Tuesday, December 16, 2025

প্রদীপ চক্রবর্তীর গদ্য | নিঃসঙ্গ ছায়ানটের শতবর্ষ

|| ব্ল্যাকহোল পত্রিকা || প্রদীপ  চক্রবর্তীর গদ্য

নিঃসঙ্গ ছায়ানটের শতবর্ষ [ পর্ব: ১]



(বিশেষ দ্রষ্টব্য --- সমকালীন সময়ের নিরিখে দাঁড়িয়ে, শ্রদ্ধেয় ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে এবং তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত এবং মুক্তিপ্রাপ্ত নয় এমন চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র, নাটক, ছোটগল্প নিয়ে আলোচনা করলে আমাদের আনখশিখর অস্তিত্ব নিয়েই আমরা সংকটে পড়ি। উত্তরাধিকারসূত্রে আমাদেরই ওপরে বর্তায় এই দায়। কারণ জীবিতঅবস্থায় আমরা ঋত্বিকের গভীর উপলব্ধি, দর্শন যেমন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিয়েছি, ভয়ে ও স্বভাব দোষে, যার ফলশ্রুতি  ধীরে ধীরে আত্মধ্বংসের প্রস্তুতি যার মূলে অনেকাংশে আমরাই দায়ী, তাকে অস্বীকার করার কোনো জায়গা আজ আর নেই। তাঁর জীবন ও মৃত্যু দুটো অর্ধ শতাব্দীর কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে। পঞ্চাশ বছরের স্বল্প জীবনের অনেকটা সময় জুড়ে দেশভাগ এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক শিকড়ে যে ক্ষয় ও পচন তা তাঁকে ভাবিয়েছে, তীব্র কষ্ট দিয়েছে। 
নীলকন্ঠের মতো একাই সেই গরল পান করে ধীরে ধীরে নিঃশেষিত হয়েছেন। নানাকরণবশত তাঁর প্রথম ছবি থেকে শেষ ছবি পর্যন্ত অনেক ছবিই ঠিক সময়ে মুক্তি পায় নি। তিনি অতিরিক্ত মদ্যপানে আসক্ত, অস্থিরচিত্ত, প্রথাভাঙা, অনুশাসনহীন, প্রতিবাদী, গড্ডলস্রোতে গা না ভাসানো, আনুগত্যকে তীব্র ভাবে অস্বীকার করেন বলেই বারংবার আমাদের তথাকথিত মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী সমাজের ভন্ডামি তাঁকে ব্যঙ্গ করেছে। কোনোও দিক থেকেই পেরে ওঠেনি বলেই, তাঁর জীবনে নানারকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তাঁর ক্ষমতাকে লঘু চোখে দেখে, এই শিক্ষিত হামবাগ বোনলেস চলচ্চিত্র সমালোচক, সমকালীন প্রভাবশালী পরিচালক বন্ধুরাও তাঁর পিঠে বারংবার ছুরি মারতে দ্বিধাবোধ করেনি। আর আজ শতবর্ষে দাঁড়িয়ে, অনেক স্মৃতি রোমন্থন, তাঁর ছবি দেখিয়ে, বই প্রকাশ করে, যে পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমরা করে চলেছি, তাতে একটুও আমাদের দূষিত কর্মফলের ভার কমে না। আমরা সেই বাঙালি আজও, যারা মৃত্যুর পর শ্রদ্ধেয় গুণীর চিতার পাশে সমাধিফলক রচনা করে, বড়ো বড়ো বাতেলা দিয়ে কাঁদুনি গাই, কিন্তু আমরাই জীবিত অবস্থায়, দিনের পর দিন, পরিকল্পিত চক্রান্তের মধ্য দিয়ে, সেইসব গুণীদের কোণঠাসা করি। তাঁর সবকিছু আশা স্বপ্নকে পিষে, দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে আত্মিক শান্তি পাই। স্রষ্টা ঋত্বিক, দ্রষ্টা ঋত্বিক এই বাঙালিদের হাড়ে হাড়ে  চিনতেন। এরফলে তাঁর সামনে কোনোও বঙ্গজ আঁতেল  সিনেমা নিয়ে বড়ো বড়ো কথা বললে, নিজের স্বকীয় ভাষার আভিজাত্যে তাদের প্রতিআক্রমণে দিশেহারা করে দিতেন। তিনি মনেপ্রাণে সাধারণ মানুষকে ভালবাসতেন, তাদের কথা ভেবেই ছবি করতেন এবং নিজের এই কমিটমেন্ট থেকে আমৃত্যু কখনোই সরে আসেন নি। হাজার প্রলোভনকে উপেক্ষা করেছেন। নিজের সৃষ্টির সততা এবং যাপনকে কখনোই আলাদা করেন নি। 
তাই ঋত্বিকের ছবির ক্যামেরা ও সম্পাদনা , তাঁর বিষয়ভাবনা, সিনেমার সঙ্গীতের প্রয়োগ যে গভীর বোধ ও চেতনঋদ্ধ অসীমতাকে তুলে ধরে, তাতে কেবল আমরা বিস্মিতই হই না, আমাদের বিবেক - বোধ - চেতনাকে এমনভাবে আঘাত করে, জাগ্রত করে, যে সেই অমোঘ নিষ্ঠুরতা আমাদের মনেই প্রতিপ্রশ্ন জাগায় জীবনানন্দের মতো -- 
"মধ্যবিত্তমদির জগতে আমরা/ বেদনাহীন-অন্তহীন বেদনার পথে।/ কিছু নেই- তবু এই জের টেনে খেলি; / সূর্যালোক প্রজ্ঞাময় মনে হ'লে হাসি;/জীবিত বা মৃত রমণীর মতো ভেবে-অন্ধকারে-/মহানগরীর মৃগনাভি ভালোবাসি।/তিমিরহননে তবু অগ্রসর হ'য়ে /আমরা কি তিমিরবিলাসী? / আমরা তো তিমিরবিনাশী হ'তে চাই।/ আমরা তো তিমিরবিনাশী।" )

আজকের বিষয় , 

প্রদীপ চক্রবর্তীর গদ্যে 

 ঋত্বিক ঘটকের প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছায়াচিত্র
                         "নাগরিক"


কালপুরুষ 
..................

রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতির ভূমিকায় বলেছেন- "স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না। কিন্তু যেই আঁকুক সে ছবিই আঁকে। অর্থাৎ, যাহা কিছু ঘটিতেছে, তাহার অবিকল নকল রাখিবার জন্য সে তুলি হাতে বসিয়া নাই। সে আপনার অভিরুচি অনুসারে কত কী বাদ দেয় কত কী যে রাখে।... জীবনের স্মৃতি জীবনের ইতিহাস নহে- তাহা কোন এক অদৃশ্য চিত্রকরের স্বহস্তের রচনা।"-

বিভূতিভূষণের প্রায় সব লেখাতেই 'কালপুরুষের' প্রসঙ্গ আছে। ভারতীয় দর্শনে, উপনিষদে আছে যে কালপুরুষ যাকে ভর করে সে ঘরছাড়া হয়ে যায়, ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়ায়, কোথাও বাসা বাঁধতে পারে না। ভারতীয় চলচ্চিত্রে এই বিবাগী মানুষটি হলেন ঋত্বিক কুমার ঘটক। আপসহীন , ঋজু এই মানুষটির জীবনদর্শন ও ভাবনায় যে নিরবচ্ছিন্ন নিরঙ্কুশ সততা এবং ভাবনার দেশজ শিকড়ের অতলান্ত আহ্বান, তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে বারংবার। সমস্ত জীবনভর এক অদৃশ্য শক্তি তাঁকে চালনা করেছে। এক অদৃশ্য স্রষ্টা তাঁকে দিয়ে এমন সব কাজের ইন্ধন জুগিয়েছে যে আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যে দাবানল আজ জ্বলার কথা, তা স্ফুলিঙ্গেই আত্মঘাতী হয়েছে। আসলে, ঋত্বিকের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব বাঙালী-মানসকে আন্দোলিত করেছে প্রবলভাবে। গড্ডল প্রবাহে অভ্যস্ত আমাদের জীবনকে একদিন শিকড় ধরে নাড়া দিয়ে নতুন জীবনের বার্তা শুনিয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। স্বভাবে বোহেমিয়ানা প্রতিভার বিপুল স্ফুরণকে ক্ষণস্থায়ী করলেও প্রতিষ্ঠান-বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করল এক 'অন্য ধারা'।



গ্রীক পুরাকাহিনীর নায়ক প্রমিথ্যুসের মতোই নিজ জীবনে অসহ্য যন্ত্রণা বরণ করে নিয়েই গৌড়জনের জন্য মধুসূদন যে অগ্নি স্ফুলিঙ্গ উপহার দিয়ে গেলেন মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও ঋত্বিককুমার ঘটক সেই আগুনের সফল উত্তরাধিকারী। অথচ এই ত্রয়ীর অভ্যন্তরীণ মিলনবিন্দুকে আজও কী আমরা সঠিক ভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি?