দেবী সরস্বতী নদীরূপে প্রথম কোথায় আবির্ভূত হন?
ভারতীয় আধ্যাত্মিক, পৌরাণিক এবং ভাষাতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের ধারায় দেবী সরস্বতী এক বহুমাত্রিক সত্তা। আজ যাঁকে আমরা জ্ঞান, সঙ্গীত ও বাণীর দেবী রূপে জানি, তিনি আসলে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হন একটি নদী রূপে। এই নদীরূপই তাঁর প্রাচীনতম এবং মূল রূপ। এই নদীরূপে সরস্বতীর প্রথম ও সুস্পষ্ট আবির্ভাব দেখা যায় ঋগ্বেদে। প্রশ্ন হল, এই নদী প্রথম কোথায় আবির্ভূত হয়? কেবল আধ্যাত্মিক বা সাংস্কৃতিক দিক থেকে নয়, ভৌগোলিক ও পুরাণগত দিক থেকেও এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা গুরুত্বপূর্ণ।
ঋগ্বেদে সরস্বতীকে বলা হয়েছে “নদীতমা”, অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ নদী। ঋগ্বেদ ৬.৬১.১–১৩ সূক্তে সরস্বতীকে একটি প্রমত্ত, সজীব, প্রসারিত নদী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে তাঁর প্রবাহের উৎসস্থানের বর্ণনায় বলা হয়েছে—তিনি পর্বত থেকে গড়িয়ে পড়েন এবং সমতলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হন। “সপ্তসিন্ধবঃ” অঞ্চলের মধ্যে সরস্বতীর অবস্থান নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এই সপ্তসিন্ধব অঞ্চলটি বর্তমানের উত্তর-পশ্চিম ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিস্তৃত ছিল—বিশেষত পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং রাজস্থানের একাংশ। এই অঞ্চলেই দেবী সরস্বতী নদীরূপে প্রথম আবির্ভূত হন বলে প্রাচীন বেদীয় সাক্ষ্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
ঋগ্বেদে বারবার “সরস্বতী” নামের সঙ্গে এক প্রবাহমান, ধ্বনিপূর্ণ, প্রমত্ত নদীর প্রতিচিত্র ফুটে ওঠে। এই নদী ‘বৃহৎ ধারা বিশিষ্ট’, ‘সাতটি শাখা যুক্ত’, এবং যার প্রবাহ পৃথিবীর বুক জুড়ে বিস্তৃত। সরস্বতীকে বলা হয়েছে—“ইয়ান্নি গ্রামাণি চ চর্ষণীনাম্ ধেনুর্ন শিশে আসমতী ইব” (ঋগ্বেদ ৬.৬১.৯), অর্থাৎ তিনি যেমন জনপদ ও গ্রামপল্লীকে জীবনদায়িনী রূপে প্রবাহিত করেন, তেমনই তিনি দুধেভরা গাভীর মতো স্নেহময়ী। এই বর্ণনায় একটি নদীর প্রতি আরাধনার মধ্যে দিয়ে এক মাতৃরূপ উদ্ভাসিত হয়।
বহু গবেষণায় এই নদীর অবস্থানকে বর্তমান ভারতের ঘঘর নদীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ঘঘর নদী হিমালয়ের শিওয়ালিক পর্বতমালা থেকে উৎপন্ন হয়ে হরিয়ানা ও রাজস্থানের মরু অঞ্চল অতিক্রম করে পাকিস্তানের হাকড়া নদীপ্রবাহে মিশে যায়। আধুনিক ভূগোলবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদেরা মনে করেন, সরস্বতী নদী আদিতে ঘঘর-হাকড়া নদী ছিল, যেটি ক্রমান্বয়ে শুকিয়ে যায়, কিন্তু তার বালির নীচে প্রাচীন নদীখাতের চিহ্ন এখনও বিদ্যমান।
উপগ্রহচিত্র ও ভূগর্ভস্থ জলপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে এই ঘঘর-হাকড়া নদীর উত্স ছিল হিমালয়ের শাখা নদী সরযূ, সুতলজ ও দৃষ্টি নদী থেকে, যেগুলি একত্রিত হয়ে সরস্বতী রূপে প্রবাহিত হতো। এই নদীর উৎপত্তিস্থান হিমালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষ করে যমুনা ও সুতলজের মধ্যবর্তী উচ্চভূমি অঞ্চল। এখানে আজকের আম্বালা, কুরুক্ষেত্র, ক্যাথল, হিষার, স্যারসা অঞ্চলে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে এই অঞ্চলই সরস্বতী নদীর শৈশবভূমি ছিল। অর্থাৎ, দেবী সরস্বতী নদীরূপে প্রথম আবির্ভূত হন হিমালয়ের কোলঘেঁষা এই অঞ্চলেই।
পুরাণে সরস্বতীর আবির্ভাবস্থান সম্পর্কে কিছুটা ভিন্ন আখ্যান পাওয়া যায়। স্কন্দ পুরাণে বলা হয়েছে, সরস্বতী হিমালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে ত্রিলোক প্রবাহিনী রূপে প্রবাহিত হন। আবার, ব্রহ্মান্ড পুরাণে উল্লেখ আছে যে ব্রহ্মার কপাল থেকে সরস্বতী নির্গত হন এবং জলরূপে প্রবাহিত হয়ে ‘ব্রহ্মাবর্ত’ নামে একটি অঞ্চল সৃষ্টির কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এই ব্রহ্মাবর্ত অঞ্চলটিকেই আধুনিক গবেষকরা উত্তর ভারতের কুরুক্ষেত্র-হরিদ্বার অঞ্চলের সঙ্গে মিলিয়ে থাকেন। এই ভূখণ্ডই আর্য সংস্কৃতির প্রথম কেন্দ্র এবং সরস্বতীর নদীস্বরূপ প্রথম প্রতিষ্ঠার স্থান।
মহাভারতে এই নদীর একাধিক অবস্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে সরস্বতী কখনও ধৃতরাষ্ট্রের সভায় আলোচনার বিষয়, কখনও বনবাসী পাণ্ডবদের তীর্থস্থান। বিশেষত “সরস্বতী প্রবা”, “ব্রাহ্মণীর ধারা” প্রভৃতি নামধারণ করে তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারতের বহু অঞ্চলে প্রবাহিত হয়েছেন বলে উল্লেখ আছে। মহাভারতের সূত্র অনুযায়ী, সরস্বতী প্রথম আবির্ভূত হন প্লকষ নামক বটবৃক্ষের নিকটে, যা অবস্থিত ছিল হিমালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে, যেখানে আজকের পাঞ্জাব অঞ্চলের মানসা ও সাঙ্গুর শহরের সন্নিকট এলাকায় সরস্বতীর প্রবাহচিহ্ন ধরা পড়ে।
তন্ত্রশাস্ত্রেও সরস্বতী নদীর প্রথম আবির্ভাবস্থানকে এক আত্মিক উৎসের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বীজমন্ত্র ‘ঈঁ’ শব্দধ্বনির আদি-উচ্চারণস্থল যেখানে, সেখানেই সরস্বতী নদীর উৎস। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, মানবমস্তিষ্কে যেখানে চিন্তা ও বাকের উদ্ভব, সেই অঞ্চলই একপ্রকার সরস্বতীর অন্তর্জল উৎস। যদিও এটি আধ্যাত্মিক রূপক, তবে তা ঐতিহ্যের উৎস অনুসন্ধানে গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে।
আধুনিক প্রত্নতত্ত্বে সরস্বতীর প্রথম আবির্ভাবস্থান সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হল—কালিবঙ্গা। এটি রাজস্থানের উত্তরাংশে অবস্থিত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, যেখানে ঘঘর নদীর অববাহিকায় এক বিস্তৃত নগর সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়। এখানে সেচ ব্যবস্থার নিখুঁত প্রমাণ ও নদীঘেঁষা গৃহনির্মাণের চিহ্নে স্পষ্ট বোঝা যায়, এই নদী (সরস্বতী) সেখানে মূল জীবনরেখা হিসেবে কাজ করত। এর আগে হরিয়ানার বানওয়ালি, রকিগড়ি, কুরুক্ষেত্র অঞ্চলেও প্রাচীন সরস্বতী সভ্যতার চিহ্ন দেখা গিয়েছে। এসব অঞ্চল থেকেই সরস্বতীর প্রবাহ শুরু হয়েছিল।
ব্রিটিশ ভূতত্ত্ববিদ স্যার রিচার্ড টেম্পল এবং পরবর্তীকালে রোমিলা থাপার, মাইকেল ড্যানিনো প্রমুখ ঐতিহাসিক গবেষকরা সরস্বতী নদীর আবির্ভাবের স্থান নির্ধারণে বহু প্রাচীন এবং আধুনিক মানচিত্র, জলপথ ও ভূপ্রকৃতির উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন—এই নদীর উৎপত্তিস্থান হিমালয়ের শাখানদীসমূহ দ্বারা সৃষ্ট, এবং তা হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের মধ্যভাগ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রাজস্থান পেরিয়ে সিন্ধুপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হতো। অনেক গবেষণায় তো বলা হয়েছে, এক কালে সরস্বতীর প্রবাহ গঙ্গা-যমুনার থেকেও প্রমত্ত ছিল।
এই নদীর হারিয়ে যাওয়া বা গর্ভগামী হয়ে যাওয়া এক চরম সাংস্কৃতিক প্রতীক। পুরাণে বলা হয়েছে, পাপপ্রভাবে ও যুগের পরিবর্তনে সরস্বতী এক সময় ভূমিগত হয়ে যান। তিনি স্থূল জলধারারূপে আর দৃশ্যমান থাকেন না, বরং অন্তর্জলে, আধ্যাত্মিক বোধে, শব্দের অন্তর্জগতে রূপান্তরিত হন। সেই অর্থে তাঁর আবির্ভাবের স্থান আজও জীবন্ত, তবে তা জলের মধ্য দিয়ে নয়, বরং মানুষের বুদ্ধির, ভাষার ও চিন্তার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত।
সারাংশে বলা যায়, দেবী সরস্বতী নদীরূপে সর্বপ্রথম আবির্ভূত হন হিমালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ থেকে প্রবাহিত হয়ে হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের মধ্য দিয়ে বিস্তৃত অঞ্চলে। এখানেই তিনি ভৌগোলিক বাস্তবতায় জলধারারূপে উদ্ভাসিত, এবং এখান থেকেই পরবর্তীকালে তিনি সংস্কৃতি, ভাষা ও আধ্যাত্মিকতায় রূপান্তরিত হন এক দেবীরূপে।
নদীরূপে সরস্বতীকে কোন দেবী তত্ত্বের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়?
ভারতীয় ধর্মতত্ত্ব ও আধ্যাত্মিক চিন্তাধারায় দেবী সরস্বতী কেবলমাত্র জ্ঞান, সঙ্গীত ও ভাষার দেবী নন; তিনি আদিতে নদী, এবং সেই নদী-রূপেই তিনি বহু তাত্ত্বিক, দার্শনিক ও উপনিষদীয় ব্যাখ্যার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেন। নদী যখন প্রবাহমান, প্রাণবন্ত, জীবনদাত্রী ও ধ্বনিপূর্ণ, তখন তার মধ্যে এক দেবীস্বরূপ মহাশক্তির অনুভব অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষিতেই প্রশ্ন ওঠে—এই নদীরূপী সরস্বতী আসলে কোন দেবী তত্ত্বের প্রতীক? কেবল প্রকৃতির এক জলধারা, না কি বেদান্ত, তন্ত্র ও শক্তিবাদের গূঢ়তর উপাদানের রূপ?
দেবী সরস্বতীর নদী-রূপটি সবচেয়ে পুরনো ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদে উদ্ভাসিত হয়। সেখানে তিনি “নদীতমা”, “অম্বিতমা”, “বেষ্টতমা”—অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ নদী, সর্বশ্রেষ্ঠ মাতা, সর্বোৎকৃষ্ট শক্তি। এই বর্ণনাগুলোর মধ্যেই নিহিত রয়েছে তাঁর বহুমাত্রিক তত্ত্বগত পরিচয়। সরস্বতী সেখানে শুধু ভূগোল নয়, সৃষ্টির এক গতিশীল চেতনা। এই প্রবাহরূপী চেতনা, যা শব্দ, চিন্তা, বুদ্ধি ও আলো জাগায়, তা দেবী তত্ত্বে এক বিশেষ অবস্থান বহন করে। এবং এই অবস্থানকে বোঝার জন্য আমাদের দেখতে হবে তিনটি প্রধান তত্ত্বধারা—বেদান্ত, তন্ত্র, ও শাক্ত দর্শন—যাঁরা সরস্বতীর নদীরূপকে এক বিশেষ প্রতীকী পরিধিতে ব্যাখ্যা করেছেন।
১. আদিশক্তির ‘জ্ঞানের স্রোত’ রূপে সরস্বতী
শাক্ত দর্শনে, বিশেষত ‘শ্রীবিদ্যা’ এবং কুলাচার তন্ত্রে, সরস্বতী নদীরূপে ধরা হন আদ্যাশক্তির এক বিশেষ প্রকাশ হিসেবে। শক্তির তিন প্রধান রূপ—সরস্বতী, লক্ষ্মী ও কালী। এই তিন রূপই প্রাকৃতিক ও মনঃপ্রকৃতিগত গুণের সঙ্গে যুক্ত—সরস্বতী যুক্ত তমোগুণ শুদ্ধিকারী ‘সত্ত্বগুণ’-এর সঙ্গে। নদী সরস্বতী প্রবাহমান জ্ঞান, শব্দ এবং ধ্যানের প্রতীক। নদী যেমন মৃত জমিকে সজীব করে, তেমনি সরস্বতীর নদীরূপ জড়চিত্ত মানবতাকে সজীব, মননশীল ও জাগ্রত করে তোলে। এই প্রবাহ একরকম জ্ঞানশক্তির মহাশক্তি—একেবারে তত্ত্বগত স্তরে।
তন্ত্রশাস্ত্রে বর্ণিত ‘নদী’ বা ‘সরঃ’ শব্দটির আভিধানিক অর্থই হল যা প্রবাহিত হয়। সরস্বতী শব্দের মূল 'স্রু' ধাতু, যার অর্থ প্রবাহ। এই প্রবাহ কেবল জল নয়—এ এক জ্ঞানের ধারা, শব্দের ধারা, চেতনার ধারা। অতএব নদীরূপী সরস্বতী আসলে আদ্যাশক্তির বাকশক্তি রূপ। বেদে বলা হয়েছে, বাক অর্থাৎ বাক্যরূপী শক্তি জগত সৃষ্টি করে। সেই বাক শক্তির স্বরূপই নদী সরস্বতী।
২. শব্দব্রহ্ম ও সরস্বতী
উপনিষদীয় দর্শনে শব্দকে ‘ব্রহ্ম’ বলা হয়েছে—‘শব্দ ব্রহ্মণি নিস্রুতম্’। নদীরূপে সরস্বতী এই শব্দব্রহ্মের বহমানতা। ব্রহ্মের সৃষ্টি ক্রিয়া শব্দের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। সেই শব্দধারার প্রতীক সরস্বতী। এবং এই শব্দ একদিকে ধ্বনি, অন্যদিকে চিন্তা ও বুদ্ধি। এইভাবে নদীসরস্বতী হয়ে ওঠেন জ্ঞানের আদি-মাধ্যম। তিনি একাধারে ধ্বনি, প্রতিধ্বনি, ধ্যান, মনন—যা গড়ে তোলে মনের নদী।
এই তত্ত্বে নদীসরস্বতী হচ্ছেন মৌলিক শব্দতত্ত্বের জীবন্ত প্রতীক। শব্দ, বাক ও অর্থ—এই ত্রয়ী শক্তির সম্মিলনই নদীসরস্বতীর বর্ণনা। এই তিন শক্তির মিলনে জ্ঞান জন্মায়, সংস্কৃতি গঠিত হয়। তাই উপনিষদ বলেছে—যেখানে বাক ও চিন্তার নদী মিলে যায়, সেখানেই ব্রহ্ম উপলব্ধি সম্ভব।
৩. সৃষ্টির সূচনায় জলতত্ত্ব এবং সরস্বতী
ঋগ্বেদ, শিবসংহিতা, এবং অনেক তান্ত্রিক সূত্র অনুযায়ী, জগতে প্রথমত সৃষ্টি হয়েছিল আপঃ—জল। সমস্ত সৃষ্টি সেই জলে ভাসমান ছিল। এই আদিজলরূপেই সরস্বতী প্রতীক হয়ে ওঠেন সৃষ্টির প্রথম পরিবেশ। তাই নদীসরস্বতী কেবল মর্ত্য জগতের বহমান নদী নন, তিনি সৃষ্টির প্রথম স্তরের তত্ত্বরূপী জলরাশিরও প্রতীক।
এই নদী একাধারে আধিভৌতিক জলের প্রতীক, আবার আধ্যাত্মিক চেতনারও ধারক। এই কারণে শাক্ত তন্ত্রে সরস্বতী নদীকে “চিন্ময়ী গঙ্গা” বলা হয়েছে। চিন্ময়ী অর্থাৎ চেতনার নদী—যা দেহ ও মন দুইকেই শুদ্ধ করে।
৪. যোগতত্ত্বে সরস্বতী নদী ও 'সুষুম্না নাড়ী'
যোগশাস্ত্রে মানুষের শরীরের ভিতরে তিনটি প্রধান 'নাড়ী' বা প্রণাশক্তির পথ বর্ণনা করা হয়েছে—ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না। সরস্বতী কখনও কখনও ‘সুষুম্না নাড়ী’র প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হন। যেমন হঠযোগ প্রদীপিকা-তে বলা হয়েছে—‘সরস্বতী নদী’ শরীরের ভিতরে একটি গোপন প্রণাচ্যানেল, যেখান দিয়ে কুণ্ডলিনী শক্তি প্রবাহিত হয়ে মাথার চূড়ায় পৌঁছয়। এই নদী, যা বাইরের জগতের নয়, বরং আমাদের অন্তর্চেতনায় গোপনে প্রবাহিত, সেই নদীই হল একেবারে অভ্যন্তরীণ সরস্বতী।
এইভাবে, নদীসরস্বতী একটি যোগতাত্ত্বিক পথ, যা শরীর থেকে মনের, মন থেকে আত্মার জগতে প্রবাহিত হয়।
৫. পুরাণতত্ত্বে সরস্বতী—স্থূল থেকে সূক্ষ্মের যাত্রা
পুরাণে সরস্বতী নদী প্রথমে স্থূলজলে প্রবাহিত হন। পরবর্তীতে তিনি অন্তর্হিত হন মাটির নীচে। এই গর্ভগমন একেবারে দার্শনিক স্তরে এক বিশেষ অর্থ বহন করে—জ্ঞানচেতনা বা বাকশক্তি যখন বাইরের জগতে ধরা দেয় না, তখন তা ভিতরে ডুবে যায়, অন্তর্মুখী হয়। অর্থাৎ, নদীরূপ সরস্বতী হলেন স্থূল থেকে সূক্ষ্মের যাত্রার প্রতীক।
এই দৃষ্টিতে সরস্বতী হলেন 'অলিখিত উচ্চারণ' বা পরাবাক। শব্দের চারটি স্তর বলা হয়—পরা, পশ্যন্তী, মধ্যমা, বৈখরী। বৈখরী মানে উচ্চারিত শব্দ, মধ্যমা মানে ভাবনা, পশ্যন্তী মানে ইচ্ছা, আর পরা মানে নির্জন, নিরাকার শব্দতত্ত্ব। নদীসরস্বতী এই পরা শব্দের রূপ, যা আমাদের চিন্তা ও প্রাণশক্তিকে বহন করে নিয়ে যায় উচ্চতর উপলব্ধির দিকে।
৬. নদীসরস্বতী ও 'স্মৃতি-সংস্কৃতি'র ধারা
নদীসরস্বতী কেবল এক প্রকৃতির স্রোত নয়, তিনি এক সাংস্কৃতিক ধারার প্রতীক। ভারতীয় সংস্কৃতির বহু আদি সভ্যতা, যেমন হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়ো, কালীবঙ্গা, বানওয়ালি—এসবই সরস্বতী নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল। সেই অর্থে এই নদী হলো সংস্কৃতি, স্মৃতি ও সভ্যতার ধারক। দেবী সরস্বতী তাই ইতিহাসের গভীরতম স্তরে জ্ঞান, শিল্প, কৃষি, সভ্যতা ও ধর্মের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন।
এই প্রেক্ষাপটে নদীসরস্বতী হলেন ‘ধারা’র প্রতীক—যা ছিন্ন হয় না, যা বহমান।
দেবী সরস্বতী নদীরূপে প্রতীক রূপে প্রকাশ করেন জ্ঞানের প্রবাহ, বাকশক্তির গতিময়তা, শব্দতত্ত্বের গভীরতা, চেতনার উন্নয়ন, এবং স্মৃতির ধারাবাহিকতা। তিনি শুধু একটি মাটির উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া জলধারা নন, তিনি সময়, সংস্কৃতি, মনন, ও মরমী জগতের প্রতিচ্ছবি। সেই জন্য নদীসরস্বতী হলেন তত্ত্বগতভাবে—
জ্ঞানের আদি উৎস
চেতনার প্রবাহ
বাক ও ধ্বনির প্রতিমা
অন্তর্জগতের আত্মা
সৃষ্টি ও স্মৃতির ধারাবাহিকতা
অতএব, নদীরূপী সরস্বতী কেবল ভূগোলের বিষয় নন; তিনি ভারতীয় মননের সবচেয়ে গভীর, সূক্ষ্ম এবং বহমান দেবী তত্ত্বের এক শ্রেষ্ঠ রূপ।
তথ্যসূত্র –
১. ভারতীয় সংস্কৃতিতে সরস্বতীর স্থান – ড. লক্ষ্মীনারায়ণ মিশ্র, ১৯৯৭
২. সরস্বতী নদী ও হরিয়ানা – প্রবীণ চৌধুরী, ২০০০
৩. ভারতের হারানো জলস্রোত – প্রণব মুখোপাধ্যায়, ২০০২
৪. সরস্বতী: নদী এবং সভ্যতা – ড. বিভাস ঘোষ, ১৯৯৬
৫. পুরাতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে সরস্বতী – অশোক বর্মণ, ২০০৪