Sunday, December 21, 2025

প্রদীপ চক্রবর্তীর গদ্য | নিঃসঙ্গ ছায়ানটের শতবর্ষ

|| ব্ল্যাকহোল পত্রিকা || প্রদীপ  চক্রবর্তীর গদ্য

নিঃসঙ্গ ছায়ানটের শতবর্ষ [ পর্ব: ২]


প্রস্তুতির প্রেক্ষাপট 
..............................

মেঘে ঢাকা তারা,কোমলগান্ধার,সুবর্ণরেখা এই দেশভাগত্রয়ীর বেশ আগে ১৯৫১-৫২য় ঋত্বিকের হাতেখড়ি নাগরিক তাঁর প্রথম ছবি, আধুনিক বাংলার দুর্যোগ বিষয়ে প্রথম বিবৃতি। প্রসঙ্গের ঐক্য সত্ত্বেও আঙ্গিকের বিচারে নাগরিক-এর সঙ্গে পরের তিনটি ছবির পার্থক্য অনেক। তা-ও আখ্যানবস্তু আর আখ্যানযুক্তির যে-সংশ্লেষ ঋত্বিক একদিন ঘটাবেন, তার কয়েকটি আগাম লক্ষণ নাগরিক-এ আছে: আর কিছু না হোক, গোড়াপত্তনের ধরন থেকে পরবর্তী বিকাশের আঁচ নিশ্চয়ই মেলে।


১৯৫০ সালে নিমাই ঘোষের ছিন্নমূল ছবিতে অভিনয়ের সূত্রে ঋত্বিক যুক্ত হন চলচ্চিত্রের সঙ্গে। তবে 'সিনেমা' সম্পর্কে আগ্রহের সূচনা কৈশোর ও তারুণ্যের সন্ধিলগ্নের দিনগুলোতে। ঋত্বিকের মেজদা 'নিউ থিয়েটার্সে'র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ক্যামেরাম্যান হিসেবে, স্ট্রিট সিঙ্গার ছবিতেও তিনি কাজ করেছিলেন। তাঁরই সুবাদে প্রমথেশ বড়ুয়া থেকে বিমল রায় পর্যন্ত চলচ্চিত্র জগতের অনেকেরই তাঁদের বাড়িতে আসাযাওয়া ছিল। এঁদের আড্ডা; ছবি নিয়ে আলোচনা কিশোর ঋত্বিককে প্রবলভাবে আকর্ষণ করতো, তবে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করার কোন সচেতন ভাবনা তখনো মনে জাগেনি।

চলচ্চিত্রকার ঋত্বিকের জীবন শুরু হয় বিমল রায়ের কাছে-তাঁর ছবির মুখ্য সহকারী ও কাহিনীকার হিসেবে। সম্পূর্ণ স্বনির্ভর আত্মপ্রকাশ কিন্তু ১৯৫১ থেকে ৫২ সালের মধ্যে নির্মিত বেদেনী। অরূপকথা ছবিতে। এখানে তিনি একাধারে চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক। ছবিটি অবশ্য নানাকারণে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এর পর একে একে সৃষ্ট হয় তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর বহনকারী অনবদ্য ছবিগুলো, যদিও সমসময়ে তা ঋত্বিককে বিশেষ কোন সাফল্যের মুখ দেখাতে পারেনি। আমাদের দুর্ভাগা দেশে চলচ্চিত্র সম্পর্কে অজ্ঞতাও এর একটা বড় কারণ। ঋত্বিক তাঁর মননে মেধায় সময়ের থেকে অনেক এগিয়েছিলেন এবং এখনো রয়েছেন। যাই হোক মুখে তিনি যতই বলুন না যে চলচ্চিত্র প্রকাশ-মাধ্যম হিসেবে তাঁর কাছে অপরিহার্য বা শ্রেষ্ঠতম নয় তবু আমৃত্যু চলচ্চিত্রকে তিনি ছেড়ে যেতে পারেননি। "ছবি না করে তো বাঁচতে পারি না.... কাজেই এই ছবিই করি, আর কিছু না।"

ছবির বিষয়বস্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তিনি তাকিয়েছেন মানুষের দিকেই-"তাৎক্ষণিক মানুষের দুঃখ-দুর্দশা কোনদিকে যাচ্ছে সেটার দিকে তাকাই এবং টু দি বেস্ট অব মাই এবিলিটি সেটা আমি বলার চেষ্টা করি।"

পরের ছবি নাগরিক (১৯৫২-৫৩)-কাহিনী, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা ঋত্বিককুমার ঘটক। যে ফিল্ম গিল্ডের ব্যানারে ছবিটি তৈরি হয়েছিল, তার তিনজন সংগঠক ছিলেন-প্রমোদ সেনগুপ্ত, ভূপতি নন্দী ও ঋত্বিককুমার ঘটক। এই দুজনই ঋত্বিকের প্রতি গভীর ভালবাসা ও অন্তরের টানেই এগিয়ে এসেছিলেন। বাড়ী মর্টগেজ রেখে টাকা দিয়েছিলেন ভূপতি নন্দী। এঁরা ছাড়াও দারোয়ান, ছুতোর কেষ্ট রায়, বহু সাধারণ মানুষ ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেন। কারণ-"সমস্ত থিমটাই ছিল বাস্তবজীবনের সুখেদুঃখে গাঁথা। তাই নাগরিক হয়ে ওঠে পিপলস্ আর্ট" (দেবব্রত মুখোপাধ্যায়)।

ভূপতি নন্দীর সঙ্গে ঋত্বিক ঘটকের আলাপ মৃণাল সেনের মাধ্যমে ১৯৪৮-৪৯ সালে। এই আলাপ ক্রমে প্রগাঢ় হয়ে ওঠে।-"ক্রমে ক্রমে দেখলাম যে মৃণালের চেয়েও ঋত্বিকের উপর আমার আস্থা বাড়ছে।... গণনাট্য সঙ্ঘের ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে ঋত্বিকের শিল্পগত সৃষ্টির ধ্যানধারণা এবং স্বপ্নের অনেক মিল আমি খুঁজে পেলাম,... বক্তব্য যদি কবিতার মাধ্যমে, গানের মাধ্যমে, নাটকের মাধ্যমে বা আরো নানা মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়; তবে সেটা সেভাবেই ত ব্যবহার করা উচিত -এই কথাই ঋত্বিক মাঝে মাঝে আমাকে বলত,... অর্থাৎ ফিল্ম সম্বন্ধে ঋত্বিকের এই মুক্ত মন আমাকে চমৎকৃত করেছিল।"

ঋত্বিক যখন নাগরিক করার কথা ভাবেন তখন স্বাভাবিকভাবেই ভূপতি নন্দী এগিয়ে এসেছিলেন-অর্থের লোভে নয়, সম্পূর্ণ আদর্শের টানে। যে টাকা তিনি দিয়েছিলেন তা তিনি ফেরৎ পাননি কোনদিন, তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশও করেননি। ক্ষোভ একটাই যে অতি সামান্য কারণে, হয়তো কোন সামান্য ভুলের জন্য ছবিটা মুক্তিলাভ করেনি এবং বাক্সবন্দী থেকেই সেটা নষ্ট হয়ে গেল। নির্দ্বিধায় তিনি একথাও বলেছেন-"আমার এইটুকুই আনন্দ যে এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিতান্তই ঘটনাচক্রে আমার নাম জড়িত হয়ে পড়েছে।” এই ঘটনাগুলো আমাদের অন্তত এটুকু বুঝতে সাহায্য করে যে ঋত্বিকের মানুষের প্রতি ভালবাসা, আদর্শের দৃঢ়তা, সৎ ও স্বার্থনিরপেক্ষ চিন্তা ছবির বাইরের মানুষকেও এভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে, আকর্ষণ করেছে।

পরিচালকের জীবদ্দশায় এ-ছবি মুক্তিলাভ করেনি। জীবনের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের সম্পূর্ণ এই ছবি তাঁর মৃত্যুর দেড় বছর পরে ১৯৭৭ সালে কলকাতার, দর্শক দেখতে পান। ততদিনে ছবিটিও সম্যক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মৃতপ্রায়।  শ্রী ব্রম্ভা সিং ও শ্রী রমেশ যোশী ফিল্মটির একটি প্রিন্ট উদ্ধার করেন বেঙ্গল ফিল্ম ল্যাবরেটরি থেকে। মূল নেগেটিভটি হারিয়ে গেছে। সময়ের ক্ষতচিহ্ন (এই প্রিন্টটা ১৯৫৩য় করা গুটিকতকের একটি) ছিল এর সর্বাঙ্গেই প্রায়। পুনা এন. এফ. এ. আই-এর কিউরেটর শ্রী পি. কে. নায়ার ছবিটির প্রিন্ট এবং একটি ডুপলিকেট নেগেটিভ তৈরি করেন ১৯৭৭ সনে। ছবিটি ২৫ বছর পরে মুক্তি পায়। তবে ১৯৫৩ সাল নাগাদ হাওড়া জেলার একটি মফস্বল প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি কয়েকদিন চলে এবং আইনগত কারণে প্রদর্শন বন্ধও হয়ে যায়।)



No comments: