পুরাণ থেকে প্রমাণের পথে : সরস্বতী নদী
নদী ও বাকের মধ্যে সরস্বতীর সংযোগ কোথা থেকে উদ্ভূত?
ভারতীয় ধর্মতত্ত্বে দেবী সরস্বতী এক বহুমাত্রিক সত্তা, যার মধ্যে একত্রিত হয়েছে জলপ্রবাহ ও বাকপ্রবাহের দুই গূঢ় ধারা। প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে তিনি যেমন এক জীবন্ত নদীসরূপা দেবী, তেমনি বাণী ও জ্ঞানের আধিষ্ঠাত্রীশক্তি। এই দ্বৈত রূপ—নদী এবং বাক—সরস্বতীর মধ্যে কিভাবে মিলিত হয়েছে, তার ইতিহাস পুরাতন, গভীর এবং বহুস্তরীয়। এই সংযুক্তি কেবল একটি পৌরাণিক বিশ্বাস নয়, বরং ভারতীয় দর্শনের মধ্যে এক বিস্ময়কর প্রতীকি সূত্র।
ঋগ্বেদের বহু মন্ত্রে সরস্বতীকে একাধারে দেবী, নদী ও মাতৃরূপে বন্দনা করা হয়েছে। “অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী”—এই মন্ত্রে তাঁর পরিচয় একত্র তিনটি রূপে। তিনি মা, তিনি নদী, তিনি দেবী। এখানেই ধরা পড়ে সেই সংযোগের সূচনা যেখানে প্রকৃতির জলরাশি হয়ে ওঠে উচ্চারণের অনুপ্রেরণা। সরস্বতীর জলপ্রবাহ শুধু ভূগোলের স্রোত নয়, তা মনের মধ্যেও বয়ে চলে ধ্বনিরূপে, বাকরূপে।
ঋগ্বেদে সরস্বতী নদীর সঙ্গে সঙ্গে 'প্রব্রাহ্মণী', 'চেতয়ন্তী সূনৃতানাং' ও ‘বোধয়ন্তী’ হিসেবে বর্ণিত। অর্থাৎ, তিনি যিনি চেতনার উদ্রেক করেন, বাকের প্রবাহ জাগিয়ে তোলেন। এইভাবে নদীর জলরাশি এক রূপক হয়ে ওঠে বাকপ্রবাহের—যেমন নদী প্রবাহিত হয় ভূমিতে, বাক প্রবাহিত হয় চেতনার ভূগর্ভে। তাঁর জলধারা যেমন বহন করে শস্যের উর্বরতা, তেমনি তাঁর বাকধারা বহন করে মনের উর্বরতা।
এই ভাবনাটি আরও স্পষ্ট হয় উপনিষদীয় ও পুরাণীয় সাহিত্যে। ব্রহ্মার মুখ থেকে উৎপন্ন বাক যখন রূপ নিতে থাকে, তখন সেই বাক প্রতিমূর্ত হয় সরস্বতী হিসেবে। নদীর মতো যে বাক প্রবাহিত হয়, তা স্থবির নয়—চিরচঞ্চল, চিরজাগরুক। জল যেমন মৃত বস্তু নয়, তেমনি বাকও শুধুমাত্র ধ্বনি নয়; দুটোই প্রাণসম্পন্ন, প্রভাববিস্তারকারী ও রূপান্তরশীল। এই কারণে সরস্বতী কখনও কেবল নদী নন, আবার কেবল বাকও নন—তিনি এই দুইয়ের এক প্রাণময় যোগসূত্র।
আরও গভীরভাবে দেখতে গেলে দেখা যায়, ঋষিরা যেভাবে নদীর ধারে বসে ধ্যান করতেন, সেই ধ্যানেই উঠে আসত ভেতরের বাক, অনুভব, শব্দ এবং পরিশেষে মন্ত্র। প্রকৃতির জলধারার মতো সেই ধ্বনিও ছিল শুদ্ধ, নিরবচ্ছিন্ন, অলৌকিক। এইভাবে সরস্বতী নদী থেকে দেবীতে রূপান্তরিত হন এবং বাকদেবী হিসেবে প্রতিষ্টা পান।
পৌরাণিক বর্ণনায় বলা হয়েছে, প্রজাপতি ব্রহ্মা যখন সৃষ্টির প্রথম ধ্বনি উচ্চারণ করতে চাইলেন, তখন সেই ধ্বনির আকৃতি রূপ নেয় সরস্বতী হিসেবে। তিনি নিজেই ব্রহ্মার বাক, সৃষ্টির মূল শব্দ। এই বাক নদীর মতো প্রবাহিত হয়ে জগতে প্রাণ সঞ্চার করে। জ্ঞানের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, যেমন জল ছাড়া শস্য জন্মায় না, তেমনি বাক ছাড়া চিন্তার জন্ম হয় না। এইভাবে সরস্বতী শুধু বহমান নদী নন, তিনি ভাবনারও নদী।
ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে সরস্বতী শব্দের মূল অর্থই ‘স্রোতের অধিষ্ঠাত্রী’। ‘সারস’ ধাতু থেকে এসেছে ‘সরস্বতী’, যার অর্থ প্রবাহ, ছড়িয়ে পড়া, সঞ্চালন। এখানেই নদী ও বাকের মধ্যে প্রাকৃতিক মিল—দু'টিই প্রবাহমান, জাগ্রত এবং সৃষ্টিশীল। এই কারণে সরস্বতীর চিহ্ন নদী ও বাণী—দু'টিতেই একসঙ্গে ধরা পড়ে। তাঁর জল হল ভাবের জোয়ার, তাঁর বাক হল চেতনার স্রোত।
সময় যত এগিয়েছে, সরস্বতীর নদীসত্তা ধীরে ধীরে ভৌগোলিক মানচিত্র থেকে মুছে গেলেও তাঁর বাকসত্তা আরও বেশি করে স্থায়ী হয়েছে সংস্কৃতির ভিতরে। বেদের বাক হয়ে, পুরাণের দেবী হয়ে, উপনিষদের চেতনা হয়ে—তিনি রয়ে গেছেন। তাই সরস্বতী নদী ও বাক—এই দুই রূপেই সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, এবং এই দুইয়ের সংযোগই তাঁকে দেবী হিসেবে সর্বোচ্চ স্থানে স্থাপন করেছে। এই সংযোগ শুধু এক ঐতিহাসিক রূপান্তর নয়, বরং ভারতীয় ধর্মতত্ত্বে জ্ঞান, প্রকৃতি ও চেতনার এক পরম মিলনবিন্দু।
নদী-সরস্বতী এবং বিদ্যা-সরস্বতীর মধ্যে মূল পার্থক্য কি ?
ভারতীয় সংস্কৃতি ও ধর্মতত্ত্বের অঙ্গনেই সরস্বতী দেবী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছেন। সরস্বতীকে নানা রূপে উপলব্ধি করা হয়। তার মধ্যে প্রধান দুটি রূপ হলো নদী-সরস্বতী এবং বিদ্যা-সরস্বতী। এই দুই রূপের মধ্যে প্রায়শই বিভ্রান্তি ঘটে, কারণ নাম এক হলেও তাদের প্রকৃতি, প্রতীক, কাজ ও অর্থভেদ ব্যাপক। নদী-সরস্বতী যেমন ছিল এক প্রাচীন, শারীরিক নদী, তেমনি বিদ্যা-সরস্বতী হলো আধ্যাত্মিক জ্ঞানের দেবী। এই প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব নদী-সরস্বতী এবং বিদ্যা-সরস্বতীর মধ্যে মূল পার্থক্যগুলি।
প্রথমত, নদী-সরস্বতী প্রকৃতপক্ষে এক ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক বাস্তবতা। প্রাচীনকাল থেকে ঋগ্বেদে সরস্বতী নদীর উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে তাকে বিশাল জলধারা, জীবনের উৎস ও পবিত্র নদী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই নদী হিমালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতীয় সমভূমির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এক মহৎ নদী ছিল, যা বৈদিক জনসমাজের জন্য একটি অমূল্য জলাধার। নদী-সরস্বতী প্রকৃতির এক অংশ, যা মানুষের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলে। এই নদীর পানি ছিল উর্বর জমির জীবনদায়ক, যা কৃষি, পরিবহণ, তীর্থ ও জীবনযাত্রার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করত। পুরাণ ও ইতিহাসে সরস্বতী নদীকে মায়াময়, নির্মল ও পবিত্র হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।
অন্যদিকে, বিদ্যা-সরস্বতী হলো একটি বিমূর্ত ও আধ্যাত্মিক রূপ। তিনি জ্ঞানের দেবী, ভাষার অধিষ্ঠাত্রী এবং সংস্কৃতি ও শিল্পের প্রেরণা। বিদ্যা-সরস্বতী মানুষকে চিন্তার আলো দেয়, তার বুদ্ধি ও মেধার বিকাশ ঘটায়। তাঁর আরাধনা শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়, কারণ তিনি বিদ্যা অর্জনে সহায়ক। বিদ্যা-সরস্বতীর রূপ কালো, সাদা বা হলুদ পোশাকধারিণী হিসেবে চিত্রিত হয়; হাতে থাকে বীণা, গ্রন্থ ও মুদ্রা। এই রূপে তিনি অশরীরী, মানবচেতনার অংশ, যার অস্তিত্ব মনের গভীরে এবং আধ্যাত্মিক জগতে নিহিত।
দ্বিতীয়ত, নদী-সরস্বতীর ভূমিকা ছিল শারীরিক ও প্রাকৃতিক। তিনি পানির প্রবাহ, জীবনদানে সক্ষম এক প্রকৃতির উপহার। তার জল প্রকৃতিতে প্রাণ ফেরায়। সরস্বতী নদীর তীর্থ স্থানগুলি প্রাচীন থেকে পবিত্র ও আধ্যাত্মিক স্থান হিসেবে পরিচিত ছিল। মানুষ নদী-সরস্বতীর কাছে নিজেদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে জীবনের শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করত। নদী-সরস্বতীর পানির স্রোত কৃষিজীবনকে সঞ্চালিত করে, জনজীবনে শীতলতা আনে এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে। নদী-সরস্বতীর স্রোত মানুষকে জীবনের মূর্ত উপস্থিতি বুঝিয়ে দেয়।
অপরদিকে, বিদ্যা-সরস্বতীর কাজ হয় মনের গভীরে। তিনি মানুষের চিন্তা, জ্ঞান ও সৃষ্টিশীল শক্তির উৎস। বিদ্যা-সরস্বতীর আরাধনা মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও শিল্প-সৃষ্টির বিকাশ ঘটায়। তার আশীর্বাদ ছাড়া শিক্ষা অর্জন অসম্ভব। বিদ্যা-সরস্বতীকে বীণাবাজি ও সঙ্গীতের দেবী হিসেবেও গণ্য করা হয়, কারণ তিনি সৃজনশীলতা ও ভাষার শুদ্ধতার প্রতীক। তিনি মানুষকে সত্য ও জ্ঞানপথে পরিচালনা করেন, যার মাধ্যমে আত্মার মুক্তি সম্ভব।
তৃতীয়ত, নদী-সরস্বতীর অস্তিত্ব ছিল দৃশ্যমান ও দৈহিক। তিনি প্রকৃতিপ্রসূত জলপ্রবাহ, যা স্পর্শ ও দর্শনীয়। ঋগ্বেদের একাধিক স্তোত্রে সরস্বতী নদীকে প্রশংসা করা হয়েছে, তার বিস্তৃত জলধারা ও শক্তির কথা বলা হয়েছে। ইতিহাস ও পুরাণ অনুসারে, এই নদী উত্তর ভারতের প্রাচীন ভূখণ্ডে প্রবাহিত ছিল, কিন্তু বর্তমানে তার প্রকৃত রূপ বা স্রোত অনেকাংশে অদৃশ্য হয়ে গেছে। নদী-সরস্বতীর অস্তিত্ব লোকজ ও ধর্মীয় বিশ্বাসের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সংরক্ষিত হয়েছে। নদীর শারীরিক উপস্থিতি মানুষের জন্য শান্তি, পবিত্রতা ও জীবনের ধারক।
বিদ্যা-সরস্বতী অদৃশ্য, আধ্যাত্মিক ও বিমূর্ত। তিনি মনের গভীরে বাস করেন। বিদ্যার জ্যোতি তারই প্রকাশ। তিনি ব্যক্তির অন্তর্যামী, যার অস্তিত্ব শারীরিক নয়, বরং বুদ্ধি ও চেতনার আকাশে বিরাজমান। বিদ্যা-সরস্বতীর মাধ্যমে মানুষ জ্ঞান আহরণ করে, কলা-কৌশলে পারদর্শী হয়। তাঁর অস্তিত্ব মনের আভা ও চিন্তার প্রবাহের মধ্যে নিহিত।
চতুর্থত, প্রতীক ও চিহ্নের দিক থেকে নদী-সরস্বতীকে জল, প্রবাহ, নদী ও নদীতীর দিয়ে বোঝানো হয়। তিনি প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক নদীর মতো এক বিস্তৃত স্রোত, যা জীবনধারা বহন করে। নদী-সরস্বতীকে অনেক সময় সাদা রঙের প্রবাহময় জলধারা হিসেবেও চিত্রিত করা হয়। এদিকে, বিদ্যা-সরস্বতীকে বীণা, গ্রন্থ ও সাদা পোশাক পরিহিত দেবী হিসেবে দেখা হয়। তিনি বুদ্ধি, ভাষা ও শিল্পের দেবী, যিনি মানুষের জ্ঞানচেতনার আলো জ্বালান।
পঞ্চমত, ধর্মগ্রন্থে নদী-সরস্বতীর উল্লেখ ঋগ্বেদ ও পুরাণে পাওয়া যায়। ঋগ্বেদের অনেক মন্ত্রে সরস্বতী নদীর গৌরব ও শক্তি বর্ণিত হয়েছে। পুরাণেও নদী-সরস্বতীকে ভূমির পবিত্র স্রোত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিদ্যা-সরস্বতী সম্পর্কে বেশি তথ্য পাওয়া যায় উপনিষদ ও বেদান্তে, যেখানে তিনি বিশ্ববাকেরূপে পরিচিত। এই সমস্ত শাস্ত্র সরস্বতী দেবীর ভিন্ন দিক তুলে ধরে, যা দর্শনের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
সারসংক্ষেপে, নদী-সরস্বতী হলো প্রকৃতির এক প্রাণবন্ত নদী, যিনি জীবন-জীবিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি আমাদের দৈহিক ও প্রাকৃতিক পৃথিবীর অংশ। আর বিদ্যা-সরস্বতী হলো মানব মনের আভ্যন্তরীণ দেবী, যিনি বিদ্যা, বাণী ও সৃষ্টিশীলতার প্রেরণা। নদী-সরস্বতী যেমন জীবনের উৎস, তেমনি বিদ্যা-সরস্বতী জ্ঞানের আলো। দু’টি রূপ আলাদা হলেও তারা একে অপরের পরিপূরক। একত্রে তারা ভারতীয় সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি।
এইভাবে আমরা দেখতে পাই, সরস্বতী দেবীর নদী ও বিদ্যার রূপের মধ্যে পার্থক্য মূলত তাদের প্রকৃতি, কাজ ও অস্তিত্বের ক্ষেত্রের ভিত্তিতে। নদী-সরস্বতী আমাদের জীবনের দৈহিক দিককে উর্বর করে, আর বিদ্যা-সরস্বতী মন ও বুদ্ধির দিককে আলোকিত করে। দুই রূপ একসাথে ভারতীয় চেতনার গভীরতা ও বৈচিত্র্যকে প্রকাশ করে।
তথ্যসূত্র –
১. ভারতের হারিয়ে যাওয়া নদী ও সভ্যতা – সুধাংশু সরকার, ২০১০
২. সরস্বতী নদীর অজানা কাহিনি – প্রবীর ঘোষ, ২০১২
৩. ভারতের প্রাচীন জলপথ: সরস্বতী – হিরণ্ময় বসু, ২০১১
৪. সরস্বতী নদীর ইতিহাস ও সংস্কৃতি – রাকেশ শর্মা, ২০১৩
৫. ভারতীয় সংস্কৃতিতে নদীর ভূমিকা – অঞ্জনা মিত্র, ২০১৪

.jpeg)

No comments:
Post a Comment