটা একটা গ্রাম, লোকে বিরহী বলে ডাকে

এখানেই আমরা জীবনে প্রথম চুম্বন করেচিলাম
তুমি ছিলে চাবুকের মত তেজি এবং সটান

বেতস পাতার মতো ফার্স্ট ইয়ার এবং সেনসুয়াল কাঠবেড়ালি
বৃষ্টিতে ভিজলে তোমাকে আন্তিগোনের মতো দেখাত |

আমি ছিলাম গাঙচিল,
দু’লাইন কাফকা পড়া অসংগঠিত আঁতেল |

তুমি যমুনার একটা অংশ চেড়ে চলে যাচ্ছ
ডাক্তার তোমার হাতের শিরা খুঁজে পায়নি |

দোষ তোমার নয়, ডাক্তারের
এতবার তোমার শরীর ফুটো করেছিল ওরা

ইরাকের মৃত্তিকাও অতবার বার ফুটো করেনি আমেরিকা
কিন্তু তোমার ধমনী আসলে একটা নদীর আত্মজীবনী

তুমি তিস্তার একটা ঢেউ ছেড়ে চলে যাচ্ছ
আমার মাছরাঙা সেই ঢেউয়ের ভেতর আটকে গেছে |

সেই মাছরাঙার ঠোঁটে তোমার সংসার
বোরো যেখানে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স না পড়ে পড়ছে সাতটি তারার
.                                                               তিমির |

কিন্তু আমি নদীর পলিমাটি মেখে , হারে রে রে রে রে
একদিন শহরে ঢুকে পড়েছিলাম

কার্জন পার্কে শুয়ে কালপুরুষের সঙ্গে তর্ক করেছি
এসে দাঁড়ালেন বাত্সায়ন এবং নিৎসে

কালপুরুষ বলল, নাও, দুই মহান খচ্চর এসে গেছে,
যৌনতা এবং মৃত্যু

ওরা দুই সহোদর, কে তোমাকে বেছে নেয় সেটাই তোমার
.                                              সেমিফাইনাল
ডব্লু, ডব্লু, ডব্লু ড্যাশ ডটকম |

রাত দুটোর এ্যাম্বুলেন্সের ভেতর বসে আমি তোমার
হাত দুটি ধরে বলেছিলাম, বলো কোথায় কষ্ট ?

তুমি বলেছিলে, কৃষ্ণচূড়ায়, পারমানবিক পলিমাটিতে
তোমার অসংখ্য জুঁইফিলে জ্বালা করছে |

হাত থেকে একটানে চ্যানেল খুলে ফেলে বললে,
আমাকে বাঁচাও, ভালবাসা, আমি বাঁচতে চাই |

পৃথিবীতে আমি একটু শিউলির গন্ধ পেতে পারি ?
আমার নাক থেকে রাইস টিউব সরিয়ে দাও |

আমি বললাম এটা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট,
এখানে কোনও শিউলি গাছ নেই |

তুমি বললে, ছেলেটা কোথায় গেল, কার সঙ্গে গেল ?
ওকে একটু দেখো,রাত করে বাড়ি ফিরো না |

নার্সিংহোমের বারান্দায় বলে আমি একা, একেবারে একা
‘দ্য এম্পারার অফ অল ম্যালাডিজ’ পড়ছিলাম  |

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তার, তুমি ঠিক বলেছ
অন্ধকারে দাবা খেলছেন সারা পৃথিবীর অনকোলজিস্ট

উল্টোদিকে এ্যান্টিচেম্বার ড্রাগ-মাফিয়ারা বসে আছে
মানুষের গভীরতম দুঃখ যাদের ব্যবসা |

তুমি আমাকে বারবার বলতে সিগারেট  খেও না
আমি উড়িয়ে দিয়ে বলতাম, আমরা সবাই চিমনি সুইপার

আমরা কার্বনের সঙ্গে প্রণয় আর প্রণয়ের সঙ্গে
মেটাস্টেসিস বহন করে চলেছি |

কে একদিন রাস্তা থেকে ধরাধরি করে বাড়ি নিয়ে আসবে
তার আগে আজ, এখনই, আমি প্রজাপতিদের সঙ্গে দৌড়তে চাই,

আজ, এখনই মিলন করতে চাই, আশিরনখ মিলন
দেবতা না চড়ুই, কে দেখে ফেলল,  কিছু যায় আসে না |

মনে নেই আমরা একবার ভাঙা মসজিদে ঢুকেছিলাম
প্রচুর সাপের ভিতর আল্লা পা ছড়িয়ে বসে কাঁদছিলেন |

বললেন, আয় পৃথিবীতে যাদের কোনও জায়গা নেই
আমি তাদের জুন্নত এবং জাহানারার মাঝখানে

এখটা বিকেল বাঁচিয়ে রেখেছি ভালবাসার জন্য
গাছ থেকে ছিড়ে আনা আপেলে কামড় দিবি বলে |

তুমি তমসার একটা অংশ ছেড়ে চলে যাচ্ছ
কিন্তু তোমার আঁচল ধরে টানছে ছেলের উচ্চমাধ্যমিক |

ছেলে বলছে, মা, আমাকে কুজ্ঝটিকা বানান বলে দিয়ে যাও
আইসিইউ-তে কেউ কুজ্ঝটিকা বানান বলতে পারে না |

ছেলের বাবা বসে আছে, মেডিক্যাল বোর্ড বসেছে বারোতলায়
যেন হাট বসেছে বক্সিগঞ্জে, পদ্মাপারে |

কে যেন বলল, আরে বেরিয়ে আসুন তো ফার্নেস থেকে,
এরা পিঁপড়ে ধরতে পারে না, কর্কট ধরবে ?

একটা পানকৌড়ি ডুব দিচ্ছে গগনবাবুর পুকুরে
কেমোথেরাপির পর তোমাকে গোয়ায় নিয়ে গিয়েছিলাম |

একটা কোঙ্কনি কবিকে বললে,  ‘পানকৌড়ি দেখাও’,
একটা পর্তুগিজ গ্রামে গিয়ে কী দেখেছিলে আমাকে বলনি |

তুমি জলঢাকার একটা অংশ ছেড়ে চলে যাচ্ছ
যে বড় বড় টিপ পরতে তারা গাইছে, আমায় মুক্তি আলোয় আলোয় |

তুমি সুবর্ণরেখার একটা অংশ ছেড়ে চলে যাচ্ছ
তোমার লিপস্টিক বলছে, আমাদের নিয়ে চলো আয়না |

তুমি রোরো নামে একটা চাইবাসার নদী ছেড়ে চলে যাচ্ছ
সে বলছে, মা দাঁড়াও, স্কুল থেকে এক্ষিনি মার্কশিট তুলে আসছি |

তুমি ভল্ গা নামে একটা নদীর অংশ ছেড়ে চলে যাচ্ছ
পারস্যের রানি আতোসা তোমায় ডাকছে

পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর স্তন ছিল রানি আতোসার
কাটা হয়েছিল খড়গ দিয়ে, কেটেছিল এক গ্রিক ক্রিতদাস |

ইস্তানবুলের নদী বসফরাস ছেড়ে তুমি চলে যাচ্ছ
তোমার এক পা ইউরোপ, এক পা এশিয়া |

তুমি জিপসিদের হাটে তেজপাতা-মোড়ানো ওষুধ আনতে চলেছ
ইহুদি মেয়েরা তোমাকে নিয়ে গুহায় ঢুকে গেল  |

জিপসিরাই পৃথিবীতে প্রথম ব্যথার ওষুধ কুড়িয়ে পেয়েছে
তোমার বিশ্বাস ছিল শেষ ওষুধটাও ওরাই কুড়িয়ে আনবে |

শেষ একটা ওষুধের জন্য গোটা মানবজাতি দাঁড়িয়ে আছে
য়ে সেটা কুড়িয়ে আনবে,  সে বলবে, দাঁড়াও

আমি একটা আগুনের মধ্যে দিয়ে আসছি
বাবাকে বারণ করো হাসপাতালে বসে রাত জাগতে |

আমাকে য়দি কোনও ম্যাটাডোর বা মার্সিডিজ ধাক্কা না মারে
ভোর হওয়ার আগে আমি যে করে হোক শহরে ঢুকব |

এমন একটা অসুখ যার কোনও ‘আমরা ওরা’ নেই
ভিখিরি এবং প্রেসিডেন্টকে একই ড্রাগ নিতে হবে |

ডাক্তার, ভাল যদি নাই পারোষ এত সুঁচ ফোটালে কেন ?
সুঁচগুলো একবার নিজের পশ্চাতে ফুটিয়ে দেখলে হত না ?

তুমি গঙ্গার একটা অংশ ছেড়ে চলে যাচ্ছ, সত্যি চলে যাচ্ছ—–
রোরো তোমার আঁচল ধরে আছে, আমি তোমার রোদ্দুর |



অন্ধ কোকিলের ডাক

টাওয়ারের নিচে এসে দাঁড়িয়েছি; ঘন জ্যোৎস্নায় 
মথের মৃত্যুর দৃশ্য ছাড়া কোন অন্যান্য ঘটনা
এভাবে দেখিনি আর, পাতাবাহারের ঝোপ যেই
সরে গেল সূর্যাস্তের দিকে, ঠিক সেখান থেকেই

অপরাধবোধ শুরু। বেতারতরঙ্গে নিয়ে আসা 
মৃত্যু হৃদয়সংকেত, তার মধ্যে তৃতীয় শ্রুতির 
জন্মঃ কোকিলের ডাক ধরতে পারছি, তবে ঠিক
কে পাঠাচ্ছে, কোনদিক থেকে কোন দুর্গের সিপাহী 

জানতে পারিনিঃ আরো একটা বসন্ত লেগে যাবে
ল্যাবরেটরীর শূন্য ছাদ থেকে গোলাপের গন্ধ 
নেব বলে উঠে দেখি আরো কয়েক কিলোমিটার 
মরুভূমি এগিয়ে এসেছে— চালাঘর, মাইক্রোওয়েভ

জ্যোৎস্নায় তারকাঁটা, পপির বাগান ডুবে যাচ্ছে 
একটু একটু করে। এবার আমাকে ছেড়ে দাও
ক্যাপটেন, তোমার ছেলের সোয়াটার, আর 
মথের মৃত্যুর দৃশ্য—এই দুই খারাপ ঘটনা 
থেকে আবার আরম্ভ হবে অন্ধ কোকিলের ডাক




দাদা আজ আপনার জন্মদিন।  এই আনন্দ ঘন দিনে আপনার প্রতি আমার ও আমার পত্রিকার সকল কবি, লেখক এবং পাঠকের তরফ থেকে শ্রদ্ধা, প্রণাম, ভালোবাসা জানালাম। ভালো থাকবেন।