Thursday, June 5, 2025

পুরাণ থেকে প্রমাণের পথে : সরস্বতী নদী | সঞ্চারী ভট্টাচার্য

|| ব্ল্যাকহোল পত্রিকা || সঞ্চারী ভট্টাচার্য 
পুরাণ থেকে প্রমাণের পথে : সরস্বতী নদী
পর্ব:২


দেবী সরস্বতী নদীরূপে প্রথম কোথায় আবির্ভূত হন?

ভারতীয় আধ্যাত্মিক, পৌরাণিক এবং ভাষাতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের ধারায় দেবী সরস্বতী এক বহুমাত্রিক সত্তা। আজ যাঁকে আমরা জ্ঞান, সঙ্গীত ও বাণীর দেবী রূপে জানি, তিনি আসলে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হন একটি নদী রূপে। এই নদীরূপই তাঁর প্রাচীনতম এবং মূল রূপ। এই নদীরূপে সরস্বতীর প্রথম ও সুস্পষ্ট আবির্ভাব দেখা যায় ঋগ্বেদে। প্রশ্ন হল, এই নদী প্রথম কোথায় আবির্ভূত হয়? কেবল আধ্যাত্মিক বা সাংস্কৃতিক দিক থেকে নয়, ভৌগোলিক ও পুরাণগত দিক থেকেও এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা গুরুত্বপূর্ণ।

ঋগ্বেদে সরস্বতীকে বলা হয়েছে “নদীতমা”, অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ নদী। ঋগ্বেদ ৬.৬১.১–১৩ সূক্তে সরস্বতীকে একটি প্রমত্ত, সজীব, প্রসারিত নদী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে তাঁর প্রবাহের উৎসস্থানের বর্ণনায় বলা হয়েছে—তিনি পর্বত থেকে গড়িয়ে পড়েন এবং সমতলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হন। “সপ্তসিন্ধবঃ” অঞ্চলের মধ্যে সরস্বতীর অবস্থান নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এই সপ্তসিন্ধব অঞ্চলটি বর্তমানের উত্তর-পশ্চিম ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিস্তৃত ছিল—বিশেষত পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং রাজস্থানের একাংশ। এই অঞ্চলেই দেবী সরস্বতী নদীরূপে প্রথম আবির্ভূত হন বলে প্রাচীন বেদীয় সাক্ষ্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

ঋগ্বেদে বারবার “সরস্বতী” নামের সঙ্গে এক প্রবাহমান, ধ্বনিপূর্ণ, প্রমত্ত নদীর প্রতিচিত্র ফুটে ওঠে। এই নদী ‘বৃহৎ ধারা বিশিষ্ট’, ‘সাতটি শাখা যুক্ত’, এবং যার প্রবাহ পৃথিবীর বুক জুড়ে বিস্তৃত। সরস্বতীকে বলা হয়েছে—“ইয়ান্নি গ্রামাণি চ চর্ষণীনাম্‌ ধেনুর্ন শিশে আসমতী ইব” (ঋগ্বেদ ৬.৬১.৯), অর্থাৎ তিনি যেমন জনপদ ও গ্রামপল্লীকে জীবনদায়িনী রূপে প্রবাহিত করেন, তেমনই তিনি দুধেভরা গাভীর মতো স্নেহময়ী। এই বর্ণনায় একটি নদীর প্রতি আরাধনার মধ্যে দিয়ে এক মাতৃরূপ উদ্ভাসিত হয়।

বহু গবেষণায় এই নদীর অবস্থানকে বর্তমান ভারতের ঘঘর নদীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ঘঘর নদী হিমালয়ের শিওয়ালিক পর্বতমালা থেকে উৎপন্ন হয়ে হরিয়ানা ও রাজস্থানের মরু অঞ্চল অতিক্রম করে পাকিস্তানের হাকড়া নদীপ্রবাহে মিশে যায়। আধুনিক ভূগোলবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদেরা মনে করেন, সরস্বতী নদী আদিতে ঘঘর-হাকড়া নদী ছিল, যেটি ক্রমান্বয়ে শুকিয়ে যায়, কিন্তু তার বালির নীচে প্রাচীন নদীখাতের চিহ্ন এখনও বিদ্যমান।

উপগ্রহচিত্র ও ভূগর্ভস্থ জলপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে এই ঘঘর-হাকড়া নদীর উত্স ছিল হিমালয়ের শাখা নদী সরযূ, সুতলজ ও দৃষ্টি নদী থেকে, যেগুলি একত্রিত হয়ে সরস্বতী রূপে প্রবাহিত হতো। এই নদীর উৎপত্তিস্থান হিমালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষ করে যমুনা ও সুতলজের মধ্যবর্তী উচ্চভূমি অঞ্চল। এখানে আজকের আম্বালা, কুরুক্ষেত্র, ক্যাথল, হিষার, স্যারসা অঞ্চলে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে এই অঞ্চলই সরস্বতী নদীর শৈশবভূমি ছিল। অর্থাৎ, দেবী সরস্বতী নদীরূপে প্রথম আবির্ভূত হন হিমালয়ের কোলঘেঁষা এই অঞ্চলেই।

পুরাণে সরস্বতীর আবির্ভাবস্থান সম্পর্কে কিছুটা ভিন্ন আখ্যান পাওয়া যায়। স্কন্দ পুরাণে বলা হয়েছে, সরস্বতী হিমালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে ত্রিলোক প্রবাহিনী রূপে প্রবাহিত হন। আবার, ব্রহ্মান্ড পুরাণে উল্লেখ আছে যে ব্রহ্মার কপাল থেকে সরস্বতী নির্গত হন এবং জলরূপে প্রবাহিত হয়ে ‘ব্রহ্মাবর্ত’ নামে একটি অঞ্চল সৃষ্টির কেন্দ্র হয়ে ওঠে। এই ব্রহ্মাবর্ত অঞ্চলটিকেই আধুনিক গবেষকরা উত্তর ভারতের কুরুক্ষেত্র-হরিদ্বার অঞ্চলের সঙ্গে মিলিয়ে থাকেন। এই ভূখণ্ডই আর্য সংস্কৃতির প্রথম কেন্দ্র এবং সরস্বতীর নদীস্বরূপ প্রথম প্রতিষ্ঠার স্থান।

মহাভারতে এই নদীর একাধিক অবস্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে সরস্বতী কখনও ধৃতরাষ্ট্রের সভায় আলোচনার বিষয়, কখনও বনবাসী পাণ্ডবদের তীর্থস্থান। বিশেষত “সরস্বতী প্রবা”, “ব্রাহ্মণীর ধারা” প্রভৃতি নামধারণ করে তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারতের বহু অঞ্চলে প্রবাহিত হয়েছেন বলে উল্লেখ আছে। মহাভারতের সূত্র অনুযায়ী, সরস্বতী প্রথম আবির্ভূত হন প্লকষ নামক বটবৃক্ষের নিকটে, যা অবস্থিত ছিল হিমালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে, যেখানে আজকের পাঞ্জাব অঞ্চলের মানসা ও সাঙ্গুর শহরের সন্নিকট এলাকায় সরস্বতীর প্রবাহচিহ্ন ধরা পড়ে।

তন্ত্রশাস্ত্রেও সরস্বতী নদীর প্রথম আবির্ভাবস্থানকে এক আত্মিক উৎসের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বীজমন্ত্র ‘ঈঁ’ শব্দধ্বনির আদি-উচ্চারণস্থল যেখানে, সেখানেই সরস্বতী নদীর উৎস। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, মানবমস্তিষ্কে যেখানে চিন্তা ও বাকের উদ্ভব, সেই অঞ্চলই একপ্রকার সরস্বতীর অন্তর্জল উৎস। যদিও এটি আধ্যাত্মিক রূপক, তবে তা ঐতিহ্যের উৎস অনুসন্ধানে গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে।

আধুনিক প্রত্নতত্ত্বে সরস্বতীর প্রথম আবির্ভাবস্থান সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হল—কালিবঙ্গা। এটি রাজস্থানের উত্তরাংশে অবস্থিত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, যেখানে ঘঘর নদীর অববাহিকায় এক বিস্তৃত নগর সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়। এখানে সেচ ব্যবস্থার নিখুঁত প্রমাণ ও নদীঘেঁষা গৃহনির্মাণের চিহ্নে স্পষ্ট বোঝা যায়, এই নদী (সরস্বতী) সেখানে মূল জীবনরেখা হিসেবে কাজ করত। এর আগে হরিয়ানার বানওয়ালি, রকিগড়ি, কুরুক্ষেত্র অঞ্চলেও প্রাচীন সরস্বতী সভ্যতার চিহ্ন দেখা গিয়েছে। এসব অঞ্চল থেকেই সরস্বতীর প্রবাহ শুরু হয়েছিল।

ব্রিটিশ ভূতত্ত্ববিদ স্যার রিচার্ড টেম্পল এবং পরবর্তীকালে রোমিলা থাপার, মাইকেল ড্যানিনো প্রমুখ ঐতিহাসিক গবেষকরা সরস্বতী নদীর আবির্ভাবের স্থান নির্ধারণে বহু প্রাচীন এবং আধুনিক মানচিত্র, জলপথ ও ভূপ্রকৃতির উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন—এই নদীর উৎপত্তিস্থান হিমালয়ের শাখানদীসমূহ দ্বারা সৃষ্ট, এবং তা হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের মধ্যভাগ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রাজস্থান পেরিয়ে সিন্ধুপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হতো। অনেক গবেষণায় তো বলা হয়েছে, এক কালে সরস্বতীর প্রবাহ গঙ্গা-যমুনার থেকেও প্রমত্ত ছিল।

এই নদীর হারিয়ে যাওয়া বা গর্ভগামী হয়ে যাওয়া এক চরম সাংস্কৃতিক প্রতীক। পুরাণে বলা হয়েছে, পাপপ্রভাবে ও যুগের পরিবর্তনে সরস্বতী এক সময় ভূমিগত হয়ে যান। তিনি স্থূল জলধারারূপে আর দৃশ্যমান থাকেন না, বরং অন্তর্জলে, আধ্যাত্মিক বোধে, শব্দের অন্তর্জগতে রূপান্তরিত হন। সেই অর্থে তাঁর আবির্ভাবের স্থান আজও জীবন্ত, তবে তা জলের মধ্য দিয়ে নয়, বরং মানুষের বুদ্ধির, ভাষার ও চিন্তার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত।

সারাংশে বলা যায়, দেবী সরস্বতী নদীরূপে সর্বপ্রথম আবির্ভূত হন হিমালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ থেকে প্রবাহিত হয়ে হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের মধ্য দিয়ে বিস্তৃত অঞ্চলে। এখানেই তিনি ভৌগোলিক বাস্তবতায় জলধারারূপে উদ্ভাসিত, এবং এখান থেকেই পরবর্তীকালে তিনি সংস্কৃতি, ভাষা ও আধ্যাত্মিকতায় রূপান্তরিত হন এক দেবীরূপে।

নদীরূপে সরস্বতীকে কোন দেবী তত্ত্বের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়?

 ভারতীয় ধর্মতত্ত্ব ও আধ্যাত্মিক চিন্তাধারায় দেবী সরস্বতী কেবলমাত্র জ্ঞান, সঙ্গীত ও ভাষার দেবী নন; তিনি আদিতে নদী, এবং সেই নদী-রূপেই তিনি বহু তাত্ত্বিক, দার্শনিক ও উপনিষদীয় ব্যাখ্যার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেন। নদী যখন প্রবাহমান, প্রাণবন্ত, জীবনদাত্রী ও ধ্বনিপূর্ণ, তখন তার মধ্যে এক দেবীস্বরূপ মহাশক্তির অনুভব অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষিতেই প্রশ্ন ওঠে—এই নদীরূপী সরস্বতী আসলে কোন দেবী তত্ত্বের প্রতীক? কেবল প্রকৃতির এক জলধারা, না কি বেদান্ত, তন্ত্র ও শক্তিবাদের গূঢ়তর উপাদানের রূপ?
 
দেবী সরস্বতীর নদী-রূপটি সবচেয়ে পুরনো ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদে উদ্ভাসিত হয়। সেখানে তিনি “নদীতমা”, “অম্বিতমা”, “বেষ্টতমা”—অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ নদী, সর্বশ্রেষ্ঠ মাতা, সর্বোৎকৃষ্ট শক্তি। এই বর্ণনাগুলোর মধ্যেই নিহিত রয়েছে তাঁর বহুমাত্রিক তত্ত্বগত পরিচয়। সরস্বতী সেখানে শুধু ভূগোল নয়, সৃষ্টির এক গতিশীল চেতনা। এই প্রবাহরূপী চেতনা, যা শব্দ, চিন্তা, বুদ্ধি ও আলো জাগায়, তা দেবী তত্ত্বে এক বিশেষ অবস্থান বহন করে। এবং এই অবস্থানকে বোঝার জন্য আমাদের দেখতে হবে তিনটি প্রধান তত্ত্বধারা—বেদান্ত, তন্ত্র, ও শাক্ত দর্শন—যাঁরা সরস্বতীর নদীরূপকে এক বিশেষ প্রতীকী পরিধিতে ব্যাখ্যা করেছেন।

১. আদিশক্তির ‘জ্ঞানের স্রোত’ রূপে সরস্বতী

শাক্ত দর্শনে, বিশেষত ‘শ্রীবিদ্যা’ এবং কুলাচার তন্ত্রে, সরস্বতী নদীরূপে ধরা হন আদ্যাশক্তির এক বিশেষ প্রকাশ হিসেবে। শক্তির তিন প্রধান রূপ—সরস্বতী, লক্ষ্মী ও কালী। এই তিন রূপই প্রাকৃতিক ও মনঃপ্রকৃতিগত গুণের সঙ্গে যুক্ত—সরস্বতী যুক্ত তমোগুণ শুদ্ধিকারী ‘সত্ত্বগুণ’-এর সঙ্গে। নদী সরস্বতী প্রবাহমান জ্ঞান, শব্দ এবং ধ্যানের প্রতীক। নদী যেমন মৃত জমিকে সজীব করে, তেমনি সরস্বতীর নদীরূপ জড়চিত্ত মানবতাকে সজীব, মননশীল ও জাগ্রত করে তোলে। এই প্রবাহ একরকম জ্ঞানশক্তির মহাশক্তি—একেবারে তত্ত্বগত স্তরে।

তন্ত্রশাস্ত্রে বর্ণিত ‘নদী’ বা ‘সরঃ’ শব্দটির আভিধানিক অর্থই হল যা প্রবাহিত হয়। সরস্বতী শব্দের মূল 'স্রু' ধাতু, যার অর্থ প্রবাহ। এই প্রবাহ কেবল জল নয়—এ এক জ্ঞানের ধারা, শব্দের ধারা, চেতনার ধারা। অতএব নদীরূপী সরস্বতী আসলে আদ্যাশক্তির বাকশক্তি রূপ। বেদে বলা হয়েছে, বাক অর্থাৎ বাক্যরূপী শক্তি জগত সৃষ্টি করে। সেই বাক শক্তির স্বরূপই নদী সরস্বতী।

 ২. শব্দব্রহ্ম ও সরস্বতী

উপনিষদীয় দর্শনে শব্দকে ‘ব্রহ্ম’ বলা হয়েছে—‘শব্দ ব্রহ্মণি নিস্রুতম্‌’। নদীরূপে সরস্বতী এই শব্দব্রহ্মের বহমানতা। ব্রহ্মের সৃষ্টি ক্রিয়া শব্দের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। সেই শব্দধারার প্রতীক সরস্বতী। এবং এই শব্দ একদিকে ধ্বনি, অন্যদিকে চিন্তা ও বুদ্ধি। এইভাবে নদীসরস্বতী হয়ে ওঠেন জ্ঞানের আদি-মাধ্যম। তিনি একাধারে ধ্বনি, প্রতিধ্বনি, ধ্যান, মনন—যা গড়ে তোলে মনের নদী।

এই তত্ত্বে নদীসরস্বতী হচ্ছেন মৌলিক শব্দতত্ত্বের জীবন্ত প্রতীক। শব্দ, বাক ও অর্থ—এই ত্রয়ী শক্তির সম্মিলনই নদীসরস্বতীর বর্ণনা। এই তিন শক্তির মিলনে জ্ঞান জন্মায়, সংস্কৃতি গঠিত হয়। তাই উপনিষদ বলেছে—যেখানে বাক ও চিন্তার নদী মিলে যায়, সেখানেই ব্রহ্ম উপলব্ধি সম্ভব।

 ৩. সৃষ্টির সূচনায় জলতত্ত্ব এবং সরস্বতী

ঋগ্বেদ, শিবসংহিতা, এবং অনেক তান্ত্রিক সূত্র অনুযায়ী, জগতে প্রথমত সৃষ্টি হয়েছিল আপঃ—জল। সমস্ত সৃষ্টি সেই জলে ভাসমান ছিল। এই আদিজলরূপেই সরস্বতী প্রতীক হয়ে ওঠেন সৃষ্টির প্রথম পরিবেশ। তাই নদীসরস্বতী কেবল মর্ত্য জগতের বহমান নদী নন, তিনি সৃষ্টির প্রথম স্তরের তত্ত্বরূপী জলরাশিরও প্রতীক।

এই নদী একাধারে আধিভৌতিক জলের প্রতীক, আবার আধ্যাত্মিক চেতনারও ধারক। এই কারণে শাক্ত তন্ত্রে সরস্বতী নদীকে “চিন্ময়ী গঙ্গা” বলা হয়েছে। চিন্ময়ী অর্থাৎ চেতনার নদী—যা দেহ ও মন দুইকেই শুদ্ধ করে।

৪. যোগতত্ত্বে সরস্বতী নদী ও 'সুষুম্না নাড়ী'

যোগশাস্ত্রে মানুষের শরীরের ভিতরে তিনটি প্রধান 'নাড়ী' বা প্রণাশক্তির পথ বর্ণনা করা হয়েছে—ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না। সরস্বতী কখনও কখনও ‘সুষুম্না নাড়ী’র প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হন। যেমন হঠযোগ প্রদীপিকা-তে বলা হয়েছে—‘সরস্বতী নদী’ শরীরের ভিতরে একটি গোপন প্রণাচ্যানেল, যেখান দিয়ে কুণ্ডলিনী শক্তি প্রবাহিত হয়ে মাথার চূড়ায় পৌঁছয়। এই নদী, যা বাইরের জগতের নয়, বরং আমাদের অন্তর্চেতনায় গোপনে প্রবাহিত, সেই নদীই হল একেবারে অভ্যন্তরীণ সরস্বতী।

এইভাবে, নদীসরস্বতী একটি যোগতাত্ত্বিক পথ, যা শরীর থেকে মনের, মন থেকে আত্মার জগতে প্রবাহিত হয়।

৫. পুরাণতত্ত্বে সরস্বতী—স্থূল থেকে সূক্ষ্মের যাত্রা

পুরাণে সরস্বতী নদী প্রথমে স্থূলজলে প্রবাহিত হন। পরবর্তীতে তিনি অন্তর্হিত হন মাটির নীচে। এই গর্ভগমন একেবারে দার্শনিক স্তরে এক বিশেষ অর্থ বহন করে—জ্ঞানচেতনা বা বাকশক্তি যখন বাইরের জগতে ধরা দেয় না, তখন তা ভিতরে ডুবে যায়, অন্তর্মুখী হয়। অর্থাৎ, নদীরূপ সরস্বতী হলেন স্থূল থেকে সূক্ষ্মের যাত্রার প্রতীক।

এই দৃষ্টিতে সরস্বতী হলেন 'অলিখিত উচ্চারণ' বা পরাবাক। শব্দের চারটি স্তর বলা হয়—পরা, পশ্যন্তী, মধ্যমা, বৈখরী। বৈখরী মানে উচ্চারিত শব্দ, মধ্যমা মানে ভাবনা, পশ্যন্তী মানে ইচ্ছা, আর পরা মানে নির্জন, নিরাকার শব্দতত্ত্ব। নদীসরস্বতী এই পরা শব্দের রূপ, যা আমাদের চিন্তা ও প্রাণশক্তিকে বহন করে নিয়ে যায় উচ্চতর উপলব্ধির দিকে।

৬. নদীসরস্বতী ও 'স্মৃতি-সংস্কৃতি'র ধারা

নদীসরস্বতী কেবল এক প্রকৃতির স্রোত নয়, তিনি এক সাংস্কৃতিক ধারার প্রতীক। ভারতীয় সংস্কৃতির বহু আদি সভ্যতা, যেমন হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়ো, কালীবঙ্গা, বানওয়ালি—এসবই সরস্বতী নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল। সেই অর্থে এই নদী হলো সংস্কৃতি, স্মৃতি ও সভ্যতার ধারক। দেবী সরস্বতী তাই ইতিহাসের গভীরতম স্তরে জ্ঞান, শিল্প, কৃষি, সভ্যতা ও ধর্মের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন।
 
এই প্রেক্ষাপটে নদীসরস্বতী হলেন ‘ধারা’র প্রতীক—যা ছিন্ন হয় না, যা বহমান।

দেবী সরস্বতী নদীরূপে প্রতীক রূপে প্রকাশ করেন জ্ঞানের প্রবাহ, বাকশক্তির গতিময়তা, শব্দতত্ত্বের গভীরতা, চেতনার উন্নয়ন, এবং স্মৃতির ধারাবাহিকতা। তিনি শুধু একটি মাটির উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া জলধারা নন, তিনি সময়, সংস্কৃতি, মনন, ও মরমী জগতের প্রতিচ্ছবি। সেই জন্য নদীসরস্বতী হলেন তত্ত্বগতভাবে—


জ্ঞানের আদি উৎস
চেতনার প্রবাহ
বাক ও ধ্বনির প্রতিমা
অন্তর্জগতের আত্মা
সৃষ্টি ও স্মৃতির ধারাবাহিকতা

অতএব, নদীরূপী সরস্বতী কেবল ভূগোলের বিষয় নন; তিনি ভারতীয় মননের সবচেয়ে গভীর, সূক্ষ্ম এবং বহমান দেবী তত্ত্বের এক শ্রেষ্ঠ রূপ।

 

 

তথ্যসূত্র –

১. ভারতীয় সংস্কৃতিতে সরস্বতীর স্থান – ড. লক্ষ্মীনারায়ণ মিশ্র, ১৯৯৭

২. সরস্বতী নদী ও হরিয়ানা – প্রবীণ চৌধুরী, ২০০০

৩. ভারতের হারানো জলস্রোত – প্রণব মুখোপাধ্যায়, ২০০২

৪. সরস্বতী: নদী এবং সভ্যতা – ড. বিভাস ঘোষ, ১৯৯৬

৫. পুরাতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে সরস্বতী – অশোক বর্মণ, ২০০৪



Wednesday, May 28, 2025

পুরাণ থেকে প্রমাণের পথে : সরস্বতী নদী | সঞ্চারী ভট্টাচার্য

|| ব্ল্যাকহোল পত্রিকা ||সঞ্চারী ভট্টাচার্য 
পুরাণ থেকে প্রমাণের পথে : সরস্বতী নদী
পর্ব:১


মা সরস্বতীর কতগুলি রূপ পাওয়া যায় শাস্ত্রে?

 

শাস্ত্রসমূহে মা সরস্বতীর একাধিক রূপ পাওয়া যায়। এই রূপগুলি ভৌগোলিকআধ্যাত্মিকদার্শনিকতান্ত্রিক ও প্রতীকী ব্যাখ্যার ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে পরিলক্ষিত হয়। সরস্বতী কেবলমাত্র বিদ্যার দেবী ননতিনি জ্ঞানশব্দভাষাবুদ্ধিসঙ্গীতকবিতানদী এবং শক্তির প্রতীকও। তাঁর রূপসমূহ সময়ের সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে এবং ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিফলিত হয়েছে।

 

প্রথমতবেদের মধ্যে সরস্বতীকে একটি নদী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ঋগ্বেদে তিনি একটি বিশেষ পবিত্র নদীরূপে বর্ণিতযিনি সাতটি নদীর মধ্যে প্রধান এবং যাঁর মাধ্যমে প্রাচীন আর্য সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। বেদে এই নদী শুধুমাত্র ভৌগোলিক নয়বরং জ্ঞানের ধারাকে প্রতীকীভাবে বহন করে। এই নদীরূপ সরস্বতীকে বলা হয়েছে 'সরদ্ ধারাবা 'সপ্তস্বতী', যা সাতটি প্রকারের জ্ঞানের প্রবাহ নির্দেশ করে।

 

ঋগ্বেদ ছাড়াও যজুর্বেদসামবেদ ও অথর্ববেদে সরস্বতীকে বাক্‌দেবী তথা ভাষার দেবী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে তিনি পরম ধীশক্তিযিনি ভাষাকে প্রকাশ করতে সাহায্য করেন। বাক্‌দেবীর চারটি রূপ শাস্ত্রে নির্ধারিত: পরাপশ্যন্তীমধ্যমা ও বৈখরী। এই চার স্তরের বাক্‌সমূহ মানুষের অন্তর্লোক থেকে বহির্জগতে ভাষারূপে প্রকাশ পায়। পরা বাক্‌ ব্রহ্মচৈতন্যের সঙ্গে যুক্তপশ্যন্তী হচ্ছে অন্তর উপলব্ধ ধ্বনিমধ্যমা বাক্‌ মানসিক স্তরের ভাষা এবং বৈখরী বাক্‌ শ্রবণযোগ্য ধ্বনি।

 

উপনিষদে সরস্বতী মূলত ব্রহ্মজ্ঞানের মাধ্যমরূপে দেখা দেন। তিনি ব্রহ্মার বাম অংশ থেকে উৎপন্নতাই তাঁকে ব্রহ্মপত্নী বলা হয়েছে। সরস্বতী এখানে জ্ঞানের উৎসশব্দের আধার এবং সচেতনতার প্রকাশ। বামদেবীয় উপনিষদ ও মাণ্ডূক্য উপনিষদে বাক্‌ বা ধ্বনির মাধ্যমে আত্মার উপলব্ধির কথা বলা হয়েছেযেখানে সরস্বতীই এই ধ্বনির রূপে বিরাজমান।

 

পুরাণসমূহে সরস্বতীর রূপ আরও বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে। ব্রহ্মান্ড পুরাণস্কন্দ পুরাণশিব পুরাণদেবী ভাগবত ও পদ্ম পুরাণে সরস্বতী কখনও শান্তশ্রীদায়িনীকখনও রুদ্রাণীকখনও ত্রিদেবীর অন্যতমা মহাশক্তিরূপে উপস্থিত। দেবী ভাগবত পুরাণে তিনি আদ্যাশক্তিতাঁর রূপই ললিতাদুর্গাকালী ও সরস্বতী। শিব পুরাণে তিনি ব্রহ্মার মানসকন্যাআবার কখনও তাঁর পত্নী। কোনো কোনো পুরাণ অনুসারে সরস্বতী রুদ্রের শক্তিরূপে আবির্ভূতাযাঁর দ্বারা সমস্ত শব্দতত্ত্ব ও উচ্চারণ শুদ্ধ হয়। ব্রহ্মার চার মুখ থেকে চার বেদ যেমন নির্গত হয়েছেতেমনি সরস্বতীর মুখ থেকেও জ্ঞানের ঝর্ণাধারা প্রস্ফুটিত হয়েছে। পুরাণে সরস্বতীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ হল শ্বেতবসনা’—যিনি হাতে বীণাপুস্তকজপমালা ধারণ করেন ও রাজহংসে বিরাজমান।

 

তন্ত্রশাস্ত্রে সরস্বতী একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শক্তির রূপ। তিনি এখানে শুধুমাত্র বিদ্যার দেবী ননবরং একটি জীবন্ত মন্ত্রময়ী চেতনা। সরস্বতীর তান্ত্রিক রূপগুলির মধ্যে অন্যতম হল 'বাগ্লামুখীও 'ত্রিপুরাসুন্দরী'-র সহচরী। তন্ত্রে তিনি বীজমন্ত্রের মধ্যেও বাস করেন। যেমন—'ऐं' (ঐং) হল সরস্বতীর বীজমন্ত্রযা জ্ঞানবৃদ্ধিবাগ্‌সিদ্ধি ও অন্তর্দৃষ্টি প্রস্ফুটনের জন্য ব্যবহৃত হয়। তন্ত্রসারে মা সরস্বতী দশ মহাবিদ্যার অংশ নন ঠিকইকিন্তু তন্ত্রচর্চার জন্য অপরিহার্য। অনেক তান্ত্রিক মত অনুসারে তিনিই বীজজ্ঞান ও জপের অন্তর্গত সত্তা।

 

লোকসংস্কৃতি ও গ্রামীণ ধর্মাচরণেও মা সরস্বতীর নানা রূপ পাওয়া যায়। বাংলায় তাঁকে 'বসন্তপঞ্চমীর দেবীহিসেবে পূজা করা হয়যেখানে তাঁর প্রতীক হল খড়ের তৈরি পট বা হংসবাহিনী রূপ। রাজস্থানে তাঁকে 'চারবাহুরূপে দেখা যায়যেখানে তাঁর হাতে থাকেন কলমকিতাবসঙ্গীততন্তু ও মালা। দক্ষিণ ভারতে তিনি 'শারদানামে পরিচিতআর কর্ণাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশে 'সরস্বতী হোমও 'আক্ষরাব্যাহানামক রীতি প্রচলিত আছেযেখানে শিশুদের বিদ্যার সূচনা সরস্বতীকে উৎসর্গ করে হয়।

অনেক স্থানে সরস্বতীকে রুদ্রাণী বা কালী রূপেও কল্পনা করা হয়েছেযেখানে তিনি শুধু শুভ্র ননকখনও রক্তবর্ণাও। কাশ্মীরের একাধিক তান্ত্রিক গ্রন্থে সরস্বতীকে ত্রিনেত্রা ও দশভুজা হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই রূপে তিনি ভাষার স্রষ্ট্রী এবং ধ্বংসকারিণী একত্রে।

 

সংগ্রহ করলে মা সরস্বতীর শাস্ত্রসম্মত রূপগুলি এভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়:

 

১. নদীরূপে – ঋগ্বেদ অনুসারেসাত তীরবাহিত এক পবিত্র নদী।

২. বাক্‌দেবীরূপে – ভাষা ও ধ্বনির প্রতীকচারস্তরীয় বাক্‌তত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত।

৩. জ্ঞানের দেবীরূপে – বেদ ও উপনিষদ অনুযায়ী চৈতন্য-জ্ঞানের আধার।

৪. ব্রহ্মপত্নীরূপে – পুরাণে ব্রহ্মার শক্তিস্বরূপা।

৫. শ্বেতবসনা ও বীণাবাদিনী রূপে – শিক্ষাসঙ্গীত ও শিল্পকলার অধিষ্ঠাত্রী।

৬. তান্ত্রিক রূপে – বীজমন্ত্রের আধারশক্তিরূপিণীত্রিনেত্রা ও দশভুজা।

৭. লোকরূপে ও উপজাতীয় প্রতিমায় – আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের প্রতিফলন।

৮. সিদ্ধিদাত্রী ও বাগ্‌সিদ্ধি দায়িনী – সাধনা ও মন্ত্রচর্চার ক্ষেত্রে অন্যতম।

৯. রুদ্রাণীরূপে – শিবতত্ত্বের সহচরীশব্দতত্ত্বের সংহারিণী রূপে।

১০. ধর্মদর্শন ও সংগীতের রূপে – সমস্ত শাস্ত্রকলা ও বিজ্ঞানরূপী চেতনার উৎস।

 

এইসব রূপ আলাদা আলাদা হলেও তারা এক মূলতত্ত্বের দিকে ইঙ্গিত করেসেই মৌলিক জ্ঞানচেতনাযা ভাষার ভিতর দিয়ে প্রকাশিত হয়সৃষ্টির ভিতর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং সাধনার ভিতর দিয়ে উপলব্ধ হয়। মা সরস্বতী সেই চেতনার বহুমাত্রিক প্রকাশ। তাই তাঁকে গণনা করা যায় না কেবলমাত্র সংখ্যায়কারণ তিনি সংখ্যার অতীতবর্ণের অতীতএবং রূপেরও অতীত। তবুযেহেতু মানুষ রূপের ভেতর দিয়ে চিন্তা করেতাই এই রূপগুলি আমাদের অন্তর্দৃষ্টিকে প্রসারিত করেআত্মিক অনুসন্ধানকে শক্তি জোগায়।


সরস্বতীর কোন রূপটি নদীরূপে চিহ্নিত?

 

মা সরস্বতীর উপাসনা ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান ধারার মধ্যে পড়েতবে আজ যাঁকে আমরা শিক্ষাসংগীতবিদ্যা ও ভাষার দেবী বলে জানিসেই সরস্বতী এক কালে প্রথমত পরিচিত ছিলেন একটি নদী হিসেবে। এই রূপটি সর্বপ্রথম এবং সর্বাধিক গুরুত্বসহকারে পাওয়া যায় ঋগ্বেদে। তাঁর নদীরূপটি শুধু ভৌগোলিক নয়বরং আধ্যাত্মিকসাংস্কৃতিক ও ভাষাতাত্ত্বিক ইতিহাসের অন্যতম মূল আধার। এই রূপটিই হল মা সরস্বতীর প্রাচীনতমমৌলিক ও সর্বাপেক্ষা বিস্তৃত প্রতীক।

 

ঋগ্বেদের প্রায় ৭২টি মন্ত্রে সরস্বতীর নাম উল্লেখিত হয়েছে। এর মধ্যে বহু ক্ষেত্রে তিনি নদী হিসেবে চিহ্নিত। বিশেষ করে ঋগ্বেদ ৬.৬১ সূক্তে সরস্বতীকে একটি জলপ্রবাহঅর্থাৎ নদী বলা হয়েছে – “ইমাম্‌ মে গঙ্গে যমুনে সরস্বতী শুতুদ্রে স্তোমম্‌ সচ্ছতা পরূষ্ণ্য। এখানে গঙ্গাযমুনা ও সরস্বতীকে পাশাপাশি উচ্চারিত করা হয়েছেযা নদীরূপে তাঁকে গঙ্গা ও যমুনার সমপর্যায়ে স্থাপন করে। এছাড়া ঋগ্বেদ ১০.৭৫-তে নদীসূক্ত’ নামে পরিচিত একটি সম্পূর্ণ সূক্ত রয়েছেযেখানে দশটিরও বেশি নদীর নাম রয়েছে এবং সরস্বতীকে সেখানে নদীনাম্‌ শ্রেষ্ঠা বলা হয়েছে।

 

এই নদী শুধুমাত্র একটি জলপ্রবাহ নয়বরং ঋগ্বেদীয় আর্য জীবনের প্রাণরেখা। সরস্বতী নদী প্রাচীন ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রবাহিত হতো বলে মনে করা হয়বিশেষত বর্তমানে হারিয়ানাপাঞ্জাব ও রাজস্থান অঞ্চলজুড়ে। বহু গবেষণা ও উপগ্রহচিত্র পর্যালোচনায় প্রমাণ মিলেছে যে, ‘ঘঘর-হাকড়া’ নামে যে শুকনো নদীর ধারা পাকিস্তান ও ভারতের মরুভূমি অঞ্চলে দৃশ্যমানসেটিই প্রাচীন সরস্বতীর ধারা হতে পারে।

 

ঋগ্বেদের মতেএই নদীর উৎস ছিল হিমালয় থেকে এবং এর জলধারা ছিল অত্যন্ত প্রবাহমানসজীব ও উর্বর। তাঁকে বলা হয়েছে – “সপ্তস্বতী” অর্থাৎ সাতটি ধারা বিশিষ্ট নদী। আবার অম্বিতমে নদীতমে দেবীতমে সরস্বতী” – এই শ্রুতিতে তাঁকে বলা হয়েছে স্নেহময়ী মাসর্বশ্রেষ্ঠ নদী এবং দেবীএই তিন রূপে একত্রিত প্রতীক।


এই নদীরূপে সরস্বতী কেবল শারীরিক বা ভৌগোলিক উপস্থিতি নয়বরং প্রাচীন ঋষিরা তাঁর মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন এক ধারাএক জ্ঞানস্রোতযা মানবজীবনে ভাবভাষা ও ধ্যানের রস এনে দেয়। তাঁর নামের অর্থই হল – ‘সরঃ’ অর্থাৎ প্রবাহ ও স্বতী’ অর্থাৎ স্বতঃস্ফূর্ত। সেই অর্থে সরস্বতী মানেই যিনি নিজের থেকে প্রবাহিত হন। এই প্রবাহ শব্দেরবাক্‌শক্তিরজ্ঞানের এবং ধ্যানের।

 

মার্কণ্ডেয় পুরাণবিষ্ণু পুরাণ ও ব্রহ্মান্ড পুরাণেও সরস্বতী নদীর উল্লেখ পাওয়া যায়। বিষ্ণু পুরাণে বলা হয়েছেএই নদী হিমালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে ব্রহ্মাবর্ত অঞ্চলে প্রবাহিত হত এবং পরে রজতপর্বতের মধ্যে আত্মগোপন করে। এই আত্মগোপন করাকে মহাকালগত ব্যাখ্যায় ব্যাখ্যা করা হয়একদা যে জ্ঞানযে ভাষা সমাজকে আলোকিত করতকালের প্রবাহে তা অন্তর্হিত হয়ে পড়ে।

 

মহাভারতের ভীষ্ম পর্বে স্পষ্টভাবে সরস্বতী নদীর অবস্থান ও গুরুত্বের কথা বলা আছে। সেখানে পাণ্ডবরা সরস্বতীর তীরে তপস্যা করেন এবং বহু ঋষি এই নদীতীরকে আশ্রম স্থাপনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন। নদীটি তখনও প্রবাহমান ছিলযদিও কিছু কিছু স্থানে তার জলধারা ক্ষীণ হয়ে পড়েছে বলেই বর্ণনা।

 

জৈন গ্রন্থাবলিতেও সরস্বতী নদী উল্লেখিত হয়েছেযদিও সেখানে তাঁর নদী ও দেবীরূপের সংমিশ্রণ খুব সীমিত।

 

পরবর্তীকালে এই নদীর ধারা হারিয়ে যায় বা ভূগর্ভস্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রতীকার্থে সরস্বতী রয়ে যানকখনও গঙ্গার মধ্যেকখনও ত্রিবেণী সঙ্গমে অদৃশ্য তৃতীয় নদী’ হিসেবে। এই ত্রিবেণী সঙ্গমেযেখানে গঙ্গা ও যমুনা মেলেছেসেখানে বলা হয়, ‘সরস্বতী গুহ্যভাবে প্রবাহিত’—অর্থাৎ তিনি আর দৃশ্যমান ননকিন্তু তলে তলে রয়েছেন। এই অন্তর্হিতা সরস্বতী’ হলো আধ্যাত্মিক প্রতীকযে জ্ঞান দৃশ্য নয়কিন্তু উপলব্ধির জন্য অপেক্ষমাণ।

 

তন্ত্রশাস্ত্রেও নদীরূপে সরস্বতীকে চর্চা করা হয়েছে। বিশেষতনদীর প্রবাহ ও বীজমন্ত্রের ধ্বনির মধ্যে এক সাদৃশ্য খুঁজে পেয়ে বলা হয়েছে, 'যে নদী অন্তরে প্রবাহিতসেই সরস্বতীই প্রকৃত তন্ত্রময়ী'। এই তত্ত্ব অনুসারেসরস্বতী নদীই শব্দতত্ত্বের উৎসঅর্থাৎ ধ্বনির যে উৎসতা-ও একধরনের প্রবাহ এবং সেই ধ্বনিই মন্ত্রের রূপে প্রতিষ্ঠিত।


আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানও এই নদীর অস্তিত্বের পক্ষে অনেক প্রমাণ এনেছে। ২০০২ সালে ইসরো ও জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া যে উপগ্রহচিত্র সংগ্রহ করেতাতে স্পষ্টভাবে একটি বৃহৎশুকিয়ে যাওয়া নদীর শুষ্কপথের চিহ্ন ধরা পড়েযা ঘঘর নদীর সঙ্গে মিলে যায়। বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনযেমন হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতার উপকরণকেশেতুবানওয়ালিকালিবঙ্গা প্রভৃতি স্থানেও এই নদীস্রোতের সঙ্গে সংযুক্ত নগরভিত্তিক বসতির প্রমাণ মেলে। এর অর্থসরস্বতী নদী শুধু ধর্মগ্রন্থেই নয়সভ্যতার গঠনতেও প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।

 

তবে এই নদীরূপটি ক্রমশ লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেলেও তার প্রতীকমূল্য কখনও মুছে যায়নি। মা সরস্বতী আজ দেবী হিসেবে পূজিতা হলেওতাঁর নদীরূপে স্মরণ আজও তীর্থক্ষেত্রেমন্ত্রেআশ্রমে ও আধ্যাত্মিক সাধনায় প্রতিফলিত হয়। একদিকে তিনি দৃশ্যজগতের গঙ্গা ও যমুনার মাঝখানে অদৃশ্য’, অন্যদিকে তিনিই অন্তর্দৃষ্টিঅন্তর্জ্ঞান ও মৌনবাক্‌রূপে প্রবাহিত।

 

এইরকমভাবে মা সরস্বতীর নদীরূপটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে জ্ঞান একটি প্রবাহযা স্থির নয়এক স্থানভিত্তিক নয়বরং সে গতিশীলসজীবকখনও প্রকাশমানকখনও অন্তর্হিত। এই প্রবাহ কখনও শোনার মতোকখনও উপলব্ধির মতোকখনও শুধুই অনুভবের মতো।

 

সুতরাংশাস্ত্রে সরস্বতীর যে নদীরূপ চিহ্নিততা কেবল এক ভৌগোলিক স্মৃতি নয়তা ভারতীয় চেতনায় এক মৌলিক ও চিরন্তন স্রোতযা যুগে যুগে প্রকাশ পেয়েছে ভাষাবাক্‌সঙ্গীত ও সাধনার মধ্যে দিয়ে। তিনি যে নদীসেই নদীই আজ বাক্‌দেবীআর সেই বাক্‌ই আবার আমাদের কাছে হয়ে উঠেছে ব্রহ্মতত্ত্বে পৌঁছবার সেতু।


তথ্যসূত্র –

 

১. সরস্বতী নদী: ইতিহাস ও পুরাণ – ড. শিবপ্রসাদ চক্রবর্তী১৯৮৫

২. ভারতের হারানো নদী: সরস্বতী – বিভূতিভূষণ সেনগুপ্ত১৯৯২

৩. সরস্বতী ও বাণীপুরাণ – প্রফুল্ল চন্দ্র দত্ত১৯৭৮

৪. ভারতের জলপথ: সরস্বতী নদীর গৌরব – অমরেন্দ্র কুমার দাস২০০১

৫. পুণ্যসরস্বতী: নদীসংস্কৃতি ও লোককথা – হেমন্ত মুখার্জী১৯৯৯

৬. ভারতের হারিয়ে যাওয়া নদীগুলো – ড. অনিলকুমার রায়২০০৫

৭. সরস্বতী নদীর ভৌগোলিক ইতিহাস – ড. মধুসূদন বসু১৯৯০

৮. বৈদিক ভারতের নদী ও সরস্বতী – স্বর্ণলতা সেন১৯৯৪

৯. সরস্বতী নদী: পুরাণ থেকে বিজ্ঞান – রবি চন্দ্র ঘোষ২০০৩

১০. নদীর দেবী সরস্বতী – কুমুদ রায়১৯৮৮


 

Thursday, May 1, 2025

ষাটের যুবক | অনুরূপা পালচৌধুরী

|| ব্ল্যাকহোল পত্রিকা ||অনুরূপা পালচৌধুরী || ২য় পর্ব



ষাটের যুবক,

আমার শব্দ বরাদ্দ উপবাস আপনার প্রিয় শহরের দেয়াল লিখন। নেশাহীন লাল পতাকার গভীরে ভারী হয়ে আসা কথারা থতমত বাড়ীর খড়কুটো আঙুলে হেঁটে বেড়ায় ১ নাগরিকঘন বিষন্নতা।   মনে পড়ে যায় আপনার এলোমেলো আঙুল বিক্রির ফতোয়া। উচ্চারিত চেতনার ফোঁটা ফোঁটা জলে আমি পাঠাচ্ছি আপনাকে হাঁসের পালকে প্রশস্ত নিউরোণ রঙের ধবধবে দাঁতের হাঁসফাঁস। আমায় স্বেচ্ছামৃত্যুর পরোয়ানা জারি করলেন অথচ আজীবন ভালোবাসার ক্ষতবিক্ষত কলমে আত্মহত্যার বিপ্লব নিভে যাচ্ছে পায়ের পাতার ফলকে। পরিযায়ী ঠিকানা সরিয়ে বুনিয়াদি বিকেল লিখে দিলেন আর মানসী তখন মুন্সি অথবা মুনস্ কিংবা দুহাতে সরব হত্যার গোলামে হৃৎপিণ্ড পুড়িয়ে দিলো সস্তার ভাত-বালিশে।

আমি তো কবি হতে চাইনি যুবক! যুবকত্বের চৌকাঠ পেড়িয়ে শুধু হাতা-খুন্তির টুং-টাঙে না হয় শয়ে শয়ে কবিতার ফসিল হয়েই আপনার অভ্যেসের জল,মাটির বারুদমাখা এঁটো প্রলাপের চড়াই বোনা সকাল সাজতাম। অথচ আপনি তীব্র ভর্ৎসণায় ছুঁড়ে ফেললেন আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। তীব্র নোনা ঢেউয়ে ভিজে যাওয়া আমাকেই আবার বুকে রাখলেন আর আমি খুলে ফেললাম অজস্র শব্দের জমে যাওয়া নীলনদ। আমার ষাটের যুবক! নিদারুণ চোখের সুতোয় অবসরমাখা দুপুরগুলিতে পায়ে পায়ে পালটে যায় তর্জনী থেকে মধ্যমা। তখন উৎসবের আলোতে গলে যায় উল্লাসের মেঘসম্ভাব্য ক্ষয়মুখ। কথার পাশে শুয়ে থাকা ডানার স্তাবক প্রজাপতি কিংবা ব্রহ্মা কোনোটাই নয়।

শুধু যাকিছু ব্যক্তিগত উপান্ত যুবক
নির্বাসিত কোনো ১নদী ভাবো 
ছায়া হয়ে ছিঁড়েছো আলোর নুপুর 
এসো হে গভীর কলমের ক্রীতদাস
তবু আমি ১ সহজ কোলাজ______


                                    ইতি
                     জন্মান্ধ কুয়াশার পুনর্জন্ম



রাণাঘাট
১৮/৪/২০২৫


Wednesday, April 23, 2025

II ষাটের যুবক II অনুরূপা পালচৌধুরী

|| ব্ল্যাকহোল পত্রিকা || অনুরূপা পালচৌধুরী: প্রথম পর্ব



ষাটের যুবক,

ভেবেছিলাম আর কোনো চিঠিবৃত্তই আপনার পাঠক্রম ঘেমে মায়াবী হাত হবে না। যারা বলেছিলো, আজীবন ভালোবাসার অর্থনৈতিক মন্দার কথা সেখানে যুবকত্বের অমরত্ব প্রতিষ্ঠায় জোনাকি রঙের নির্জন ক্ষেত্রফল উঠছে আকাশ জুড়ে। ভুলে যাওয়া ১ উপবাসী অপরাধ যে অপরাধে ভালো আছির ঠিকানায় যানজট লেগে যায় ক্রমাগত। অবসাদের ঘড়ি বেয়ে দু-একটা চোখের দাগ আপনার প্রিয় দিন। বিজয়গড়ের উল্লাসিত পতাকার পদার্পন ঘেটে আজো উড়ে যাচ্ছে কোনো ১দেহাতি সন্ধ্যা জমানো জীবনদানি থেকে উঠে আসা না বলা যাবতীয় উপকূলের বকেয়া ডালপালা। আমি তো জানি কেমন থাকার প্রশ্নউত্তর! একাকীত্বের আল্পনায় আস্ত বৃক্ষস্রোত, যার জানলায় নৌকা চিহ্নের যুবকবন্যা বাঁধা থাকে।

আমার ষাটের যুবক, আজকাল অনেকটা সূর্য ভেজা পিরামিড মনে হয় আপনাকে। আজো নীল ছবির জিহবা কুড়িয়ে নিচ্ছেন ঝিনুকের আঁচর অথচ আঙুলে ১খন্ড কুয়াশার ক্ষয়। জানি, চিঠি ভেবে ভুল করবেন না তবু বলি, বেশ আলো অন্ত অগছালো মানসী বিভাগের বীজমন্ত্রে আগুনশোক দাহো হলো। ঘরভর্তি বয়সের চিলেকোঠায় চড়াই পোষা কাব্যজল।  আপনি সমারোহে ঘর ঘর গন্ধটা তীব্র হচ্ছে। ইঁট বালির ফাঁক ফোঁকরে লেগে যাচ্ছে মায়াহীন এক জ্বর। অবিকল আয়নার বিপরীতে ঠোঁট, চোখ, মুখ, জিভের গন্ধগুলো আর আলাদা করা যাচ্ছে না। বহুদিনপর দেখলাম আমার সেই ব্যাথার গন্ধরা আজো স্বচ্ছ কীটের মতোই উদ্যোগী। জানেন তো, অসমাপ্ত দেওয়ালের ওপারে যে দেওয়াল বোনা হয় তাতে বসন্তের ছায়া লুকিয়ে যায়। 

পুনশ্চঃ কোনো বেহালাদীপ্ত আগুনের অন্ধকারে সহস্র সংখ্যার এপাড় থেকে কোনো উত্তম পুরুষ কখনো শতাব্দীর সিংহাসনের দাবীদার হতে পারেনি।
 
                               ইতি 

              জন্মান্ধ কুয়াশার পুনর্জন্ম


রাণাঘাট
২১/০৩/২০২৫


Sunday, March 30, 2025

কবিতার ডালপালা

|| ব্ল্যাকহোল পত্রিকা || অরিজিৎ চক্রবর্তী

কবিতার ডালপালা
অষ্টম পর্ব                                                                                         

নিলস বোর বলতেন, অপোজিট টু এ গ্রেট ট্রুথ ইজ অলসো আ ট্রুথ৷ প্রতিটি মহাসত্যের বিপরীতেও একটি সত্য আছে৷ বিজ্ঞানজগতে এই সত্যাসত্যের সংঘাত মানুষের কাছে চিরন্তন আকর্ষণের বিষয়৷ তারই মধ্যে উঁকি মারে সেই অমোঘ প্রশ্ন- সবকিছুর ভিড়ে মানুষের ভূমিকা কী? মানুষী যে সাফল্যকে মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মনে হয়েছিল, ‘দি মোস্ট ইনকমপ্রিহেনসিবল থিং ইন দিস ইউনিভার্স ইজ দ্যাট ইট ইজ কমপ্রিহেনসিবল৷’ একদিকে বিশ্ব-চরাচরের রহস্যময়তা, অন্য দিকে সেই প্রহেলিকা সমাধানে মানুষের এই নিত্য সাধনাই আমাদের সপ্রাণ, চলমান, আনন্দঘর ! বাহ্যিক অনেক বদলের পরও, মনের মধ্যে সেই একই ধারা বয়ে চলে, জীবনের সেই অখন্ডতা অব্যাহত রাখতে পারাই হয়তো একজন স্রষ্টার কাছে, পৃথিবীর সব ছেঁড়া তার থেকে বেরিয়ে আসা মনোলীন সিম্ফনি। কবি অমৃতা ভট্টাচার্যের "নগ্ন, আনন্দঘর" পড়তে পড়তে আমার এমনটাই মনে হয়েছে বারংবার। কিন্তু কেন? মনে হয়েছে বললাম কেন? বিশ্বাস হয়েছে বলাটা কি সঙ্গত ছিল না? না। ছিল না। কারণ, কবিতায় সঙ্গত বিশ্বাস বলে কিছু হয় না। যেকোনো শিল্প মাধ্যমেই নির্মাণের ভিন্নতা, মূলত চেতনারই পরিবর্তন। চেতনা বদলেই পালটে যায়, দেখার জগৎ ও প্রকাশভঙ্গী । তাবৎ বিশ্বে সব কিছুই কবিতার বিষয় বস্তু হতে পারে । এই দৃষ্টিভঙ্গিকে কেন্দ্র করে বাস্তব ও অবাস্তবতার আলো আঁধারির চেয়ে ঘটার সম্ভাবনার মধ্যেই বাস্তবতার দেখতে চাইছেন । ফলে ভাষাবদলের কবিতা নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা বাড়ছে । 

" হোক থির, টলটল হোক, জরায়ু ঘোর ঘোর

   দ্যাখো নাভির নীচে জোড়া জোড়া জোড়া

   সব দেওয়া আর ফেরত

   চাঁদ... ঈগল...ডানা দ্বীপ ডানা..."  ( প্রতি অঙ্গ মোর )

কবিতার চলনে অতীত বর্তমান মিশে এক অদ্ভুত আত্মনিরীক্ষা। ভাষা ও চিত্রকল্পের অবয়বে যেন যাবতীয় নির্বাণ ও নৈকট্য। অনুভূমিক কান্ডের মতো নানা চিত্ররূপ থেকে একটার পর একটা অনুযোগ গড়ে তোলে যে জাদুবাস্তবতা তা অনির্ণেয় অথচ আকাঙ্খিত। তাই " ঘোর ঘোর" আর " জোড়া জোড়া" এই শব্দদুটির দ্বিমাত্রিক ব্যবহারে বহুমাত্রিক সম্ভাবনার আভাস দিতে দিতে কবি মনে করিয়ে দিচ্ছেন কুণ্ডলিনী জাগরণের অমোঘ লক্ষণ হল নাদের স্ফূরণ। নাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে বিন্দু ও কলাতত্ত্ব। জগতের সৃষ্টি প্রণালীর বিবরণ প্রসঙ্গে সারদাতিলকে লেখা আছে---

"সচ্চিদানন্দবিভবাৎ সকলাৎ পরমেশ্বরাৎ।

আসীৎ শক্তিস্ততো নাদস্ততো বিন্দুসম্ভুদ্ভবঃ।।"

এই বিবরণ থেকে আদি সৃষ্টির যে ক্রম পাওয়া যায়, তা থেকে জানা যায় যে, সৃষ্টির আদিতে স-কল পরমেশ্বর থেকেই সৃষ্টির বিকাশ ঘটেছে।'স--কল' বলতে 'কলাসহিত'--- এটাই বুঝতে হবে। আবার 'কলা'শব্দের অর্থ শক্তি। এই স--কল পরমেশ্বর থেকে অবতরণক্রমে শক্তিতত্ত্বের বিকাশ হয়ে থাকে। কবি কি তেমনই কোনো বিকাশের প্রত্যাশী ? তাই "সব দেওয়া আর ফেরত" এর প্রতি তাঁর নির্বাণগামী সোপানের ধারা ! কিংবা হয়তো সংযুক্তি (Conjunction ) ও বিযুক্তির ( distinction ) নিরিখে কবিকল্পনার ঊর্ধ্বায়ন। 

"প্রতি এক নতুন দিন অভিপ্রেত শব।

বৃদ্ধ দু-হাত ধীরে ধীরে

ডানা হয়। হয়ে ওঠা কুঁজময়; স্মার্তভার---

যেমন 'হয়' বহুজ প্রজাপতি, তক্ষক আর প্রবাদ;---" 

( প্রতি অঙ্গ )

শব্দের হ্যালুসিনেশন কিভাবে কবিতার প্রাচুর্যকে অবারিত করে তোলে, তারই সেমিওলজি অর্থাৎ সংকেতবিজ্ঞানে; যার "স্মার্তভার" অর্থাৎ স্মৃতির অনুসারী সংকেতের বাহ্যিক রূপ ও অন্তর্নিহিত অর্থের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন একের পর এক সংকেত-বিম্ব ! বিশেষ করে ভাষাবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একটি সংকেত দুইটি অংশ নিয়ে গঠিত – বাহ্যিক রূপ বা দ্যোতক (signifier) ও অন্তর্নিহিত অর্থ বা দ্যোতিত (signified)। যেমন ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দ্যোতক হল কোন ধ্বনিসমষ্টি বা চিত্র, যেমন “মহানির্বাণতন্ত্র” একটি ধ্বনিত শব্দ বা লিখিত শব্দ। অন্যদিকে দ্যোতিত হল তন্ত্রের ধারণা, এই দুইটি উপাদান একত্রে মিলে কবি জানিয়ে দিলেন আমাদের দ্বিজত্বপ্রাপ্তির অভিপ্রেত অপেক্ষা। যেখানে একজন পাঠক হিসেবে আমিও তাকিয়ে থাকি আরো বহু অপেক্ষার উৎসে। তখন মনে হয় হৃদয়সংবাদী এসব কবিতা যেন একটি ভ্রমণ।বহুজ প্রজাপতি, তক্ষক ও প্রবাদ কবিতার বয়ানে যেমন ধরা রইল, বহু পাঠপ্রসঙ্গ ঘোষণাহীন প্রখরতায় তেমনি সহৃদয় সামাজিক। আর গড়ে উঠেছে এক বহুস্বরিক আনন্দ। স্বপ্ন কল্পবাস্তব এখানে স্থান পরিবর্তনে অনলস উৎসাহী। কী বলছে নয়, বরং কীভাবে কথনটি পরিবেশিত—সেই বুনন এই কবিতায় তুমুল।

কবিতায় ধ্বনি রচনার দুটি প্রধান বৈপরীত্য আলো-অন্ধকার, স্থিরতা-অস্থিরতা স্বরের ধ্বনিপদার্থিক বৈশিষ্ট্যে আভাসিত। তাই ধ্বনিসচেতন প্রাবল্য অমৃতার কবিতায় অদ্ভুত ভাবেই অনুনাদের চিত্ররূপ। এখানে সচেতন ভাবে বলতে ইচ্ছে করলো না। কারণ, কবিতার আলোর মধ্যে যে শব্দের উত্তোরণ ঘটেছে সেটা আত্মার আলো, বুদ্ধির যবনিকা ভেদ করে সেই আলো আমাদের দেখা ও ভাবার মধ্যে একটা প্রতিসরণ ঘটিয়ে দিয়েছে ক্রমাগত। কিন্তু কিভাবে? আরও একটি কবিতা পড়ে নেওয়া যাক---

" আলোয় দেখেছি কোণ ঠেসে রাখা সিলমোহর

আর যত কিছু বৈধ তলব, সাবধানি

গিঁট বেঁধে রাখা অস্ত-রঙের আবডালে

দারুণ সেজেছ। যত্নে এবার পথভুলে

স্বেদ জমে জমে পুণ্যের লোভে ধূপদানি,

ভালো লাগে দাগ, জাপটিয়ে ধরে চারপ্রহর---"

( আনন্দঘর )





প্রথমত বলে রাখি, কবিতাটি এখানে শেষ নয়। আবার শুরুও নয়। আসলে সমগ্ৰ কাব্যগ্ৰন্থ জুড়ে যেন ভাস্কর্যের চেতনায় এক নর্তকী। মহেঞ্জোদারোর রঙ্গশালায় তাকে দেখা গেছে। অথবা ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে মন্দিরে। মনে পড়ে যায় রামগড়ের গুহালিপিতে দেবদাসী সুতনুকার উদ্দেশ্যে দেবদীন্ন যে ভালোবাসাটুকু খোদাই করেছিল, সেই কাহিনীর অভিমুখ যেন এই কবিতাটি। দেবদীন্ন সুতনুকার সঙ্গে চিরকালের জন্য মিলিত হতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। পারেনি এই কারণেই যে, সুতনুকা নিশ্চয়ই নৃত্যের কারণে দেবতার কাছে আত্মপ্রদও ছিল। তাই বৈধ তলবের চারপ্রহরে কবিতার চিত্রকল্প জুড়ে আমরা দেখতে পাই নারীর সংরাগ, চমকানো মেঘ, করুণ সুখের কুঠুরি! 

বহু লুকনো মিথের পরতে পরতে এক প্রিয়দর্শিনীর কথাই হয়তো কবি বলতে চেয়েছেন অবদমনের কলঙ্ক ও কোকনদে। কবির কথায় "ইচ্ছেধারী ছোটে" আর "ইচ্ছেধারী দ্যাখে" সৃষ্টির ঈশ্বরস্রোত... । আসলে অমৃতা দেখিয়ে দিয়েছেন, কিভাবে আপাত সারল্যের মধ্যে ক্রমশ জটিলতর রূপ নেয়; যা কিছু অগভীর তা ক্রমবর্ধমান গভীরতার জন্যে স্থান করে দেয়, বিশ্বলীলার মধ্যে অপরা-প্রকৃতি ক্রমে পরা-প্রকৃতির প্রকাশের জন্য পথ ছেড়ে দেয়... এই সমস্ত কিছুর ঋজু ও প্রত্যক্ষ রীতির ছন্দবিজ্ঞান। যেমনটি " জন্ম" কবিতায় পাই----

" অজান্তে গিলেছ শব্দ, রতিকাঁটা আর অন্তে মিল।

উজ্জ্বল পলায়ন যার,মজুত রেখেছে দিন

ফুটিফাটা কত হেঁটে যাওয়া। রাত তবু

জানলা নেশায় পাশ ফেরে তার, ভাবে,

                           উদবৃত্ত আলোর মুখে যতটা

বেঁচেছে ঋণ, অন্ধকার চোখে--

তারও রোপণ বাজে, উদাস সে ফেলে যাওয়া দিকচিহ্নময়

কোঁচড়ে কুড়ানো থাক,দশ মাস,নয় দিন, পরাজিত ভয়!"

"পরাজিত ভয়" আনন্দেই কি আমাদের এগিয়ে যাওয়া? আমাদের পিছিয়ে আসা? জীবনের বীজতলায় দাঁড়িয়ে যেন অনন্ত জাগে।নারীদেহে থাকে রাধাবিন্দু এবং পুরুষদেহে কৃষ্ণবিন্দু।দুটি বিন্দুই আধা অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ নয়। কেননা, বাউলদের একাংশ মনে করে কৃষ্ণবিন্দু থেকে রাধাবিন্দুর সৃষ্টি। অর্থাৎ পূর্ণ কৃষ্ণবিন্দু থেকে খ–ত হয়ে রাধাবিন্দুর সৃষ্টি হওয়ায় তা খ–ত। অর্থাৎ অর্ধ। … বিন্দু সাধনায় এই দুই অর্ধবিন্দু নির্দিষ্ট যোগ ও নিয়ম মেনে মিলিত হলে পুনঃ পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। পুনঃ পূর্ণতাপ্রাপ্ত এই রাধাবিন্দু-কৃষ্ণবিন্দুর মিলনে সাধক/ সাধিকা সূক্ষ্মতম মহানন্দের অনুভবে নির্ভার হয়, যা বাউল-সাধনার লক্ষ্য।বিচিত্র সাধনায় এ-দুটিকে মিলিয়ে যার সন্ধান পাওয়া যায় বাউলের ভাষায় সেই হচ্ছে মনের মানুষ, অচিন পাখি, আলেক সাঁই ইত্যাদি ইত্যাদি। একে পেলে মহাসুখ, মহানন্দ লাভ করা যায়। কিন্তু দুই অর্ধবিন্দুকে পূর্ণতায় পরিণত করা কঠিনসাধ্য, আর্জান শাহ তাঁর একটি গানে যাকে কালার সঙ্গে বোবার মিলন বলেছেন। আমার কালা আর বোবার মিলনে খুঁজে পাই বেঁচে আনন্দ। সৃষ্টির ষড়ঙ্গ। আমাদের আত্মিক অভিব্যক্তি, যার শিকড়টি বসানো রয়েছে দৈহিক জীবনের মাটিতে। মানুষের মুক্ত অসীম আর মুখরিত সসীমের আশ্রয় নীড় এই কবিতাগুলির খন্ড খন্ড আনন্দভৈরব...