Wednesday, January 19, 2022

জান্নাত মণির কবিতাগুচ্ছ

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||     জান্নাত মণির কবিতাগুচ্ছ



আমি তো আছি ই-
 
পিঠের পেছনে শেষ চুম্বন
অগ্নির্দ্যুতির মত জীবন্ত হল আমার ফ্যাকাসে মুখ।
আমার খোঁপার গুঁজে দেয়া কাঁটা
তুমি হাসলে !
আমার লজ্জাতুর লজ্জা সাত সাগর থেকে
জল তুলে নিল,
উল্কার চোখ সূর্যমুখী আমার
আমি তো আছি ই-
দূর দরান্তের খসে পড়া নক্ষত্রগুলো
এক এক করে জড়ো হতে থাকে
আমার হৃৎপিণ্ড


সাঁকো

আমি পাখির মত পথ চিনে ফিরে আসি মুঠো ভরা শর্ষে ফুলের ঘ্রাণ নিতে। তুমি কেন থামাও পথ বিধাতা ! আমিতো ঢাকতে চাইনা চোখ আমার সোনায় মুড়ানো সুখ। সবুজের সংসারে ফুল ফলের রেণুমাখা প্রজাপতি আমি জড়িয়ে রাখ কেন হলদে শেকড় ? আমিতো ভাসিয়ে দিয়েছি জীবনের মোহনা আমাকে ডেক না- আমি আর ফেরাবোনা মুখ।

হুমায়ন আজাদের ঢাকা

তোমার কাছ থেকে কিছুই নিতে পারেনি-ঢাকা বহু দূরে নিবাস ছেড়ে এসে শুধু মুখের রেখাগুলিই হারিয়েছি সাঁঝ বেলায় ! দাবার ছকের মত সাজানো শহরে কত মুখ কত গল্প কত ঝলমলে ঝিলিক। কাকতাড়ুয়ার ভয় ! ঝলসানো রোদের ভয়,শুয়রের থাবার ভয় কাজলা দিদির মত সন্ধ্যা নামেনি আমার ভাড়াটে ঘরে। যে স্বপ্ন দেখেছি স্বপ্নের মত হারিয়ে গেছে থমথমে আকাশে। এই যে আসছি বলে জ্বলজ্বলে একটি নক্ষত্র মিলে গেছে ওই  দূর পাহাড়ে। দুখিনী হয়েছি দ্বিগুণ, জমে থাকা ডোবার মত হেরে গেছি ! তোমার কাছ থেকে কিছুই নিতে পারেনি-ঢাকা তোমার এলিয়ে দেয়া চুলে রুপোর একটি কাঁটা গুঁজিয়ে দিতে পারেনি আমি, হতে পারেনি রঙিন একটি কাঁচের মার্বেল। হকারের কোলাহল থেকে কাকতাড়ুয়ার ভয় থেকে নিসর্গের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। বৈঠক খানার ছিমছাম ঘরে ইন্টার্ভিউ নামে কুটিল রাজ্যপট ছেড়ে আমি ঘাসফুলের পসরা সাজিয়েছি। ফেলে দেয়া বেহালার ছেঁড়া সুতো দিয়ে দোতরা বানিয়েছি। উদোম শরীরে গুটিগুটি পায়ে ছুটে আসবে সব ল্যাংটশিশুর দল আনন্দে নড়ে উঠবে হেঞ্চি লতার ডগা। তোমার কাছ থেকে কিছুই নিতে পারেনি-ঢাকা।

হলদে ঘুড়ি

জীবন যখন হৃদয়ের কথা বলে হারিয়ে যায় সবকিছু ! যে গৃহে থাকে না ফুলের শোভা শূন্য ভেজা ভাস সুখের দেখা মেলে না তখন। হাতছানি দিয়ে ডাকে অরণ্যের ছোট্ট জোনাক বন্ধ চোখে অন্ধকারে উদ্দীপ্ত ভোর। বিপন্ন একটা ক্ষুধা দাঁড়িয়ে থাকে ফেলে দেয়া মাংসের হাড়ে লেগে থাকে এক চিমটে রস। কেউ ছুঁয়েও দেখেনি বাড়ন্ত ঘাসের ডগা শরতের আকাশে প্রসন্ন স্বর্গ। প্রতিবন্ধী একটি দিন চলে যায় হলদে ঘুড়িটা জানে না নিশীথে একটি দিন চলে যায়। সময়ের আকাশে হলদে ঘড়িটা জীবনের কাছেই তবুও কতদূরে...

উষ্ণদ্বীপ হয়ে মরুভূমি
আমি আলো ছড়িয়ে দেব শুষে নিব অন্ধকার ক্ষুব্ধ শ্লোগানে হেঁটে যাব দুর্গম পথ আমি চিত্রময়ি জান্নাত! চলছে তালাস মানুষের বাস ঘাতকের কামড়ের দাগ, কুঁড়েঘরে হৃদপিণ্ড রেখছি জীবনের কাছে প্রেম চেয়েছি । শেকড় খুঁজতে অরণ্য কেটেছি উষ্ণদ্বীপ হয়ে মরুভূমি । ঠিকানাবিহীন ধর্মশালা দেখছি বিদ্যাপীঠ আইনের পথ মাতালের পথ অচেনা গাঁয়ের পথ। দ্রোহ ছড়াতে জনস্রোত দেখেছি ছায়াতল তলিয়ে নকশিকাঁথা বিছিয়ে দিয়েছি । জন্মাবধি পরিতেক্ত হয়েছি পরাধীনতার কবোর খুঁড়েছি । ছুঁয়ে দেখেছি সভ্যতা ছিন্ন করেছি কাঁটাতার দিয়েছি অনুপ্রবেশের অধিকার । শতাব্দীর স্বরতন্ত্র ছিরে উষ্ণতা গিলেছি দেখেছি ধু ধু মাঠ আমার কোন বংশধর নেই ধূসর দূর্বাচল ।


Sunday, January 16, 2022

কবিতার ডালপালা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||    অরিজিৎ চক্রবর্তী

কবিতার ডালপালা 
দ্বিতীয় পর্ব

সংকেতের কথা বলতে গেলেই আমার মাথায় সংকেত প্রক্রিয়াজাতকরণ (ইংরেজি: Signal processing)  - এর ভাবনা আসে।  তখন বিষয়টি শুধু কবিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এখানে “সংকেত” বলতে বাস্তব বিশ্বের কোন ঘটনার আচরণ বা বৈশিষ্ট্যসমূহ (যেমন শব্দ, চিত্র,আলো ইত্যাদি) সম্পর্কে তথ্যাদিকে প্রতিনিধিত্বকারী গাণিতিক ফাংশনকে বোঝানো হয়। কিন্তু প্রক্রিয়াজাতকরণ কৌশলগুলি ব্যবহার করে সম্প্রচারিত সংকেতের নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধি, সংকেত সঞ্চয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি, এবং ব্যক্তিমনে সংকেতের মান উন্নয়ন করার প্রচেষ্টায় আমি আবার কবিতার কাছে ছুটে যাই। এই ছুটে যাওয়ার মধ্যেও একটা বিজ্ঞান আছে।কবিতা হলো সেই বিজ্ঞানের অবচেতন। স্পর্ধিত উন্মেষ বীজের নিহিত শক্তির অনিবার্য বিকাশ। এই অনিবার্যতা অবশ্যই মেধার কর্ষিত ভূমির আনুকূল্য চায়। জন্ম নেয় এক সংকেতদ্রষ্টা কবির কাব্যগ্ৰন্থ " জীবনের পাজামা ও গিঁট"।কবির নাম বিল্বমঙ্গল গোস্বামী। বইটির প্রকাশকাল ১ ডিসেম্বর ২০০৮ (প্রকাশক- সমাকৃতি)। নিবাস বিষ্ণুপুর। বছর কয়েক আগে গত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর কবিতার বইটি আমার পড়ার টেবিলে জ্বলজ্বল করছে। যেন এক আশ্চর্য মানস পর্যটন। পরিযায়ী বিহঙ্গের স্বার্থপর বিভ্রমণের থেকে সুদূর সেই পর্যটন। কারণ, সে তো সত্তার যাপিত অযুত জন্মের অতীত থেকে অস্তিত্বের চলমান বর্তমানে, বর্তমানের দুঃসহ অসম্পূর্ণতা থেকে আলোছায়াময় আশ্রয়দাত্রী অতীতে কিংবা স্বপ্নসম্ভব ভবিষ্যতে প্রয়াণ।

"সারাজীবন ধরে একটি মাত্র কবিতাই লিখে এসেছেন আপনি--- আটা দেড় কিলো, চাল দুকেজি, আলু পাঁচশো গ্ৰাম...। রোজ রোজ সকালে লেখা চিরকূট কবিতা আপনার প্রতিদিন সজীব করেছে প্রাণ, সবুজ করেছে দেহ। এইসব জীবন কবিতা লিখে, এইসব জীবনমুখী কবিতা লিখে লিখে আপনি স্বয়ং আজ কবিতা হয়ে গেছেন। এখন আপনার সামনে জীবন্ত দাঁড়ালে মনে হয় হিমালয়ের নীচে আমি এক ছোট্ট দেবদারু। তাই আপনাকে নিয়ে কিছুই লেখা হল না, আমি অক্ষম। আসলে কবিতা নিয়ে কবিতা লেখা অসম্ভব, কবিতার হিমালয় আঁকা যায় না।" ( বাবাকে নিয়ে লেখা )

হয়তো এই কবিতা পাঠ করে পাঠক একটা চিরচেনা ছবির ভিতর নিজেকেও খুঁজে পাবেন। কিন্তু কবি সেই চিরচেনা চিত্রকল্পের ভিতর নিজস্ব স্বরভঙ্গিমার আবহে একটা প্রাণশক্তিকে যেন জারিত করলেন।কাব্যের সেই চরম অনির্বচনীয় রহস্যের প্রতি নয়, বরং কাব্যপ্রবাহের ভাব-সমুন্নতি ও গভীরতার প্রতি।  পিতা ও পুত্রের মধ্যে মহাজাগতিক " কবিতা" শব্দটির প্রয়োগ এবং প্রয়োগের বিস্তার আমাকে বারংবার ভাবিয়ে চলেছে। আসলে বিল্লমঙ্গল গোস্বামী কবিতা লেখার জন্য কবিতা লেখেননি। তিনি সব সময় ঘূর্ণনে দাঁড়িয়ে আছেন, অথচ চারপাশ স্থির নিমগ্ন। তাঁর নিমগ্নতার মধ্যেই সম্পর্কের অক্ষমতা মিলেমিশে একাকার। আর এই দুই অক্ষম-মেরুর সংযোগকারী সেতুটি হলো "কবিতা"!

কবিতাটি পড়তে গিয়ে যেমন ভালো লাগছে, তেমন মনখারাপ ঘিরে ধরছে। কেন যে এরকম হচ্ছে আমি নিজেও বুঝে উঠতে পারছি না। যদিও মনখারাপের কারণ খুঁজতে গিয়ে আমি দেখে ফেলছি, কিভাবে কবিরা কবিকে হত্যা করে ! আজ তেমনই এক হত্যা কাহিনীর বিবরণ তুলে ধরবো এই লেখাটিতে। তবে তার আগে আরও একটি কবিতার দিকে চোখ রাখব। 

" শোনো, তোমার সঙ্গে কয়েকটা জরুরী কথা আছে।
আমাকে যখন মেঝেতে শুইয়ে রাখবে তখন সাদা কাপড় চাপা দেবে না। আমি সরলভাবে শুয়ে থাকবো মাথা উঁচু করে। প্রয়োজনে দুটো বালিশ দিয়ো। পাশবালিশ দিতে ভুলো না।মাথার পাশে ধূপ জ্বালিও না, খবরদার খেয়াল রেখো, কেউ যেন ভুল করেও ফুল না নিয়ে আসে।যারা আমায় দেখতে আসবে তাদের চোখে যেন বিস্ময় ছাড়া অন্য কিছু না থাকে। একবিন্দু জল গড়িয়ে পড়লে আমার আফশোস হবে। তুমি জানো, একটি মেয়ের একফোঁটা প্রকৃত জলের জন্য আমাকে কত ঘুরে মরতে হয়েছে? চন্দনের ফোঁটা দেবে না। আলতা একদম নয়। আর হ্যাঁ, নাকে যেন তুলো না দেওয়া থাকে; বড্ড বিশ্রী লাগে। সেন্ট দিতে পারো কিন্তু অবশ্যই ফরাসি। আমি বীরের মতো ঘুমবো। সেই সময় ফোন এলে আমাকে ডিসটার্ব করবে না। আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এনজয় করবো-- কার মুখ কতটা ফ্যাকাশে হলো। শোনো, ওরা যেন হরিবোল না বলে। অঞ্জন কিংবা সুমনের গান চালিয়ে দেবে। ওদেরকে বলে দিয়ো ওরা যেন আমায় ন্যাংটো না করে। সারাজীবন এতো বার উলঙ্গ হতে হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। ওই দিনটা অন্তত টিপটপ ফিটফাট থাকতে দিয়ো। হাউমাউ করে কেঁদো না। দরজার পর্দা ধরে চুপি চুপি কাঁদবে সুচিত্রা সেনের মতো। বাঙালি কান্নার মধ্যে একটা শিল্প থাকে। আর একটা কথা, সেই পাগলি মেয়েটি যদি আসে, একমাত্র তাকেই আমার হাত ছুঁতে দেবে। আমার ঠান্ডা হাত এক ঝটকায় উষ্ণ হয়ে যাবে, আর আমি ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে পৌঁছে যাব সঠিক ঠিকানায়... ( ইচ্ছাপত্র )

কবিতার বিবরণখানি অতিক্রম করে অতঃপর আমরা পূর্বাপর পরিকল্পিত অনুমানের তামাশা দেখতে পাই। কবি নিজের জীবন ও জগতের মধ্যে গুঁজে দেন কিছু কৌতুকপ্রদ মর্মরধ্বনি। প্রশ্নাতীতভাবেই এই স্বেচ্ছাচারিতা ক্রমাগত আঁকড়ে ধরে বোধের অর্জন। নিজের সর্বৈব বিনাশটিই যেন প্রেমময় হন্তারকের করতলে তুলে দেন কবি। এই নশ্বর জীবনও যে এক চির-অফুরন্ত নিরন্তরতার সোপান--- এমনই নিবিড় অনুভবে এবং ইচ্ছাপত্রের কৃতাঞ্জলিপুটে কবি আমাদের পৌঁছে দেন সেই সঠিক অনন্যূমেয় ঠিকানায়। বিল্বমঙ্গল যেন এরকম একেরপর এক শব্দদ্যোতনায় লিখে চলেন ইচ্ছামৃত্যুর চিরকূট।

" কতো স্বপ্ন আঁকা হয়
  কতো স্বপ্ন মরে যায় উপযুক্ত খাদ্যের অভাবে..." ( ছেঁড়া ভাবনা, টুকরো অনুভূতি )

দীর্ঘ পরিক্রমন শেষে প্রজ্জ্বলন্ত জীবনের উষ্ণতা হারিয়ে কবি দেখে ফেলেন খাদ্য ও খাদকের আত্মভেদী সংকট। আর এই খাদ্য খাদকের জটিল বাস্তুতন্ত্রে ভেসে ওঠে কবি ও কবিতার প্রবৃষ্ট ছায়াযুদ্ধ। তুচ্ছতার বেদনা ছাপিয়ে আত্মহননের অমোঘ নিয়তি।


" একটা মাঝবয়সী বউ, একটি লিকলিকে বাচ্চা
  চলে যেতে যেতে কোনোরকমে টিকে যাওয়া একটা চাকরি
  একটা ভাঙা গিটার,আর একটা ঢলঢলে পুরোনো পাতলুন
                                                      এই আমার কবি জীবন।

                  সেই পাজামায় মিনিমাম ছত্রিশটা গিঁট। সাঁইত্রিশ
           বছর ধরে আমি গিঁট খুলে চলেছি। একটা খুলছি তো
    আর একটা লেগে যাচ্ছে। এরকমই এক একটি গিঁটের মাঝে
ছোটো বিজ্ঞাপন, এর মধ্যেই কখনো চুপ করছি কখনও কথা বলছি,
                                       কখনো রাত্রির দুরভাষে বোকামেয়ের সঙ্গে
                            স্মার্ট কিংবা ন্যাতন্যাতে পঁয়ত্রিশ মিনিট বকমবকম।

             এসবের সঙ্গেই একটা দিগন্তখোলা জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে
                       স্বপ্ন-রোদ-হাওয়া আর বৃষ্টির রিমঝিম অলৌকিক শব্দ।

          এই আমার কবিতা লেখা, মরে মরে বেঁচে থাকার অপূর্ব যন্ত্রণা।"
         
        ( প্রবেশক কবিতা )

এই কবিতার দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকি। চিন্তাগত অভিব্যক্তির মধ্যে জীবন স্পন্দিত হয়। তীব্রতার সাক্ষাৎ সেখানেই পাই যেখানে অন্য অনেক কিছু রয়েছে। অথচ সবই এমন এক সাক্ষাৎদর্শনের তরঙ্গ-ভঙ্গে সবলে বাহিত হয়ে চলেছে, তাকে মরে মরে বেঁচে থাকার অপূর্ব যন্ত্রণার অপরিহার্য অনুষঙ্গে বেঁধে দিয়েছেন স্বয়ং কবি নিজেই। এলিয়ট বলেছিলেন-- 'Poetry is not a turning loose of emotion...' বিল্বমমঙ্গলের কবিতায় আপাত দৃষ্টিতে আবেগের স্বর বেশি মনে হলেও, সেই আবেগের আবেদন অনায়াস ও কাঙ্ক্ষিত। কবিতার আলো ও আনন্দ প্রকাশের জন্যে কবির যে সর্বোচ্চ সামর্থ্য--- তাকে ছুঁয়ে দেখার বিশ্বাসই যেন এই কবিতার আত্মবিলীন চেতনার রঙে রাঙানো জগৎ। অথচ এই জগতের আড়ালে আবডালে হত্যা লুকিয়ে আছে। আমি সেই হত্যাকে চিনতে পেরেছি। আমার কবিতা লেখা জীবনেও যে এরকম হত্যার অনায়াস যাতায়াত। 

কিন্তু কিভাবে তুলে ধরবো সেই কবি বন্ধুর নাম। কষ্ট হচ্ছে। কারণ, বন্ধু কি কখনো হত্যাকারী হয়? বিষয়টা ভাবাচ্ছে! তখন ঘটনাটা লুকিয়ে রাখা মানেই মুখহীন মুখোশের অভিপ্রায়। তাই আমাকে বলতেই হবে। 



Sunday, January 9, 2022

কবিতার ডালপালা

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||  অরিজিৎ চক্রবর্তী 


কবিতার ডালপালা  
(প্রথম~পর্ব)

মনে করা যাক, ছোট ছোট ক্ষুদ্রতামুক্ত কোনো এক মানবসমাজের অস্তিত্ব, প্রতিটি মানুষ যখন সাধারণ অপরাধপ্রবণতাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। যেখানে প্রাত্যহিক জীবন-স্তর এমনই যে বস্তুসামগ্রীর জন্য অন্যজনকে বঞ্চিত করতে হয় না, অন্যের অস্বস্তি সম্পর্কে প্রত্যেকেরই একটি স্বাভাবিক বোধ জন্মেছে এবং তাই কৃতকর্মের জন্য অন্য কারো কাছে জবাবদিহিরও দায় নেই। এ অবস্থায় কত বেশি মুক্তির আস্বাদ পাওয়া যেতে পারে যদি স্ববিরোধ-সচেতনতার হাত থেকে নিজেকে আলগা করে নেওয়া যায়! এই আমি পাহাড় চাই, খানিক পরেই চাই না, চাই সমুদ্র, পরক্ষণেই চাই বনানী, পরক্ষণেই লোকালয়– অথবা আমি পাহাড় চাই আবার চাইও না, আমি ভালোবাসার জনের কাছে চলেছি,একটু দ্বিধাও কিন্তু বয়ে নিয়ে যাচ্ছি সঙ্গে করে। কবিতাও যেন তেমনই এক দ্বিধাদ্বন্দ্বের আঁতুড়ঘর। সেখানে নির্দিষ্ট কোন পথরেখা নেই।  সময় ও পরিসর ভাবনার বিচিত্র অভিব্যক্তির মধ্যে কোনো একক কবি কিভাবে নিজস্ব নির্মিত - নৈপুণ্যকে প্রতিষ্ঠিত করছেন, কিভাবেই বা নতুন সময়বোধ ও নান্দনিক চেতনাকে আপন সৃষ্টির উৎস করে তুলছেন আর কিভাবে মেলাচ্ছেন সামাজিক বীক্ষণকে — এইটাই তাঁর সার্থকতার কষ্টিপাথর। আর সেই সঙ্গে রয়েছে জাগতিক তথ্য থেকে কবিতার সত্যে এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে নৈর্ব্যক্তিক উপলব্ধিতে পৌঁছনোর জরুরি পরীক্ষা সমাপনের দায়ও। তত্ত্বগত দৃষ্টিকোণ মুহুর্মুহুঃ পালটে যাচ্ছে! যদিও, এলিয়টের একটি পুরনো ও পরিচিত মন্তব্য আজও সমান প্রাসঙ্গিক; "The progress of an artist is a continual self-sacrifice, a continual extinction of personality"। বস্তুত নিজের ফেলে-আসা পথরেখাকে নিজেই যদি মুছে নেওয়া না যায়, বর্জনীয়েরা শৃঙ্খলিত করবে গতিকে, ঝাপসা হয়ে আসবে গন্তব্য। তাই অভিজ্ঞতার পোড়া মাটি দিয়ে নিজের গভীর ভাস্কর্য গড়ে তোলার প্রাক্‌শর্ত হলো, নিরবচ্ছিন্ন ভাবে নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে এগোনো।

 “…একটি পৃথিবীর অন্ধকার ও স্তব্ধতায় একটি মোমের মতন যেন জ্বলে ওঠে হৃদয়, এবং ধীরে ধীরে কবিতা-জননের প্রতিভা ও আস্বাদ পাওয়া যায় ।” (কবিতার কথা, জীবনানন্দ দাশ) কিন্তু নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির প্রবর্তনায় “ to judge of poets is only the faculty of poets” – বেন জনসনের এই বহুল উচ্চারিত উক্তিটি ভাবতেই হয় । আর ভাবছি বলেই আবিষ্কার করছি সত্তরের এক সত্যি, কবি স্বপন চক্রবর্তী’র কবিতাগুলিকে । 

যে বইটা আমার চোখের সামনে খোলা, ওখানে জীবন নেই । 
ওটা ধর্ম কিংবা মিথ্যার অভিধান । 
যে বইটা অশোকস্তম্ভ দিয়ে শুরু, ওখানে সত্যি নেই । 
ওটা ভারতবর্ষের পবিত্র সংবিধান । (অশোকস্তম্ভ) 

নিজস্ব ঘৃণার বাইরে বেরিয়ে এসে শ্রমজীবী মানুষের যে শ্রেণীঘৃণা, তার যে ব্যাপক সংহত রূপ তার সাথে এক পবিত্র বোবা সংবিধানের উপলব্ধি আমাদের অবাক করল । আসলে স্বপন চক্রবর্তীর কবিতা হতাশ করে না, সাহসভরে ঋজু দাঁড়িয়ে থাকে লোকানো বিস্ফোরকের মতো । 

ঠিকঠাক তাপে রুটি সেঁকো 
অতি তাপ রুটিকে পোড়ায় 
কম তাপে রুটি ফোলে নাকো (রুটি)

এই অপ্রত্যাশিত স্পষ্টভাষণ ও ক্রোধ যেন আমাদের আত্মহুতির মধ্যেই জীবনকে বুঝিয়ে দেয় যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করার দর্শন । কবি হয়তো বলতে চান “রুটি” শব্দটির ক্ষুধা, আর্তনাদ, আগুনে সামঞ্জস্য প্রবাহনের নিয়মধর্মী প্রতিভাস । তাই কবি জানিয়ে দেন, 
“নির্গত শ্বাসে কেবলি সন্দেহ । / গলির এমুখ ঘুমালে ওমুখ জাগে । 
এপাড়া কাঁথা মুড়ি দিলে। / তাকে ঘিরে নাচে বিনিদ্র ভৈরব । ত্রাস । 
চিরুনি তল্লাশ । / তবু চোখের পাতায় কী গভীর উৎসাহ (মিড়) 

সত্তর দশক রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্ঠুরতার পিষ্ট হয়ে মানুষের আদিম গোঙানি হয়ে উঠেছিল । ফুলে ফেঁপে উঠেছিল ক্রোধ । কিন্তু এই ক্রোধ ছিল সম্পূর্ণভাবে নিম্ন মধ্যবিত্তের একান্ত । তাই হয়তো কবি স্বপন চক্রবর্তী উচ্চারণ করলেন : 

“শুনেছি শঙ্খচুড়ও দহনের দাউ নেভাতে পাথরে ঢেলে দিয়ে আসে বিষ 
কিন্তু আমার জ্বলে পুড়ে যাওয়ার তরল আমি কোন পাথরে ঢালব ?” (দাউ) 


সৃষ্টি-মুহূর্তের দহন ও উদ্ভাসন তাঁর সুপরিজ্ঞাত, তিনি ‘অজর, অক্ষর, অধ্যাপক’ এর উপলব্ধি বহির্ভূত সেই দহনের যন্ত্রণাময় প্রস্তুতিতে নিজেও দীর্ণ হয়েছেন । এই নিষ্ঠুর অত্যাচারও যে কোনো-একজন কবি নিজের উপরে করতে পারলেন, তার জন্য কবিকে দোষ দেবো, না সেই আন্দোলনকে, না আন্দোলনের জনক রাজনৈতিক সময়কে, সে বিষয়ে মনস্থির করা শক্ত ।

যেকোনো শিল্প মাধ্যমেই নির্মাণের ভিন্নতা, মূলতঃ চেতনারই পরিবর্তন । চেতনা বদলেই পালটে যায়, দেখার জগৎ ও প্রকাশভঙ্গী । তাবৎ বিশ্বে সব কিছুই কবিতার বিষয় বস্তু হতে পারে । এই দৃষ্টিভঙ্গিকে কেন্দ্র করে বাস্তব ও অবাস্তবতার Tradinational Definition পালটে যাচ্ছে । অনুসন্ধান করছেন তাঁরা । ঘটনার চেয়ে ঘটার সম্ভাবনার মধ্যেই 
বাস্তবতার দেখতে চাইছেন । ফলে ভাষাবদলের কবিতা নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা বাড়ছে । 

আসুন কবি ইন্দ্রজিৎ দত্ত-এর লেখা “রূপসী বাংলা বাই লেন” কাব্যগ্রন্থটির একটি কবিতা নিবিড় পাঠ করি ।

আদৃতা 

হে বাস 
হে ২৩৮ নং বাস, আবার যদি 

আমার মতো 
আয়না বেচতে আসা কেউ 
শহরতলির বাইলেনে হারিয়ে 
ফিরে আসার দিকে তাকিয়ে থাকে অহেতুক 

তাকে আমার কথা বোলো 

তাকে দিয়ো 
আমার অসুখ মাখা চিঠি 
নেমে যাওয়ার যন্ত্রণা 


“আশাবাদের মতো অকাব্যিক আর কিছুই নয়” – লেসলি স্টিফেনের এই বচন সর্বতোভাবে প্রযোজ্য তো বটেই, উপরন্তু সংক্রামক । পূর্ববর্তী প্রধান কবিরা হঠাৎ রাতারাতি নাহলে “সেই অন্ধকার চাই” কিংবা “যে আঁধার আলোর অধিক” ইত্যাকার মন্ত্ররচনার অত ব্যস্তসমস্ত হয়ে উঠতেন না । কিন্তু ইন্দ্রজিৎ-এর বেলায় যে তাঁর চিন্তাগ্রস্ত অস্তিত্বের মূলেই নিরাশা বা অন্ধকারের একটি ন্যায্য ভিতরভূমিকা ছিল, একথা অস্বীকার করা যাবে না । 

আলোচ্য কবিতাটিতে প্রতিদিনের গতির ব্যবহারিক বাস আর নেমে যাওয়ার যে যন্ত্রণা নিছক নান্দনিকেই তার শেকড়বাকড় গচ্ছিত রাখেনা, একটা নতুন ভাবনার উপমাশৃঙ্খল তুলে ধরে তা স্পষ্ট ! আসলে ভাবনার কোনো মানে বই নেই । দৃশ্যের কোনো ব্যাকরণ হয় না । ইন্দ্রজিৎ আয়না বেচতে আসা একটি দৃশ্যের আয়না । যেখানে আমরা নিজেদেরও দেখে ফেলি । তবু কোথাও যেন মনে হয়, ইন্দ্রজিতের কবিতা ক্ষত সৃষ্টি করে না,সেটা তার কাজ নয়, ক্ষতকে আনন্দময় ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলাই তার প্রথম উজ্জীবন । শব্দ ও ভাবনার অন্তর্বর্তী সংকেত ।

Thursday, January 6, 2022

সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন সম্মাননা ২০২১

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||


সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন সম্মাননা ২০২১









সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল সম্মাননা ২০২১
প্রাপক: কবি-গদ্যকার নাসরিন নাজমা চৌধুরী
বই: কথা হারানোর জর্নাল (প্রকাশক: বই তরনী)

১৪ই নভেম্বর, ২০২১ | অবনীন্দ্র সভাঘর | কলকাতা |







প্রাপ্তি











স্মারক হাতে তুলে দিচ্ছেন শিল্পী সমীর আইচ মহাশয়



মানপত্র, উত্তরিয় এবং পুরস্কার মূল্য হাতে তুলে দিচ্ছেন কাটাম-কুটুম শিল্পী পবন লোহার এবং কবি-গদ্যকার দেবাশিস চন্দ





সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন সম্মাননা ২০২১

|| সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন ||       
                 




 সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল ওয়েবজিন সম্মাননা ২০২১    



সাপ্তাহিক ব্ল্যাকহোল 
কবি গৌরাঙ্গ মিত্র সম্মাননা ২০২১
প্রাপক: কবি-সম্পাদক অলোক বিশ্বাস 
১৪ই নভেম্বর, ২০২১ | অবনীন্দ্র সভাঘর | কলকাতা |


মঞ্চে~কাটাম-কুটুম শিল্পী পবন লোহার মহাশয় । চিত্রশিল্পী সমীর আইচ মহাশয় । কবি-গদ্যকার দেবাশিস চন্দ মহাশয় । প্রাপক কবি অলোক বিশ্বাস মহাশয়। 









প্রাপ্তি
         









হাতে স্মারক  তুলে দিচ্ছেন 
শিল্পী সমীর আইচ মহাশয়




মানপত্র, উত্তরিয় এবং           

                                                
পুরস্কার মূল্য হাতে তুলে দিচ্ছেন কবি-গদ্যকার দেবাশিস চন্দ          



অলোক বিশ্বাসের কিছুকথা